This entry is part 1 of 10 in the series মৌন উপত্যকাকুয়াশার আড়ালে প্রথম ছায়া
দার্জিলিংয়ের শীতকাল মানেই এক অন্যরকম মাদকতা। ভোরের আলো ফুটতেই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় সোনালী আভা, পাইন বনের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে আসা কুয়াশার চাদর, আর হিমেল হাওয়ায় মিশে থাকা চায়ের সুবাস। কিন্তু ২০০০ সালের সেই শীতের সকালগুলো যেন এক অজানা আতঙ্কে ভারী হয়ে উঠছিল। সূর্য উঠলেও কুয়াশা কাটছিল না, যেন কোনো অশুভ ছায়া ঢেকে রেখেছিল পাহাড়ের রানীকে।
অরুণিমা সেনগুপ্ত জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এক কাপ গরম কফি হাতে বাইরের দৃশ্য দেখছিলেন। কলকাতা থেকে দার্জিলিংয়ে বদলি হয়ে আসাটা তার কাছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল। কলকাতা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকলেও, পাহাড়ের এই নিরিবিলি শহরে তার কাজটা যে এত দ্রুত জটিল হয়ে উঠবে, তা তিনি ভাবেননি। মাত্র এক সপ্তাহ হলো তিনি দার্জিলিং সদর থানায় যোগ দিয়েছেন, আর এরই মধ্যে শহরজুড়ে এক চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
গত রাতে স্থানীয় চা বাগানের মালিক, মি. মুখার্জীর একমাত্র মেয়ে, প্রিয়াঙ্কা মুখার্জী নিখোঁজ হয়েছেন। প্রিয়াঙ্কার বয়স মাত্র সতেরো। সে তার স্কুলের বন্ধুদের সাথে একটি পার্টিতে গিয়েছিল এবং রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু সে ফেরেনি। তার বাবা-মা প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো বন্ধুদের বাড়িতে আছে, কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে তাদের উদ্বেগ বাড়তে থাকে। শেষমেশ ভোররাতে তারা থানায় খবর দেন।
অরুণিমা কফির কাপটা নামিয়ে রাখলেন। তার পরনে ছিল একটি গাঢ় নীল রঙের সোয়েটার এবং জিন্স। চুলগুলো আলগা করে বাঁধা। তার চোখে ছিল এক দৃঢ়তা, যা যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত।
থানার দিকে হাঁটতে হাঁটতে অরুণিমা চারপাশের পরিবেশটা খেয়াল করছিলেন। সকালের দার্জিলিং তখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। দোকানপাট খুলছে, কিছু পর্যটক অলস পায়ে হাঁটছেন, কিন্তু তাদের চোখেও যেন এক ধরণের অনিশ্চয়তা। প্রিয়াঙ্কার নিখোঁজ হওয়ার খবর হয়তো ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে।
থানায় পৌঁছেই অরুণিমা ইন্সপেক্টর সুব্রত রায়কে দেখতে পেলেন। সুব্রত রায় স্থানীয় মানুষ, দার্জিলিংয়ের প্রতিটি অলিগলি তার চেনা। তার মুখেও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
“ম্যাডাম, গুড মর্নিং,” সুব্রত রায় অরুণিমাকে দেখে বললেন। “কেসটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে।”
অরুণিমা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। “আমি ফাইলটা দেখেছি, ইন্সপেক্টর। কোনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি, কোনো ক্লু নেই। এটা কি নিছকই নিখোঁজ, নাকি অপহরণ?”
“পরিবারের দাবি অপহরণ, ম্যাডাম। প্রিয়াঙ্কা এমন মেয়ে নয় যে কাউকে কিছু না বলে চলে যাবে,” সুব্রত রায় বললেন। “আমরা মুখার্জী সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে, কোনো জোর করে ঢোকার চিহ্ন নেই।”
“তাহলে কি পরিচিত কেউ?” অরুণিমা প্রশ্ন করলেন।
“সেটাই ভাবছি। কিন্তু কে হতে পারে? প্রিয়াঙ্কার কোনো শত্রু ছিল না, আর মুখার্জী পরিবারও বেশ প্রভাবশালী। তাদের সাথে কারো শত্রুতা থাকার কথা নয়,” সুব্রত রায় বললেন।
অরুণিমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তার অভিজ্ঞ চোখগুলো যেন অদৃশ্য সূত্র খুঁজছিল। “চলুন, আমরা আরেকবার মুখার্জী সাহেবের বাড়িতে যাই। আমি নিজে একবার সবকিছু দেখতে চাই।”
মুখার্জী সাহেবের বাড়িটা ছিল শহরের একটু বাইরে, একটি ছোট পাহাড়ের ঢালে। চারদিকে চা বাগান আর পাইন গাছের সারি। বাড়িটা বেশ বড় এবং আধুনিক। অরুণিমা এবং সুব্রত যখন পৌঁছালেন, তখন প্রিয়াঙ্কার বাবা-মা, মি. এবং মিসেস মুখার্জী লিভিং রুমে বসে ছিলেন। তাদের চোখে-মুখে গভীর উদ্বেগ আর ক্লান্তি।
“আপনারা আবার এসেছেন, ইন্সপেক্টর?” মি. মুখার্জী হতাশ কণ্ঠে বললেন। “আমার মেয়েটা কোথায় গেল, আপনারা কি কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না?”
অরুণিমা শান্ত গলায় বললেন, “আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, মি. মুখার্জী। আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই, যদি আপনারা উত্তর দেন, তাহলে আমাদের তদন্তে সুবিধা হবে।”
মিসেস মুখার্জী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “জিজ্ঞেস করুন, যা জানতে চান। শুধু আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনুন।”
অরুণিমা প্রিয়াঙ্কার ঘরটা দেখতে চাইলেন। ঘরটা পরিপাটি ছিল, যেমনটা একজন সতেরো বছরের মেয়ের ঘর হয়। টেবিলে বইপত্র, দেয়ালে পোস্টার, আলমারিতে পোশাক। অরুণিমা প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তার চোখ আটকে গেল বিছানার পাশে রাখা একটি ছোট ডায়েরির উপর। ডায়েরিটা খোলা ছিল, কিন্তু তাতে কিছু লেখা ছিল না, শুধু একটি পৃষ্ঠায় একটি ছোট, অস্পষ্ট দাগ।
“এই ডায়েরিটা কার?” অরুণিমা জিজ্ঞেস করলেন।
“প্রিয়াঙ্কার। ও মাঝে মাঝে ওর ভাবনাগুলো লিখত,” মিসেস মুখার্জী বললেন।
অরুণিমা ডায়েরিটা হাতে নিলেন। দাগটা খুব হালকা, প্রায় অদৃশ্য। যেন কেউ কিছু লেখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ করেনি। তিনি ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে দেখলেন। শেষ লেখাটা ছিল এক সপ্তাহ আগের।
“প্রিয়াঙ্কার কোনো ছেলে বন্ধু ছিল? বা এমন কেউ যার সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল?” অরুণিমা প্রশ্ন করলেন।
মি. মুখার্জী একটু ইতস্তত করে বললেন, “না, তেমন কিছু তো জানি না। ও পড়াশোনা নিয়েই থাকত।”
কিন্তু মিসেস মুখার্জীর চোখে এক ঝলক দ্বিধা অরুণিমার চোখ এড়ালো না।
“মিসেস মুখার্জী, যদি কিছু লুকান, তাহলে আমাদের তদন্ত কঠিন হবে,” অরুণিমা শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।
মিসেস মুখার্জী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে, ইদানিং ও একটু অন্যরকম আচরণ করছিল। কেমন যেন চুপচাপ থাকত। আর ওর মোবাইলে কিছু অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসত।”
“অচেনা নম্বর?” অরুণিমা দ্রুত প্রশ্ন করলেন। “মোবাইলটা কোথায়?”
“ও তো মোবাইলটা নিয়েই পার্টিতে গিয়েছিল। এখন তো ওটাও নেই,” মি. মুখার্জী বললেন।
অরুণিমা ডায়েরির দাগটা আবারও দেখলেন। তারপর ঘরের মেঝেতে চোখ বুলালেন। কার্পেটের উপর একটি ক্ষুদ্র, প্রায় অদৃশ্য কালো কণা। তিনি নিচু হয়ে কণাটি তুলে নিলেন। এটি যেন কোনো সূক্ষ্ম ধাতব কণা।
“ইন্সপেক্টর, এই কণাটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠান। আর প্রিয়াঙ্কার বন্ধুদের সাথে কথা বলুন। বিশেষ করে যারা ওর সাথে পার্টিতে ছিল,” অরুণিমা বললেন।
সুব্রত রায় মাথা নাড়লেন। অরুণিমা বুঝতে পারছিলেন, এই কেসটা কেবল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নয়। এর পেছনে আরও গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, যা কুয়াশার আড়ালে ধীরে ধীরে তার কালো ছায়া ফেলছে। দার্জিলিংয়ের শান্ত পাহাড়ে এক অদৃশ্য হাতের ইশারা যেন নতুন এক খেলার সূচনা করছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion