রহস্যময় অন্তর্ধান: পর্ব ৩
শৈলশৃঙ্গের আহ্বান
রাহুল সেনের ডায়েরি প্রবীর সেনের হাতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় প্রাচীন জ্ঞান, গুপ্ত রহস্য এবং এক অজানা শক্তির প্রতি রাহুলের তীব্র আকর্ষণ স্পষ্ট। ‘শৈলশৃঙ্গ, যেখানে সূর্য প্রথম কিরণ দেয়’ – এই বাক্যটি প্রবীর সেনের মনে গভীর ছাপ ফেলল। এটি কেবল একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, বরং এক প্রতীকী অর্থও বহন করছে, যা এক নতুন শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে, এক নতুন রহস্যের উন্মোচন, এক অজানা সত্যের দিকে যাত্রা, এক আধ্যাত্মিক পথ।
পরের দিন সকালে, প্রবীর সেন অর্জুনকে নিয়ে একটি বিশেষ দলের সাথে বৈঠক করলেন। এই দলে সাইবার বিশেষজ্ঞ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং একজন ভাষাবিদও ছিলেন। ভাষাবিদ ডক্টর সুজাতা মিত্র, প্রাচীন ভাষা এবং লিপিতে পারদর্শী, তার জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভাষা বিভাগের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক, যিনি বহু প্রাচীন পুঁথি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার চোখে এক ধরনের গভীরতা ছিল, যা তার জ্ঞানকে প্রতিফলিত করত, তার মুখ ছিল শান্ত এবং আত্মবিশ্বাসী।
“ডক্টর মিত্র, এই সাংকেতিক ভাষাটা কি আপনি চিনতে পারছেন?” প্রবীর সেন রাহুল সেনের ডায়েরির কিছু পাতা ডক্টর সুজাতার হাতে দিলেন। পাতাগুলো পুরনো, তার কিনারাগুলো হলুদ হয়ে এসেছে, কিন্তু চিহ্নগুলো স্পষ্ট, যেন বহু বছর ধরে কেউ এগুলো স্পর্শ করেনি, এক প্রাচীন রহস্যের ইঙ্গিত।
ডক্টর সুজাতা মনোযোগ দিয়ে পাতাগুলো দেখলেন। তাঁর চোখে এক ধরনের কৌতূহল ফুটে উঠল, যেন তিনি কোনো প্রাচীন ধাঁধার সমাধান করতে চলেছেন, তার ঠোঁটে এক ধরনের মৃদু হাসি। “ইনস্পেক্টর, এটা কোনো প্রচলিত ভাষা নয়। তবে এর কিছু চিহ্ন প্রাচীন তিব্বতি এবং প্রোটো-বাংলা লিপির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মনে হচ্ছে, এটা কোনো মিশ্র ভাষা, যা হয়তো কোনো গোপন গোষ্ঠী তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করত, যা বাইরের কারো পক্ষে বোঝা অসম্ভব, এক ধরনের গোপন কোড, এক প্রাচীন রহস্য।”
“এর কোনো অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব?” প্রবীর সেনের কণ্ঠে এক ধরনের আশা, যেন তিনি জানেন ডক্টর সুজাতা পারবেন।
“আমি চেষ্টা করতে পারি। তবে এর জন্য সময় লাগবে। এই ধরনের ভাষা বিশ্লেষণ করা খুব জটিল কাজ, কারণ এর প্রতিটি চিহ্ন, প্রতিটি প্রতীক আলাদা অর্থ বহন করে। আমাকে প্রতিটি চিহ্ন আলাদা করে বিশ্লেষণ করতে হবে, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি বিন্দুর অর্থ খুঁজে বের করতে হবে, প্রতিটি কোণ থেকে।”
“আপনার কাছে কি কোনো তথ্য আছে, যা এই ‘শৈলশৃঙ্গ’ বা ‘গুরুজি’ সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারে?”
ডক্টর সুজাতা কিছুক্ষণ ভাবলেন, তার চোখ যেন কোনো দূর অতীতের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার কপালে ভাঁজ পড়ল। “হিমালয়ের পাদদেশে এমন অনেক গোপন মঠ বা আশ্রম আছে, যেখানে প্রাচীন জ্ঞান চর্চা করা হয়। কিছু কিছু গোষ্ঠী নিজেদেরকে ‘জ্ঞান রক্ষক’ বলে দাবি করে। তাদের মধ্যে একজন ‘গুরুজি’ থাকতে পারেন, যিনি তাদের প্রধান, এবং যিনি এই প্রাচীন জ্ঞানকে রক্ষা করেন, বা হয়তো তার অপব্যবহার করেন, তার উদ্দেশ্য রহস্যময়।”
“তারা কি কোনোভাবে ডক্টর রায়ের পুঁথি বা রাহুল সেনের সাথে জড়িত থাকতে পারে?”
“সম্ভব। যদি পুঁথিটি সত্যিই প্রাচীন জ্ঞান ধারণ করে, তাহলে এই গোষ্ঠীগুলো তার প্রতি আগ্রহী হতে পারে। তারা হয়তো পুঁথিটি নিজেদের হেফাজতে রাখতে চাইছে, যাতে তা ভুল হাতে না পড়ে, অথবা তারা এর ক্ষমতা নিজেদের জন্য ব্যবহার করতে চাইছে, যা মানবজাতির জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, এক মহাজাগতিক বিপদ।” ডক্টর সুজাতার কথায় এক ধরনের সতর্কতা ছিল, যেন তিনি কোনো বিপদ সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে গেল।
প্রবীর সেনের মনে হলো, এই রহস্য আরও জটিল হচ্ছে। এটি কেবল অপহরণ নয়, বরং এক প্রাচীন জ্ঞানের লড়াই, যা মানবজাতির ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারে, তাদের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, মহাবিশ্বের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
অর্জুন তার সাইবার দক্ষতা ব্যবহার করে রাহুল সেনের পুরনো ইমেল এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। সে দেখল, রাহুল কিছু অনলাইন ফোরামে সক্রিয় ছিল, যেখানে প্রাচীন রহস্য এবং আধ্যাত্মিক শক্তি নিয়ে আলোচনা করা হতো। এই ফোরামগুলোতে ‘গুরুজি’ নামে একজন ব্যক্তি প্রায়ই পোস্ট করতেন, যিনি গভীর জ্ঞান এবং রহস্যময় ইঙ্গিত দিতেন, তার প্রতিটি পোস্টই ছিল এক ধরনের ধাঁধা, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন।
অর্জুন ‘গুরুজি’র পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করতে লাগল। তার প্রতিটি পোস্টেই যেন এক ধরনের দার্শনিক গভীরতা ছিল, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। কিন্তু কিছু কিছু পোস্টে ‘শৈলশৃঙ্গ’ এবং ‘প্রাচীন ক্ষমতা’ সম্পর্কে ইঙ্গিত ছিল, যা রাহুলের ডায়েরির সাথে মিলে যাচ্ছিল, যেন দুটি ভিন্ন সূত্র একই দিকে ইঙ্গিত করছে, এক অজানা সত্যের দিকে।
“স্যার, এই গুরুজি একজন রহস্যময় ব্যক্তি। তার কোনো ব্যক্তিগত তথ্য নেই। সে শুধু তার জ্ঞান এবং দর্শন দিয়ে ফোরামে প্রভাব বিস্তার করত, তার প্রতিটি পোস্টই ছিল এক ধরনের মন্ত্রের মতো, যা মানুষকে আকর্ষণ করত, এবং তাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করত,” অর্জুন বলল, তার চোখে হতাশা, কারণ সে তার পরিচয় খুঁজে পাচ্ছিল না।
“তার কোনো ছবি বা ভিডিও আছে?”
“না স্যার। সে সবসময় বেনামে পোস্ট করত। তবে তার লেখার ধরণ এবং কিছু বিশেষ শব্দ ব্যবহার থেকে মনে হচ্ছে, সে একজন শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি, হয়তো কোনো প্রাচীন বিদ্যার অধিকারী, বা কোনো গোপন সংস্থার প্রধান, যার ক্ষমতা অসীম।”
প্রবীর সেনের মনে হলো, এই ‘গুরুজি’ই হয়তো এই রহস্যের মূল হোতা। তাকে খুঁজে বের করাটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সে হয়তো ডক্টর রায় এবং পুঁথির খোঁজ দিতে পারে, এবং এই ষড়যন্ত্রের মূল উন্মোচন করতে পারে, এক বিশাল রহস্যের সমাধান।
ডক্টর সুজাতা মিত্র কয়েক ঘণ্টা পর আবার প্রবীর সেনকে ডাকলেন। তার মুখে এক ধরনের উত্তেজনা ছিল, তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। “ইনস্পেক্টর, আমি ডায়েরির কিছু অংশের অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছি। রাহুল লিখেছিল, ‘শৈলশৃঙ্গ, যেখানে সূর্য প্রথম কিরণ দেয়, সেখানে প্রাচীন জ্ঞান লুকিয়ে আছে। গুরুজি আমাকে সেই পথে নিয়ে যাবেন। পুঁথিটি সেই জ্ঞানের চাবিকাঠি। কিন্তু বিপদ অপেক্ষা করছে। অন্ধকার শক্তি আমাকে অনুসরণ করছে। তারা চায় আমি তাদের সাথে যোগ দিই, কিন্তু আমি জানি তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। তারা মানবজাতির জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে।’ ”
“বিপদ? কী ধরনের বিপদ?” প্রবীর সেনের মনে নতুন প্রশ্ন জাগল, এক অজানা ভয়ের ইঙ্গিত, এক মহাজাগতিক বিপদ।
“সে বিস্তারিত কিছু লেখেনি। তবে মনে হচ্ছে, এই জ্ঞানের পেছনে এমন কিছু শক্তি আছে, যারা তা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। রাহুল তাদের সম্পর্কে সতর্ক ছিল, এবং সে তাদের ভয় পেত, কারণ তারা খুব শক্তিশালী, এবং তারা অদৃশ্যভাবে কাজ করে।”
প্রবীর সেনের মনে হলো, রাহুল সেন হয়তো এই গোপন গোষ্ঠীর সাথে জড়িত ছিল, কিন্তু কোনো কারণে তাদের সাথে তার মতবিরোধ হয়েছিল, অথবা সে তাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিল এবং তাদের থেকে পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি, সে আটকা পড়েছিল।
“ডক্টর মিত্র, এই ‘শৈলশৃঙ্গ’ সম্পর্কে আর কোনো তথ্য আছে?”
“প্রাচীন তিব্বতি এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রে এমন কিছু শৈলশৃঙ্গের উল্লেখ আছে, যেখানে আধ্যাত্মিক শক্তি এবং গোপন জ্ঞান লুকিয়ে আছে বলে বিশ্বাস করা হয়। এর মধ্যে কিছু দার্জিলিং এবং সিকিমের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে পৌঁছানো অসম্ভব, এবং যেখানে খুব কম মানুষ যায়, এক রহস্যময় স্থান।”
প্রবীর সেন সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের দার্জিলিং যেতে হবে। সেই শৈলশৃঙ্গই হয়তো ডক্টর রায় এবং পুঁথির খোঁজ দিতে পারে, এবং এই রহস্যের সমাধান করতে পারে, এক অজানা সত্যের উন্মোচন।
“অর্জুন, দার্জিলিং ভ্রমণের প্রস্তুতি নাও। আমরা কাল সকালেই রওনা দেবো। এই কেসটা আর দেরি করা যাবে না, প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান,” প্রবীর সেন নির্দেশ দিলেন, তার কণ্ঠে দৃঢ়তা, তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অর্জুন কিছুটা অবাক হলো। “স্যার, আমরা কি কোনো ব্যাকআপ ছাড়া যাবো? পাহাড়ী অঞ্চলে একা যাওয়া খুব বিপজ্জনক, বিশেষ করে যখন আমরা জানি সেখানে শক্তিশালী শত্রুরা আছে, যারা অদৃশ্যভাবে কাজ করে।”
“না। আমরা স্থানীয় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করব। কিন্তু এই কেসটা খুব সংবেদনশীল। আমরা চাই না, এর খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়ুক, কারণ এর সাথে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত রয়েছে, যা সারা বিশ্বকে প্রভাবিত করতে পারে।”
প্রবীর সেন জানতেন, দার্জিলিংয়ের এই যাত্রা বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু তাদের আর কোনো উপায় ছিল না। ডক্টর রায়কে খুঁজে বের করতে হলে, তাদের এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতেই হবে, যত বিপদই আসুক না কেন, যত অন্ধকারই তাদের গ্রাস করতে চাক না কেন, তারা প্রস্তুত।
পরের দিন সকালে, প্রবীর সেন এবং অর্জুন দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কলকাতার কোলাহল ছেড়ে তারা পাহাড়ের নিস্তব্ধতার দিকে এগিয়ে চলেছেন। তাদের মনে এক অজানা উত্তেজনা এবং ভয় কাজ করছিল, প্রতিটি মোড়ে যেন নতুন বিপদ অপেক্ষা করছে, প্রতিটি বাঁকে যেন নতুন রহস্য, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন এক অজানা বার্তা।
দার্জিলিং পৌঁছে তারা স্থানীয় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলেন। ইনস্পেক্টর বিক্রম থাপা, একজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার, তাদের স্বাগত জানালেন। বিক্রম থাপা একজন স্থানীয় মানুষ, যিনি পাহাড়ী অঞ্চল সম্পর্কে খুব ভালো জানেন, তার চোখে এক ধরনের প্রজ্ঞা, তার মুখ শান্ত এবং আত্মবিশ্বাসী।
“ইনস্পেক্টর সেন, আপনারা কী ধরনের সাহায্য চান?” বিক্রম থাপা জিজ্ঞাসা করলেন, তার মুখে এক ধরনের কৌতূহল।
প্রביר সেন তাকে ডক্টর রায়ের অপহরণ এবং রাহুল সেনের ডায়েরির কথা সংক্ষেপে বললেন। তিনি বিশেষ করে ‘শৈলশৃঙ্গ, যেখানে সূর্য প্রথম কিরণ দেয়’ এবং ‘গুরুজি’ সম্পর্কে তথ্য চাইলেন। তিনি তাকে সেই অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা কাগজটিও দেখালেন।
বিক্রম থাপা কিছুক্ষণ ভাবলেন। তার কপালে ভাঁজ পড়ল। “শৈলশৃঙ্গ? দার্জিলিংয়ে এমন অনেক শৈলশৃঙ্গ আছে। তবে ‘যেখানে সূর্য প্রথম কিরণ দেয়’ – এটা সম্ভবত টাইগার হিল। টাইগার হিল সূর্যোদয়ের জন্য বিখ্যাত, প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সেখানে সূর্যোদয় দেখতে যায়, কিন্তু এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য থাকতে পারে, এক প্রাচীন রহস্য।”
“টাইগার হিল? সেখানে কি কোনো প্রাচীন মঠ বা গোপন স্থান আছে?”
“টাইগার হিলের কাছে একটি পুরনো বৌদ্ধ মঠ আছে, যা খুব কম মানুষ জানে। এটি ‘শান্তি মঠ’ নামে পরিচিত। সেখানে কিছু সন্ন্যাসী থাকেন, যারা প্রাচীন জ্ঞান চর্চা করেন। কিন্তু তারা খুব গোপনীয়তা বজায় রাখেন, বাইরের কারো সাথে সহজে যোগাযোগ করেন না, তাদের জীবনযাপন খুব সাধারণ, এবং তারা খুব শান্ত।” বিক্রম থাপার কণ্ঠে এক ধরনের রহস্য, যেন তিনি নিজেও সবকিছু জানেন না।
প্রবীর সেনের মনে হলো, তারা সঠিক পথেই আছেন। শান্তি মঠ এবং তার সন্ন্যাসীরা হয়তো এই রহস্যের সমাধান করতে পারে, এবং তাদের পথ দেখাতে পারে, এক অজানা সত্যের দিকে।
“আমরা কি সেই মঠের সাথে যোগাযোগ করতে পারি?” অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
“সেটা খুব কঠিন। তারা বাইরের কারো সাথে সহজে যোগাযোগ করেন না। তবে আমি চেষ্টা করতে পারি। তাদের একজন প্রধান আছেন, যিনি খুব জ্ঞানী ব্যক্তি, এবং যিনি এই মঠের সব রহস্য জানেন, তার জ্ঞান অসীম।” বিক্রম থাপা বললেন।
প্রবীর সেন এবং অর্জুন টাইগার হিলের দিকে রওনা দিলেন। তাদের মনে এক অজানা উত্তেজনা কাজ করছিল। পাহাড়ী পথ ধরে তারা এগিয়ে চলেছেন, চারপাশে ঘন জঙ্গল আর কুয়াশা। পরিবেশটা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাথর যেন কোনো গোপন কথা লুকিয়ে রেখেছে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন এক অজানা বার্তা, এক অশুভ ইঙ্গিত।
শান্তি মঠটি একটি নির্জন স্থানে অবস্থিত। মঠের চারপাশে ঘন জঙ্গল আর নীরবতা। মঠের প্রবেশপথে দুজন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের মুখে এক ধরনের প্রশান্তি, কিন্তু চোখে তীক্ষ্ণতা, যেন তারা সবকিছু দেখতে পাচ্ছে, এবং তাদের উপস্থিতি যেন এক ধরনের সুরক্ষা, এক অদৃশ্য ঢাল।
প্রবীর সেন এবং অর্জুন তাদের পরিচয় দিলেন এবং মঠের প্রধানের সাথে দেখা করার অনুমতি চাইলেন। সন্ন্যাসীরা কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তাদের চোখে এক ধরনের গভীরতা, যেন তারা তাদের মন পড়ছে, তারপর তাদের ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন।
মঠের ভেতরে প্রবেশ করতেই এক ধরনের শান্ত পরিবেশ তাদের ঘিরে ধরল। ধূপের গন্ধ আর মন্ত্রের মৃদু ধ্বনি তাদের মনকে শান্ত করে দিল, যেন তারা এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছে, যেখানে সময় থমকে গেছে, এবং সবকিছুই শান্ত। মঠের প্রধান, একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, তাদের সামনে এলেন। তার মুখে এক ধরনের গভীর জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে, তার চোখ দুটি যেন হাজার বছরের ইতিহাস বহন করছে, তার কণ্ঠস্বর শান্ত এবং গভীর, যেন তিনি মহাবিশ্বের সব রহস্য জানেন।
“আপনার আপনারা কেন এসেছেন?” বৃদ্ধ সন্ন্যাসী শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, তার কণ্ঠস্বর গভীর এবং শান্ত, যেন তিনি তাদের মনের কথা জানেন, তাদের উদ্দেশ্য জানেন।
প্রবীর সেন তাকে ডক্টর রায়ের অপহরণ এবং রাহুল সেনের ডায়েরির কথা বললেন। তিনি ‘গুরুজি’ এবং প্রাচীন পুঁথি সম্পর্কে তথ্য চাইলেন। তিনি তাকে সেই অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা পাথরটিও দেখালেন।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী মনোযোগ দিয়ে প্রবীর সেনের কথা শুনলেন। তার চোখে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না, যেন তিনি সবকিছু আগে থেকেই জানেন, এবং তিনি এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। “গুরুজি? আমাদের মঠে এমন কোনো গুরুজি নেই।”
“কিন্তু রাহুল সেন তার ডায়েরিতে আপনার মঠের কথা উল্লেখ করেছে। সে এখানে প্রাচীন জ্ঞান লাভ করেছিল বলে লিখেছে।”
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার মুখে এক ধরনের দুঃখ ফুটে উঠল। “রাহুল সেন এসেছিল বটে। সে জ্ঞানের সন্ধানে এসেছিল। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল। সে ক্ষমতা চাইত, জ্ঞান নয়। সে প্রাচীন জ্ঞানকে ব্যবহার করে মানবজাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, এবং সে তার নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে, তার আত্মা অন্ধকার হয়ে গেছে।”
“তাহলে ‘গুরুজি’ কে?” প্রবীর সেনের মনে হলো, তিনি এক নতুন ধাঁধার মুখোমুখি হয়েছেন।
“গুরুজি কোনো ব্যক্তি নয়, ইনস্পেক্টর। গুরুজি হলো সেই জ্ঞান, যা আমরা হাজার বছর ধরে রক্ষা করে আসছি। রাহুল সেই জ্ঞানকে ভুলভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, এবং সে তার নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।”
প্রবীর সেনের মনে হলো, তিনি এক নতুন ধাঁধার মুখোমুখি হয়েছেন। ‘গুরুজি’ কোনো ব্যক্তি নয়, বরং একটি ধারণা, একটি প্রাচীন জ্ঞান, যা মানবজাতির জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, যদি তা ভুল হাতে পড়ে।
“ডক্টর অমলকান্তি রায় কি এই পুঁথি নিয়ে আপনার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন?”
“হ্যাঁ। ডক্টর রায় এসেছিলেন। তিনি পুঁথিটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। আমরা তাকে সতর্ক করেছিলাম যে, এই পুঁথিটি খুব বিপজ্জনক। এটি এমন এক শক্তি ধারণ করে, যা মানবজাতির জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে, যদি তা ভুল হাতে পড়ে, এবং তার অপব্যবহার করা হয়, তাহলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।”
“পুঁথিটি এখন কোথায়?” অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তার কণ্ঠে উদ্বেগ, তার চোখ সন্ন্যাসীর দিকে, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী নীরব রইলেন। তার চোখে এক ধরনের গভীর দুঃখ ফুটে উঠল। “পুঁথিটি ভুল হাতে পড়েছে। রাহুল সেন সেটি চুরি করেছে। সে ‘অন্ধকারের রক্ষক’দের সাথে যোগ দিয়েছে, যারা এই জ্ঞানকে ক্ষমতা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে চায়, এবং তারা খুব বিপজ্জনক।”
প্রবীর সেন এবং অর্জুন চমকে উঠলেন। রাহুল সেন চোর? তাহলে কি সে ডক্টর রায়কে অপহরণ করেছে?
“রাহুল সেন কি ডক্টর রায়কে অপহরণ করেছে?” প্রবীর সেন জিজ্ঞাসা করলেন, তার কণ্ঠে এক ধরনের অবিশ্বাস, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
“রাহুল সেন সেই গোপন গোষ্ঠীর সাথে যোগ দিয়েছে, যারা প্রাচীন জ্ঞান ব্যবহার করে ক্ষমতা অর্জন করতে চায়। তারা ডক্টর রায়কে অপহরণ করেছে, কারণ তিনি পুঁথিটির রহস্য উন্মোচন করতে পারতেন, এবং তারা তাকে তাদের কাজে লাগাতে চেয়েছিল, তাকে বাধ্য করতে চেয়েছিল, তার জ্ঞানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।”
“সেই গোষ্ঠী কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী?”
“তারা নিজেদেরকে ‘অন্ধকারের রক্ষক’ বলে। তারা বিশ্বাস করে, মানবজাতি এই জ্ঞান ধারণ করার যোগ্য নয়। তাই তারা এই জ্ঞানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, এবং যারা এর বিরোধিতা করে, তাদের ধ্বংস করে দেয়। তারা একটি নতুন বিশ্ব তৈরি করতে চায়, যেখানে তারা হবে শাসক, এবং মানবজাতি হবে তাদের দাস, তাদের নিয়ন্ত্রণে।”
প্রবীর সেনের মনে হলো, তিনি এক ভয়ানক সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন। ‘অন্ধকারের রক্ষক’ – এই নামটা শুনেই তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এটি কেবল অপহরণ নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক বিশাল ষড়যন্ত্র, এক মহাজাগতিক যুদ্ধ, যা তাদের পরিচিত সব ধারণাকে ভেঙে দিতে পারে।
“তারা কোথায় আছে? ডক্টর রায় কোথায় আছেন?”
“তারা হিমালয়ের গভীরে একটি গোপন স্থানে লুকিয়ে আছে। সেখানে পৌঁছানো খুব কঠিন। সেই পথ বিপদসংকুল এবং অজানা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যু অপেক্ষা করছে, এবং যেখানে কোনো সাধারণ মানুষ পৌঁছাতে পারে না। আর ডক্টর রায়কে তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করছে, তাকে বাধ্য করছে পুঁথির রহস্য উন্মোচন করতে, তার জ্ঞানকে ব্যবহার করতে।”
“তাদের উদ্দেশ্য কী?”
“তারা পুঁথিটির শক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। তারা বিশ্বাস করে, এই জ্ঞান দিয়ে তারা মানবজাতিকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারবে, তাদের নিজেদের মতো করে। তারা নিজেদেরকে মানবজাতির ত্রাণকর্তা মনে করে, কিন্তু তাদের পথ ধ্বংসের পথ, এক অন্ধকার পথ, যা সবকিছুকে গ্রাস করবে।”
প্রবীর সেন বুঝতে পারলেন, এই কেসটি তাদের কল্পনার চেয়েও বড়। এটি কেবল অপহরণ নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক বিশাল ষড়যন্ত্র, যা তাদের পরিচিত জগতের বাইরে, এক প্রাচীন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
“আমরা কীভাবে তাদের খুঁজে পাবো?” অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তার চোখে দৃঢ় সংকল্প, তার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী একটি পুরনো মানচিত্র বের করলেন। মানচিত্রটি প্রাচীন এবং তাতে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব, যেন এটি কোনো প্রাচীন কোড। “এই মানচিত্রটি তোমাদের পথ দেখাবে। এটি সেই গোপন স্থানের পথ, যেখানে ‘অন্ধকারের রক্ষক’রা লুকিয়ে আছে। কিন্তু সাবধান, সেই পথ বিপদসংকুল, প্রতিটি মোড়ে বিপদ অপেক্ষা করছে, এবং তোমাদের সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা হবে, তোমাদের জীবন ঝুঁকির মুখে।”
প্রবীর সেন মানচিত্রটি হাতে নিলেন। মানচিত্রের প্রতিটি চিহ্ন যেন এক নতুন রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, এক অজানা পথের দিকে, এক অন্ধকার গন্তব্যের দিকে, এক বিপদসংকুল যাত্রা।
“আর কিছু কি আছে, যা আমাদের সাহায্য করতে পারে?” প্রবীর সেন জিজ্ঞাসা করলেন।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী একটি ছোট পাথরের টুকরো দিলেন। পাথরটি উজ্জ্বল এবং তাতে সেই অদ্ভুত চিহ্নটি আঁকা, যা প্রবীর সেন ডক্টর রায়ের ব্রিফকেস থেকে পেয়েছিলেন। “এই পাথরটি তোমাদের রক্ষা করবে। এটি ‘অন্ধকারের রক্ষক’দের শক্তিকে প্রতিহত করতে পারে, এবং তোমাদের পথ দেখাবে, যখন তোমরা অন্ধকারে পথ হারাবে, এটি তোমাদের আলোকবর্তিকা।”
প্রবীর সেন পাথরটি হাতে নিলেন। এটি সাধারণ পাথর নয়, এতে এক ধরনের অদ্ভুত শক্তি অনুভব করা যাচ্ছিল, যা তার হাতে এক ধরনের উষ্ণতা দিচ্ছিল, যেন এটি জীবন্ত, এক প্রাচীন শক্তি।
তারা মঠ থেকে বেরিয়ে এলেন। তাদের সামনে এখন এক নতুন মিশন। ‘অন্ধকারের রক্ষক’দের খুঁজে বের করা, ডক্টর রায়কে উদ্ধার করা, এবং পুঁথিটিকে ভুল হাতে পড়তে না দেওয়া।
টাইগার হিলের উপর দিয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। তার শেষ আলোয় পাহাড়গুলো লালচে রঙ ধারণ করেছিল। প্রবীর সেন এবং অর্জুন তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছেন। তাদের মনে এক নতুন সংকল্প জন্ম নিল। এই যুদ্ধটা কেবল তাদের নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে, এক অজানা শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যা তাদের পরিচিত সব ধারণাকে ভেঙে দিতে পারে, এবং তাদের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion