Episode 42614 words2 views

রহস্যময় অন্তর্ধান: পর্ব ৪

রহস্যময় অন্তর্ধান: অন্তিম পর্ব   হিমালয়ের গভীরে শান্তি মঠ থেকে পাওয়া মানচিত্র এবং পাথরের টুকরো নিয়ে প্রবীর সেন ও অর্জুন দার্জিলিং শহরের দিকে ফিরে এলেন। তাদের মনে এখন আর কোনো দ্বিধা নেই, শুধু দৃঢ় সংকল্প। ডক্টর অমলকান্তি রায়কে উদ্ধার করতে এবং প্রাচীন পুঁথিটিকে ভুল হাতে পড়তে না দিতে হলে, তাদের ‘অন্ধকারের রক্ষক’দের গোপন আস্তানায় পৌঁছাতেই হবে, যত বিপদই আসুক না কেন, যত বাধা আসুক না কেন, তারা প্রস্তুত। ইনস্পেক্টর বিক্রম থাপাকে তারা মঠের সন্ন্যাসীর দেওয়া তথ্যের সারসংক্ষেপ জানালেন। বিক্রম থাপা প্রথমে কিছুটা সন্দিহান হলেও, প্রবীর সেনের দৃঢ়তা এবং তার হাতে থাকা প্রাচীন মানচিত্র ও পাথরের টুকরো দেখে তিনি বিশ্বাস করলেন। তার চোখে এক ধরনের বিস্ময় ছিল, যেন তিনি কোনো অলৌকিক ঘটনার কথা শুনছেন, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। “ইনস্পেক্টর সেন, এই ধরনের অভিযান খুব বিপজ্জনক হতে পারে। হিমালয়ের গভীরে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে পৌঁছানো অসম্ভব। আর ‘অন্ধকারের রক্ষক’রা যদি সত্যিই এত শক্তিশালী হয়, তাহলে আপনাদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে,” বিক্রম থাপা সতর্ক করলেন, তার কণ্ঠে উদ্বেগ, তার কপালে ভাঁজ পড়ল। “আমরা জানি, ইনস্পেক্টর থাপা। কিন্তু ডক্টর রায়কে উদ্ধার করা এবং মানবজাতিকে একটি সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা এই দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসতে পারি না, যত বিপদই আসুক না কেন, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব,” প্রবীর সেন দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, তার চোখে এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প, তার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা। বিক্রম থাপা তাদের জন্য একটি ছোট দল তৈরি করে দিলেন, যারা পাহাড়ী পথে অভিজ্ঞ এবং স্থানীয় পরিবেশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই দলে দুজন শেরপা এবং একজন অভিজ্ঞ গাইড ছিলেন, যারা বহুবার হিমালয়ের দুর্গম পথে অভিযান চালিয়েছেন, এবং যারা পাহাড়ের প্রতিটি কোণ চেনেন, তাদের জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। তাদের নাম ছিল লাকপা শেরপা এবং গুরং। তারা দুজনেই সাহসী এবং অভিজ্ঞ, এবং তারা এই অভিযানের জন্য প্রস্তুত। পরের দিন সকালে, সূর্য ওঠার আগেই প্রবীর সেনের দল হিমালয়ের গভীরে প্রবেশ করল। তাদের হাতে মঠের সন্ন্যাসীর দেওয়া প্রাচীন মানচিত্র। মানচিত্রটি দেখে মনে হচ্ছে, এটি কোনো আধুনিক মানচিত্র নয়, বরং প্রাচীনকালে তৈরি করা হয়েছে, তার কাগজটা পুরনো এবং তার কিনারাগুলো হলুদ হয়ে এসেছে। এতে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন এবং রেখা আঁকা, যা কেবল নির্দিষ্ট কিছু মানুষই বুঝতে পারে, এক ধরনের প্রাচীন কোড, এক গোপন ভাষা। পাহাড়ী পথ ছিল দুর্গম। ঘন জঙ্গল, খাড়া চড়াই-উতরাই, আর মাঝে মাঝে বরফের চাঁই। বাতাস ঠান্ডা এবং পাতলা, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন বরফের কণা। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক নতুন চ্যালেঞ্জ, প্রতিটি মোড়ে যেন নতুন বিপদ অপেক্ষা করছে, প্রতিটি বাঁকে যেন এক অজানা রহস্য। কিন্তু প্রবীর সেনের মনে কোনো ভয় ছিল না, শুধু দৃঢ় সংকল্প এবং ডক্টর রায়কে উদ্ধার করার অদম্য ইচ্ছা, এবং মানবজাতিকে রক্ষা করার সংকল্প, তার চোখে এক ধরনের আগুন। অর্জুন তার প্রযুক্তিগত জ্ঞান ব্যবহার করে জিপিএস এবং স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে মানচিত্রের সাথে পথ মেলাতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু প্রাচীন মানচিত্রের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল, যেন দুটি ভিন্ন জগতের মানচিত্র, যা একে অপরের সাথে মিলে না, এক জটিল ধাঁধা। “স্যার, এই মানচিত্রটা খুব অদ্ভুত। এটা কোনো প্রচলিত ভৌগোলিক মানচিত্র নয়। এর চিহ্নগুলো যেন কোনো প্রাচীন ভাষার অংশ,” অর্জুন বলল, তার চোখে কৌতূহল, তার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করছিল। “এটা হয়তো কোনো আধ্যাত্মিক মানচিত্র। সন্ন্যাসীরা হয়তো তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে পথ নির্দেশ করত, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব,” প্রবীর সেন বললেন, তিনি মানচিত্রের প্রতিটি চিহ্ন মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন, তার কপালে ভাঁজ পড়ল। পথ চলতে চলতে তারা কিছু অদ্ভুত পাথরের কাঠামো দেখতে পেলেন, যা প্রাকৃতিক নয়, বরং মানুষের তৈরি বলে মনে হচ্ছে। এই কাঠামোতে সেই অদ্ভুত চিহ্নটি আঁকা, যা প্রবীর সেন ডক্টর রায়ের ব্রিফকেস থেকে পেয়েছিলেন। চিহ্নগুলো যেন তাদের পথ দেখাচ্ছিল, এক অজানা গন্তব্যের দিকে, এক রহস্যময় পথের ইঙ্গিত, এক গোপন বার্তা। “এই চিহ্নগুলোই আমাদের পথ দেখাচ্ছে,” প্রবীর সেন বললেন, তার মনে এক ধরনের নিশ্চিতি, যেন তিনি সঠিক পথেই আছেন। দলটি ধীরে ধীরে হিমালয়ের গভীরে প্রবেশ করতে লাগল। পরিবেশটা আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। মাঝে মাঝে তারা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন, যা কোনো বন্যপ্রাণীর নয়, বরং অন্য কিছুর, যেন কোনো প্রাচীন আত্মা তাদের অনুসরণ করছে, বা কোনো অশুভ শক্তি তাদের ঘিরে ফেলছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, যেন কোনো অশুভ শক্তি তাদের ঘিরে ফেলছে, এক ধরনের চাপা ভয়, এক অজানা আতঙ্ক। একসময় তারা একটি গোপন গুহার সামনে পৌঁছালেন। গুহার প্রবেশপথটি পাথরের চাঁই দিয়ে ঢাকা, তার উপর শ্যাওলা জমেছে, যেন এটি বহু বছর ধরে লুকানো ছিল, এবং কেউ এর অস্তিত্ব জানত না। গুহার মুখে সেই অদ্ভুত চিহ্নটি আঁকা, যা তাদের পথ দেখিয়েছিল। “এই গুহাটাই হয়তো তাদের আস্তানা,” প্রবীর সেন ফিসফিস করে বললেন, তার কণ্ঠে এক ধরনের উত্তেজনা এবং ভয়, তার হাত কাঁপছিল। তারা সাবধানে গুহার ভেতরে প্রবেশ করলেন। গুহার ভেতরটা অন্ধকার এবং ঠান্ডা। বাতাস ভারী এবং এক ধরনের অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসছিল, যেন পুরনো মাটি আর কোনো অজানা ভেষজের গন্ধ, যা তাদের শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিল। গুহার দেওয়ালগুলোতে প্রাচীন চিত্র এবং চিহ্ন আঁকা, যা দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, যা হাজার বছর ধরে লুকিয়ে ছিল, এক অজানা ইতিহাস। তারা গুহার গভীরে প্রবেশ করতে লাগলেন। গুহার পথ ছিল আঁকাবাঁকা এবং সংকীর্ণ। মাঝে মাঝে তারা কিছু অদ্ভুত মূর্তি দেখতে পেলেন, যা কোনো পরিচিত দেব-দেবী নয়, বরং অন্য কোনো প্রাচীন সত্তার, তাদের চোখগুলো যেন অন্ধকারে জ্বলছিল, এক ধরনের অশুভ শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। একসময় তারা গুহার একটি বড় কক্ষে পৌঁছালেন। কক্ষটি বিশাল এবং তার মাঝখানে একটি প্রাচীন বেদি। বেদির উপর একটি উজ্জ্বল পাথর রাখা আছে, যা থেকে এক ধরনের অদ্ভুত আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, যা গুহার অন্ধকারকে আলোকিত করছে, এক ধরনের রহস্যময় আলো, এক মহাজাগতিক শক্তি। কক্ষের চারপাশে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরনে কালো পোশাক এবং মুখে মুখোশ, যা তাদের পরিচয় গোপন করে রেখেছে। তারা ‘অন্ধকারের রক্ষক’ বলে মনে হচ্ছে। তাদের মাঝখানে ডক্টর অমলকান্তি রায়কে দেখা যাচ্ছে। তিনি একটি পাথরের উপর বসে আছেন, তার চোখ বন্ধ এবং তিনি দুর্বল দেখাচ্ছেন, যেন তার সমস্ত শক্তি শুষে নেওয়া হয়েছে, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তার পাশে একটি প্রাচীন পুঁথি রাখা আছে, যা থেকে এক ধরনের অদ্ভুত শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে, যা গুহার বাতাসকে ভারী করে তুলেছে, এক ধরনের চাপা উত্তেজনা, এক অজানা শক্তি। রাহুল সেনকেও সেখানে দেখা গেল। তার মুখে এক ধরনের উন্মাদনা এবং তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন সে কোনো ভয়ানক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখে এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প, এক ধরনের অন্ধকার শক্তি, এক অশুভ দীপ্তি। “রাহুল!” প্রবীর সেন চিৎকার করে উঠলেন, তার কণ্ঠে এক ধরনের অবিশ্বাস এবং যন্ত্রণা। রাহুল সেন প্রবীর সেনের দিকে তাকাল। তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল, যা ভয়ানক। “ইনস্পেক্টর সেন। আপনি এখানে কেন এসেছেন? এই জ্ঞান আপনার জন্য নয়। এটা শুধু নির্বাচিতদের জন্য। আপনি এর ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আপনি এখানে এসে ভুল করেছেন।” “ডক্টর রায়কে ছেড়ে দাও, রাহুল। এই পুঁথিটি খুব বিপজ্জনক। তুমি এর ক্ষমতা সম্পর্কে জানো না। এটা মানবজাতির জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে।” “আমি জানি, ইনস্পেক্টর। এই পুঁথিটিই মানবজাতির ভবিষ্যৎ। আমরা এই জ্ঞান ব্যবহার করে একটি নতুন বিশ্ব তৈরি করব, যেখানে দুর্বলদের কোনো স্থান থাকবে না, যেখানে শুধু শক্তিশালীরাই রাজত্ব করবে, যেখানে আমি হব শাসক।” রাহুল সেনের কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা, যা প্রবীর সেনকে অবাক করল, তার কণ্ঠস্বর যেন কোনো অজানা শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এক অশুভ শক্তি। ‘অন্ধকারের রক্ষক’রা তাদের দিকে এগিয়ে এল। তাদের হাতে প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র, যা দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। তাদের চোখগুলো মুখোশের আড়াল থেকে জ্বলছিল, এক ধরনের অশুভ শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সতর্ক। “তোমাদের আর এক পাও এগোতে দেবো না,” প্রবীর সেন বললেন, তার হাতে মঠের সন্ন্যাসীর দেওয়া পাথরটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তার শরীর থেকে এক ধরনের শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, এক ধরনের সুরক্ষা বলয়। যুদ্ধ শুরু হলো। প্রবীর সেনের দল এবং ‘অন্ধকারের রক্ষক’দের মধ্যে তীব্র লড়াই। গুহার ভেতরে অস্ত্রের ঝনঝনানি আর চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। প্রবীর সেন তার অভিজ্ঞতা এবং সাহস দিয়ে লড়াই করছেন, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল নির্ভুল, তার চোখে এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প। অর্জুন তার প্রযুক্তিগত জ্ঞান ব্যবহার করে শত্রুদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, তার হাতে থাকা ছোট ডিভাইস থেকে এক ধরনের শব্দ বের হচ্ছিল, যা শত্রুদের বিভ্রান্ত করছিল, তাদের মনোযোগ নষ্ট করছিল। প্রবীর সেন রাহুল সেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। রাহুল পুঁথিটির দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন তার ক্ষমতা শোষণ করছে, তার শরীর থেকে এক ধরনের শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, তার মুখ থেকে এক ধরনের আলো বের হচ্ছিল, তার চোখ বন্ধ ছিল। “রাহুল, থামো! এই পথ ধ্বংসের পথ!” প্রবীর সেন চিৎকার করলেন, তার কণ্ঠে এক ধরনের আকুতি, এক ধরনের যন্ত্রণা। রাহুল সেন প্রবীর সেনের দিকে তাকাল। তার চোখে এক ধরনের উন্মাদনা। সে তার হাত তুলল, এবং প্রবীর সেন অনুভব করলেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তার শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, তার চোখে অন্ধকার নেমে আসছিল। ‘অন্ধকারের রক্ষক’রা তাদের ঘিরে ফেলল। প্রবীর সেন বুঝতে পারছিলেন, তাদের পরাজয় আসন্ন, তাদের সামনে আর কোনো পথ নেই, তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে। হঠাৎই, মঠের সন্ন্যাসীর দেওয়া পাথরের টুকরোটি প্রবীর সেনের হাতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পাথরটি থেকে এক ধরনের অদ্ভুত শক্তি বিচ্ছুরিত হতে লাগল, যা ‘অন্ধকারের রক্ষক’দের শক্তিকে প্রতিহত করতে লাগল, যেন এটি এক ধরনের ঢাল, যা তাদের রক্ষা করছে, এক অদৃশ্য সুরক্ষা। ‘অন্ধকারের রক্ষক’রা পিছু হটতে লাগল। তাদের মুখে এক ধরনের ভয় ফুটে উঠল, যেন তারা কোনো অজানা শক্তির মুখোমুখি হয়েছে, যা তাদের কল্পনার বাইরে, এক মহাজাগতিক শক্তি। প্রবীর সেন উঠে দাঁড়ালেন। তিনি পাথরটি হাতে নিয়ে রাহুল সেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার মনে এক নতুন সংকল্প, এক অদম্য সাহস। “রাহুল, এই শক্তি তোমার জন্য নয়। এটা মানবজাতির জন্য ধ্বংসাত্মক। তুমি ভুল করছো,” প্রবীর সেন বললেন, তার কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা এবং সহানুভূতি, তার চোখ রাহুলের চোখে। রাহুল সেন পাথরটির দিকে তাকাল। তার চোখে এক ধরনের যন্ত্রণা ফুটে উঠল। সে যেন দুই শক্তির মধ্যে আটকে পড়েছে, একপাশে প্রাচীন জ্ঞান আর অন্যপাশে মানবতা। তার শরীর কাঁপছিল, তার মুখ থেকে এক ধরনের আর্তনাদ বের হচ্ছিল। প্রবীর সেন পাথরটি পুঁথিটির দিকে ছুড়ে দিলেন। পাথরটি পুঁথিটির উপর পড়তেই এক ধরনের তীব্র আলো বিচ্ছুরিত হলো, যা গুহার অন্ধকারকে আলোকিত করে দিল, এক ধরনের মহাজাগতিক আলো। পুঁথিটি থেকে এক ধরনের অদ্ভুত শব্দ বের হতে লাগল, যা গুহার ভেতরে প্রতিধ্বনিত হলো, যেন প্রাচীন কোনো আত্মা চিৎকার করছে, বা কোনো শক্তি বিলীন হচ্ছে, এক মহাজাগতিক ধ্বনি। পুঁথিটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে লাগল। তার শক্তি যেন বাতাসে মিশে যাচ্ছে, তার অস্তিত্ব যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তার প্রতিটি অক্ষর যেন বাতাসে মিশে যাচ্ছে, এক চিরন্তন নীরবতায়। রাহুল সেন চিৎকার করে উঠল। তার শরীর কাঁপতে লাগল। সে মাটিতে পড়ে গেল, তার মুখ থেকে এক ধরনের ধোঁয়া বের হচ্ছিল, যেন তার শরীর থেকে শক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে। সে যেন তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, এবং সে এক নতুন মানুষে পরিণত হচ্ছে, এক নতুন জীবন। ‘অন্ধকারের রক্ষক’রা আতঙ্কিত হয়ে গুহা থেকে পালিয়ে গেল। তাদের চোখে ভয়, যেন তারা তাদের শেষ আশা হারিয়েছে, তাদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে, তাদের ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে। প্রবীর সেন দ্রুত ডক্টর অমলকান্তি রায়ের কাছে গেলেন। তিনি তাকে পরীক্ষা করে দেখলেন। ডক্টর রায় দুর্বল হলেও সুস্থ আছেন, তার চোখে এক ধরনের স্বস্তি, তার মুখে এক ধরনের হাসি। “পুঁথিটি কোথায়?” ডক্টর রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, তার কণ্ঠে দুর্বলতা। “এটি অদৃশ্য হয়ে গেছে, ডক্টর রায়। এর শক্তি আর কারো হাতে পড়বে না,” প্রবীর সেন বললেন, তার মুখে এক ধরনের বিজয়ীর হাসি, তার চোখে এক ধরনের শান্তি। ডক্টর রায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। “ভালো হয়েছে। এই জ্ঞান মানবজাতির জন্য নয়। এটা শুধু ধ্বংসই নিয়ে আসত। আপনি আমাদের রক্ষা করেছেন, মানবজাতিকে রক্ষা করেছেন।” অর্জুন রাহুল সেনের কাছে গেল। রাহুল সেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার মুখে এক ধরনের শান্তি ফুটে উঠেছে, যেন সে এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। প্রবীর সেন এবং অর্জুন ডক্টর রায়কে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন। তাদের দল তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের চোখে এক ধরনের স্বস্তি এবং বিজয়, যেন তারা এক বিশাল যুদ্ধ জিতে ফিরেছে, এক কঠিন চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এসেছে। সূর্য তখন পাহাড়ের উপর উঠছে। তার সোনালী আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠেছে। প্রবীর সেন অনুভব করলেন, তারা একটি বড় বিপদ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করেছেন, এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিতেছেন, এবং তারা সফল হয়েছেন, তাদের মিশন সম্পূর্ণ হয়েছে। তারা দার্জিলিংয়ে ফিরে এলেন। ডক্টর রায়কে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন, তার মুখে এক ধরনের প্রশান্তি, তার চোখে এক ধরনের নতুন জীবন, এক নতুন শুরু। রাহুল সেনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হলো। সে যখন সুস্থ হলো, তখন তার মনে কোনো উন্মাদনা ছিল না। সে যেন এক নতুন মানুষে পরিণত হয়েছে। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে, এবং সে তার অতীত কাজের জন্য অনুতপ্ত। প্রবীর সেন রাহুল সেনের সাথে কথা বললেন। রাহুল তাকে ‘অন্ধকারের রক্ষক’দের সম্পর্কে বিস্তারিত জানাল। তারা একটি প্রাচীন গোষ্ঠী, যারা হাজার হাজার বছর ধরে প্রাচীন জ্ঞান রক্ষা করে আসছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু লোক এই জ্ঞানকে ক্ষমতা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল, এবং রাহুল তাদের ফাঁদে পড়েছিল, ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়েছিল, কিন্তু এখন সে মুক্ত। “গুরুজি কে?” প্রবীর সেন জিজ্ঞাসা করলেন। “গুরুজি কোনো ব্যক্তি নয়, ইনস্পেক্টর। গুরুজি হলো সেই জ্ঞান, যা আমরা হাজার বছর ধরে রক্ষা করে আসছি। আমি ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম, ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি,” রাহুল বলল, তার চোখে অনুশোচনা, তার কণ্ঠে এক ধরনের শান্তি। প্রবীর সেন বুঝতে পারলেন, এই রহস্যের সমাধান হয়েছে। প্রাচীন পুঁথিটি অদৃশ্য হয়ে গেছে, ‘অন্ধকারের রক্ষক’রা পালিয়ে গেছে, এবং রাহুল সেন তার ভুল বুঝতে পেরেছে। ডক্টর অমলকান্তি রায় সুস্থ হয়ে উঠলে, তিনি প্রবীর সেনকে ধন্যবাদ জানালেন। “আপনি শুধু আমার জীবন বাঁচাননি, বরং মানবজাতিকে একটি বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আপনার সাহস এবং বুদ্ধিমত্তা অতুলনীয়। আপনি একজন সত্যিকারের নায়ক, একজন রক্ষক।” প্রবীর সেন হাসলেন। “এটা আমার দায়িত্ব ছিল, ডক্টর রায়। কিন্তু আপনার জ্ঞান ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। আমরা সবাই মিলে এটা করেছি।” এই ঘটনার পর প্রবীর সেনের জীবন বদলে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, পৃথিবীতে এমন অনেক রহস্য আছে, যা আমাদের কল্পনারও অতীত। তিনি এই রহস্যগুলো উন্মোচন করার জন্য আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন। তার কাছে এখন প্রতিটি কেস শুধু অপরাধ নয়, বরং এক নতুন রহস্যের দ্বার, এক নতুন অভিযান, এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ডক্টর অমলকান্তি রায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার পর, প্রবীর সেন এবং অর্জুন তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেন। কিন্তু হিমালয়ের সেই অভিজ্ঞতা তাদের মনে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল। তারা বুঝতে পারছিলেন, পৃথিবীটা যতটা সাধারণ মনে হয়, তার চেয়েও অনেক বেশি রহস্যময়, এবং এমন অনেক শক্তি আছে যা মানুষের পরিচিত জগতের বাইরে, যা তাদের পরিচিত বিজ্ঞানকেও চ্যালেঞ্জ করে, এক মহাজাগতিক রহস্য। রাহুল সেনের বিচার হলো। তার অতীত ভুল এবং ‘অন্ধকারের রক্ষক’দের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে, তাকে তুলনামূলকভাবে কম শাস্তি দেওয়া হলো। সে এখন একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আছে, যেখানে সে তার জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সে প্রবীর সেনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে এবং তাকে প্রাচীন জ্ঞান সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য দেয়, যা প্রবীর সেনের পরবর্তী তদন্তে সাহায্য করে। রাহুল এখন তার জ্ঞানকে মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহার করতে চায়, তার অতীত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, এবং সে একজন ভালো মানুষে পরিণত হচ্ছে। ডক্টর অমলকান্তি রায় তার গবেষণা আবার শুরু করলেন, কিন্তু এবার তিনি আরও সতর্ক। তিনি এখন প্রাচীন জ্ঞানকে মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহার করতে চান, ক্ষমতার জন্য নয়। তিনি প্রবীর সেনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এবং তাকে নতুন নতুন রহস্যের ইঙ্গিত দেন, যা প্রবীর সেনের কৌতূহল বাড়িয়ে তোলে, এবং তাকে নতুন অভিযানের জন্য প্রস্তুত করে, এক নতুন দিগন্তের দিকে। একদিন, প্রবীর সেন তার অফিসে বসেছিলেন। অর্জুন একটি নতুন কেস ফাইল নিয়ে তার সামনে এল। ফাইলটি খুলতেই প্রবীর সেনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ফাইলটিতে একটি অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা, যা তিনি আগে কখনো দেখেননি, কিন্তু তার মনে এক ধরনের পরিচিতি অনুভব করলেন, যেন এই চিহ্নটি তাকে কিছু বলতে চাইছে, এক গোপন বার্তা বহন করছে। “স্যার, এটি একটি নতুন কেস। একটি প্রাচীন মন্দিরে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে, সেখানে কোনো অশুভ শক্তি কাজ করছে। মন্দিরের আশেপাশে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, যা আমাদের পরিচিত নয়, এবং সেগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্রাচীন প্রতীক,” অর্জুন বলল, তার চোখে এক ধরনের উত্তেজনা, তার কণ্ঠস্বরে কৌতূহল। প্রবীর সেন হাসলেন। তার মনে হলো, এটি তাদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। “মনে হচ্ছে, আমাদের নতুন অভিযান শুরু হতে চলেছে, অর্জুন। এই পৃথিবীটা রহস্যে ভরা, এবং আমরা সেই রহস্যগুলো উন্মোচন করার জন্য প্রস্তুত। এই যুদ্ধটা শেষ হয়নি, এটা কেবল শুরু।” অর্জুনও হাসল। তারা দুজনেই জানত, তাদের সামনে আরও অনেক রহস্য অপেক্ষা করছে। এই পৃথিবীটা রহস্যে ভরা, এবং তারা সেই রহস্যগুলো উন্মোচন করার জন্য প্রস্তুত। তাদের প্রতিটি অভিযানই তাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করবে, এবং তাদের জ্ঞানকে বাড়িয়ে তুলবে, তাদের জীবনকে নতুন অর্থ দেবে। প্রবীর সেন তার ডায়েরি খুললেন। তার প্রথম পাতায় লেখা: ‘রহস্যময় অন্তর্ধান – একটি শুরু মাত্র।’ তিনি জানতেন, এটি কেবল একটি গল্পের শেষ নয়, বরং এক নতুন দিগন্তের সূচনা। মানবজাতির ইতিহাসে এমন অনেক অধ্যায় আছে, যা এখনো অনাবিষ্কৃত। প্রবীর সেন এবং অর্জুন সেই অধ্যায়গুলো উন্মোচন করার জন্য প্রস্তুত। তাদের যাত্রা সবে শুরু হয়েছে, এবং তারা জানে না তাদের সামনে কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু তারা প্রস্তুত, কারণ তারা জানে তাদের দায়িত্ব অনেক বড়, এবং তারা মানবজাতির রক্ষক। এই উপন্যাসের সমাপ্তি এখানেই।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion