পরদিন সকালে সুব্রত ঠিক করে, সে নিজেই এই রহস্যের সমাধান করবে। পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার আগে সে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করতে চায়। তার মনে একটা জেদ চেপে যায়। সে প্রমাণ করবে যে সে দোষী নয়। তার মনে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করে। সে জানে কাজটা সহজ হবে না, কিন্তু সে হাল ছাড়তে রাজি নয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, সে মৃগেনবাবুর অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অফিসে গিয়ে সুব্রত দেখে, সেখানে পিনপতন নীরবতা। সবাই থমথমে মুখে কাজ করছে, যেন একটা শোকের ছায়া অফিসের ওপর ভর করেছে। অফিসের পরিবেশটা ভারী হয়ে আছে, যেন কোনো অশুভ আত্মা ভর করেছে। সুব্রত জানতে পারে, মৃগেনবাবু গত কয়েক মাস ধরে একটা বড় প্রোজেক্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। প্রোজেক্টটা ছিল একটা নতুন সফটওয়্যার তৈরি করা, যেটা কোম্পানির জন্য খুব লাভজনক হতে পারত। কিন্তু প্রোজেক্টের কাজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি খুন হয়ে গেলেন। এটা কি শুধুই একটা কাকতালীয় ঘটনা? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো গভীর রহস্য আছে? সুব্রত মনে মনে ভাবে, হয়তো এই প্রোজেক্টের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মৃগেনবাবুর খুনের রহস্য।
সুব্রত মৃগেনবাবুর অফিসের কর্মীদের সাথে কথা বলে। তাদের মধ্যে কয়েকজন জানায়, বস ইদানিং খুব চিন্তিত থাকতেন। তাদের মুখ দেখে মনে হয়, তারা যেন অনেক কিছু বলতে চায়, কিন্তু ভয় পাচ্ছে। তারা রাতের পর রাত অফিসে কাজ করতেন। অফিসের কর্মীরা জানায়, মৃগেনবাবু সবসময় তাদের কাজের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। তিনি চাইতেন সবকিছু নিখুঁতভাবে হোক। কিন্তু গত কয়েক মাসে তিনি যেন কেমন উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। প্রায়ই তিনি অন্যমনস্ক থাকতেন এবং কাজে ভুল করতেন। অফিসের কর্মীরা প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো তিনি কোনো ব্যক্তিগত সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছে, এর পেছনে অন্য কিছু থাকতে পারে।
এমনকি তারা অফিসের পিয়ন রামলালের কাছ থেকে জানতে পারে, ঘটনার রাতে সে মৃগেনবাবুর ঘরে কিছু ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেয়েছিল। কিন্তু ভয়ে সে ঘরে ঢোকার সাহস পায়নি। রামলালের চোখমুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। রামলাল জানায়, সে খুব ভয় পেয়েছিল। শব্দগুলো শুনে তার মনে হয়েছিল, যেন কেউ কারোর জীবন নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে সাহস করে এগিয়ে যেতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল, যদি সে যায়, তাহলে হয়তো সেও বিপদে পড়বে।
সুব্রত রামলালের সাথে কথা বলে বিস্তারিত জানতে চায়। রামলাল জানায়, সে স্পষ্ট করে কিছু দেখেনি, তবে দুটো গলার স্বর শুনেছিল। একটা ছিল মৃগেনবাবুর, আর অন্যটা ছিল একজন অচেনা লোকের। কথাগুলো খুব স্পষ্ট ছিল না, তবে রামলাল বুঝতে পেরেছিল, তারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছিল। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল যেন তারা জীবন–মরণ কোনো সমস্যায় কথা বলছিল। রামলাল জানায়, সে জীবনে এত ভয়ঙ্কর কথা শোনেনি। কথাগুলো তার মনে এখনও গেঁথে আছে।
এই তথ্যটা সুব্রতর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার মনে হয়, মৃগেনবাবুর খুন হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই এই প্রোজেক্টের কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু কে সেই অচেনা লোক? আর কেনই বা সে মৃগেনবাবুকে খুন করল? তার মনে একটা প্রশ্ন জাগে, এই প্রোজেক্টের আড়ালে কি অন্য কোনো অবৈধ কাজ হচ্ছে? সুব্রত মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সে যে করেই হোক এই রহস্যের শেষ দেখে ছাড়বে।
সুব্রত অফিসের পুরনো নথিপত্র ঘাঁটতে শুরু করে। ফাইলের পর ফাইল দেখে যায়, কিন্তু কিছুই মেলে না। অফিসের নথিপত্রগুলো যেন এক একটা ধাঁধা, যা কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। সে জানতে পারে, এই প্রোজেক্টের সাথে কোম্পানির কয়েকজন বড় কর্মকর্তারও যোগ ছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর, রণেন সেন। রণেনবাবু সবসময় খুব শান্ত থাকতেন, তবে তার চোখের গভীরে কী যেন একটা রহস্য লুকিয়ে থাকত। তার শান্ত স্বভাবের আড়ালে একটা ঝড় লুকিয়ে থাকতে পারে, এমন একটা চিন্তা সুব্রতর মাথায় আসে।
সুব্রতর সন্দেহ গিয়ে পড়ে রণেনবাবুর ওপর। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। সে ঠিক করে, রণেনবাবুর ওপর নজর রাখবে। সে তার মনে মনে রণেনবাবুর দোষ প্রমাণ করার জন্য একটা ছক তৈরি করে। সুব্রত জানে, রণেনবাবু একজন ধূর্ত মানুষ। তাকে ফাঁদে ফেলতে গেলে খুব সাবধানে এগোতে হবে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion