Episode 2878 words0 views

মৌন উপত্যকা : দ্বিতীয় অধ্যায়

রহস্যের জাল বোনা মুখার্জী বাড়ি থেকে বেরিয়ে অরুণিমা এবং সুব্রত রায় সরাসরি থানায় ফিরে এলেন। সকালের মিষ্টি রোদ ততক্ষণে কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঁকি দিতে শুরু করেছে, কিন্তু অরুণিমার মনে তখনও এক গভীর কুয়াশা। প্রিয়াঙ্কার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা তাকে ভাবাচ্ছিল। কোনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি, কোনো স্পষ্ট ক্লu নেই, আর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক চাপা অস্বস্তি। এই অস্বস্তিই অরুণিমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছিল। অভিজ্ঞ গোয়েন্দা হিসেবে তিনি জানেন, পরিবারের সদস্যদের সামান্যতম দ্বিধা বা লুকোচুরি অনেক সময়ই তদন্তের গতিপথ বদলে দিতে পারে। থানায় ফিরে অরুণিমা তার ডেস্কে বসলেন। তার সামনে রাখা ছিল প্রিয়াঙ্কার কেস ফাইল, একটি খালি কফির কাপ, আর তার ব্যক্তিগত নোটবুক। সুব্রত রায় তার সামনে এসে দাঁড়ালেন, তার মুখেও একই রকম চিন্তার ছাপ। তার হাতে ছিল প্রিয়াঙ্কার বন্ধু-বান্ধবদের একটি প্রাথমিক তালিকা। “ম্যাডাম, প্রিয়াঙ্কার বন্ধুদের তালিকা তৈরি করতে বলেছি। তাদের সাথে কথা বলতে হবে,” সুব্রত বললেন। “আর ওই ধাতব কণাটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছি। দেখি কী রিপোর্ট আসে। ল্যাব থেকে জানিয়েছে, রিপোর্ট পেতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে।” “ভালো করেছেন, ইন্সপেক্টর,” অরুণিমা বললেন। তার চোখ সামনের দেয়ালের দিকে স্থির। “কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এটা নিছকই কোনো সাধারণ অপহরণ নয়। যদি মুক্তিপণ চাওয়া না হয়, তাহলে এর উদ্দেশ্য কী হতে পারে? ব্যক্তিগত শত্রুতা? নাকি এর পেছনে আরও বড় কোনো উদ্দেশ্য আছে? প্রতিশোধ? নাকি কোনো বিকৃত মানসিকতার খেলা?” অরুণিমার মনে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। কলকাতা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চে তিনি বহু বিচিত্র অপরাধের সাক্ষী হয়েছেন, কিন্তু এই কেসটা যেন এক নতুন ধাঁধা। সুব্রত রায় মাথা চুলকালেন। “দার্জিলিংয়ে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি, ম্যাডাম। ছোটখাটো চুরি-ডাকাতি হয়, কিন্তু এভাবে কোনো প্রভাবশালী পরিবারের মেয়েকে অপহরণ… এটা সত্যিই অস্বাভাবিক।” তার কণ্ঠস্বরে এক ধরণের অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। দার্জিলিংয়ের পুলিশ বাহিনী সাধারণত এমন জটিল কেস সামলাতে অভ্যস্ত নয়। তাদের অভিজ্ঞতা মূলত স্থানীয় বিবাদ, ছোটখাটো চুরি বা পর্যটকদের হয়রানি নিয়ে। এমন একটি হাই-প্রোফাইল কেস তাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। “অস্বাভাবিক বলেই এর পেছনে একটা প্যাটার্ন থাকতে পারে,” অরুণিমা বললেন, তার চোখ কফির কাপের দিকে স্থির। “মনে রাখবেন, অপরাধীরা সবসময়ই কোনো না কোনো চিহ্ন রেখে যায়। হয়তো আমরা এখনও সেটা খুঁজে পাইনি। প্রিয়াঙ্কার ডায়েরিতে সেই অস্পষ্ট দাগ, মিসেস মুখার্জীর লুকোচুরি, আর মোবাইল ফোনটা গায়েব হয়ে যাওয়া – এগুলো সব এক সুতোয় বাঁধা হতে পারে।” তিনি ডায়েরির সেই অস্পষ্ট দাগটির কথা ভাবলেন। মনে হচ্ছিল, কেউ কিছু লেখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ করেনি। যেন কোনো জরুরি বার্তা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর মিসেস মুখার্জীর সেই দ্বিধা, যা অরুণিমার তীক্ষ্ণ চোখ এড়ায়নি। মায়ের চোখে এক ধরণের ভয় ছিল, যা কেবল মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার জন্য নয়, যেন অন্য কোনো গোপন কথা লুকিয়ে রাখার ভয়। “ইন্সপেক্টর, প্রিয়াঙ্কার স্কুলের বন্ধুদের সাথে কথা বলার সময় তাদের পারিবারিক পটভূমি সম্পর্কেও খোঁজ নেবেন,” অরুণিমা নির্দেশ দিলেন। “বিশেষ করে, তাদের পরিবারের সাথে মুখার্জী পরিবারের কোনো পুরনো বিবাদ বা সম্পর্ক ছিল কিনা। এমনকি, তাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক বা গোপন শত্রুতা ছিল কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখবেন। প্রিয়াঙ্কা কি সম্প্রতি কারো সাথে বেশি মেলামেশা করছিল? ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কেউ কি ওর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু জানত?” সুব্রত রায় তার নোটবুকে দ্রুত কিছু লিখে নিলেন। “বুঝতে পেরেছি, ম্যাডাম। আমি এখনই টিমকে নির্দেশ দিচ্ছি। প্রiaঙ্কার স্কুলের বন্ধুদের পাশাপাশি ওর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথেও কথা বলা দরকার। হয়তো স্কুলের পরিবেশে কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল।” “আর সংবাদমাধ্যম? খবরটা ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের মানুষ আতঙ্কে আছে। স্থানীয় কিছু সাংবাদিক থানার বাইরে ভিড় করছে, ফোন করে করে বিরক্ত করছে,” সুব্রত রায় বললেন। তার কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট। “সংবাদমাধ্যমকে আপাতত কোনো বিস্তারিত তথ্য দেবেন না,” অরুণিমা বললেন। তার কণ্ঠে দৃঢ়তা। “শুধু বলুন, পুলিশ তদন্ত করছে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো গুজব যেন না ছড়ায়, সেদিকে নজর রাখবেন। বিশেষ করে, এই মুহূর্তে কোনো অনুমানভিত্তিক খবর যেন প্রকাশিত না হয়। এতে তদন্তের ক্ষতি হতে পারে এবং জনমনে আরও আতঙ্ক ছড়াতে পারে। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ খুব সাবধানে নিতে হবে।” সুব্রত রায় বেরিয়ে গেলেন। অরুণিমা আবার প্রিয়াঙ্কার কেস ফাইলটা খুললেন। তিনি প্রিয়াঙ্কার ছবিটার দিকে তাকালেন। হাসিখুশি একটি মেয়ে, যার জীবন হঠাৎ করেই এক গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। তার চোখেমুখে এক ধরণের জেদ ফুটে উঠল। তিনি এই রহস্যের সমাধান করবেনই। তিনি সেই ধাতব কণাটার কথা ভাবলেন। এটা কি কোনো যন্ত্রাংশের অংশ? নাকি কোনো গয়নার টুকরো? তার মনে হচ্ছিল, এই ক্ষুদ্র কণাটাই হয়তো এই রহস্যের জট খোলার প্রথম সূত্র। ফরেনসিক রিপোর্ট আসার অপেক্ষায় তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। দুপুরের মধ্যে দার্জিলিংয়ের স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রিয়াঙ্কার নিখোঁজ হওয়ার খবরটি বড় করে ছাপা হলো। “চা বাগানের মালিকের মেয়ে নিখোঁজ: দার্জিলিংয়ে আতঙ্ক!” শিরোনামে খবরটি শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, এমনকি চা বাগানগুলোতেও মানুষ ফিসফিস করে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিল। পর্যটকদের মধ্যেও এক ধরণের চাপা ভয় লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অনেকেই তাদের দার্জিলিং ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করতে শুরু করল। শহরের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। পাহাড়ের শান্ত পরিবেশে যেন এক শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছিল, যা ভয়ের বার্তা নিয়ে আসছিল। শহরের মানুষ, যারা সাধারণত নিজেদের নিরাপদ মনে করত, তারা এখন প্রতিটা ছায়ায়, প্রতিটা অচেনা মুখের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল। মৌন উপত্যকার নীরবতা যেন এক অজানা চিৎকারে ভেঙে গিয়েছিল। অরুণিমা জানতেন, এই আতঙ্ক কেবল প্রিয়াঙ্কার পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। যদি এই অপহরণের পেছনে কোনো বৃহত্তর পরিকল্পনা থাকে, তাহলে আরও ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে পারছিলেন, এই কেসটা তার দার্জিলিংয়ে প্রথম এবং সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হতে চলেছে। মৌন উপত্যকা যেন তার বুকে এক গভীর রহস্য লুকিয়ে রেখেছিল, যার জাল ধীরে ধীরে বোনা হচ্ছিল। অরুণিমা সেই জালের গভীরে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তার মন স্থির ছিল, এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করে সত্যকে উন্মোচন করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। তিনি অনুভব করলেন, দার্জিলিংয়ের এই মনোরম পরিবেশের নিচে এক অন্ধকার জগত লুকিয়ে আছে, যা ধীরে ধীরে তার মুখোশ খুলতে শুরু করবে। এই নীরব উপত্যকা আর নীরব থাকবে না। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion