শেষ চাল
সেন্ট পলস একাডেমির দেওয়ালের উপর সিদ্ধার্থের প্রজেক্ট করা সেই ভয়ংকর বার্তাটি দার্জিলিং শহরকে এক মুহূর্তে স্তব্ধ করে দিল। ভোরের আলোয় যখন মানুষজন ঘুম থেকে উঠছিল, তখন তারা দেখল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এই ঘটনাকে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করল। মুখার্জী এবং বর্মা পরিবারের সম্মান এবং প্রতিপত্তি মুহূর্তেই ধুলোয় মিশে গেল। তাদের অতীত পাপের ইতিহাস সবার সামনে উন্মোচিত হলো, যা তাদের সামাজিক অবস্থানকে চিরতরে নষ্ট করে দিল। শহরের মানুষজন, যারা এতদিন আতঙ্কে ছিল, তারা এখন ক্ষোভ এবং ঘৃণায় ফেটে পড়ছিল। শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদ মিছিল বের করতে শুরু করল, পুরনো ধর্মঘটের স্মৃতি নতুন করে জেগে উঠল।
স্কুলের কন্ট্রোল রুমে অরুণিমা সেনগুপ্তের চোখেমুখে এক ধরণের তীব্র হতাশা এবং ক্রোধ ফুটে উঠল। সিদ্ধার্থ তাদের ফাঁকি দিয়ে তার চূড়ান্ত বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। প্রজেক্টরটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছিল, এবং পুলিশ টিম ছাদে পৌঁছানোর আগেই সিদ্ধার্থ অদৃশ্য হয়ে গেছে।
“ইন্সপেক্টর, প্রজেক্টরটা বন্ধ হয়েছে?” অরুণিমা জিজ্ঞেস করলেন, তার কণ্ঠস্বর কিছুটা উত্তেজিত।
“হ্যাঁ ম্যাডাম, বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে,” সুব্রত রায় হতাশ কণ্ঠে বললেন। “শহরজুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। মুখার্জী আর বর্মা পরিবারের বিরুদ্ধে মানুষজন ক্ষোভে ফুঁসছে।”
অরুণিমা মাথা নাড়লেন। “আমরা জানতাম সে এমন কিছু করবে, কিন্তু এতটা প্রকাশ্যে, এতটা নাটকীয়ভাবে – এটা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। সে তার প্রতিশোধকে একটি শিল্পকর্মে পরিণত করেছে।”
ঠিক তখনই ড. প্রবীর মিত্র কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করলেন। তার মুখেও এক ধরণের উদ্বেগ। “ডিটেক্টিভ সেনগুপ্ত, সিদ্ধার্থ যা করেছে, তা তার মনস্তত্ত্বের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। সে চায় তার প্রতিশোধের বার্তা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ুক, যা কেউ কখনো ভুলতে পারবে না। সে চায় এই পরিবারগুলো শুধু তাদের সন্তানদের হারানোর যন্ত্রণা অনুভব না করুক, বরং সামাজিক অপমানের যন্ত্রণা ভোগ করুক।”
“কিন্তু সে কোথায় গেল, ডাক্তার সাহেব?” অরুণিমা জিজ্ঞেস করলেন। “সে কি শহরের বাইরে চলে গেছে?”
ড. মিত্র কিছুক্ষণ ভাবলেন। “না, আমার মনে হয় না সে শহর ছেড়েছে। সে তার প্রতিশোধের চূড়ান্ত ধাপের জন্য অপেক্ষা করছে। সে চায় আপনারা তাকে অনুসরণ করুন। সে চায় এই খেলাটা শেষ হোক তার শর্তে। সে হয়তো এমন কোনো জায়গায় লুকিয়ে আছে, যা তার কাছে খুব প্রতীকী, অথবা যেখানে সে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।”
অরুণিমা সিদ্ধার্থের ল্যাবরেটরিতে পাওয়া ম্যাপটির কথা ভাবলেন। ম্যাপে তিনটি স্থান চিহ্নিত করা ছিল – মুখার্জী বাড়ি, বর্মা বাড়ি, এবং সেন্ট পলস একাডেমি। কিন্তু একটি চতুর্থ স্থান ছিল, যা লাল কালিতে বৃত্তাকার করা হয়েছিল, এবং তার পাশে একটি ছোট ‘X’ চিহ্ন দেওয়া হয়েছিল। স্থানটি ছিল দার্জিলিংয়ের ঠিক বাইরে, একটি উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে একটি পুরনো, পরিত্যক্ত ওয়াচটাওয়ার ছিল। ওয়াচটাওয়ারটি ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা হয়েছিল, এবং বছরের পর বছর ধরে তা অব্যবহৃত পড়ে ছিল। এটি শহরের সবচেয়ে উঁচু স্থানগুলোর মধ্যে একটি, যেখান থেকে পুরো দারjeeling শহর দেখা যায়।
“ওয়াচটাওয়ার!” অরুণিমা বিড়বিড় করলেন। “ডাক্তার সাহেব, সিদ্ধার্থের ল্যাবরেটরিতে একটি ম্যাপ ছিল, যেখানে একটি পুরনো ওয়াচটাওয়ার চিহ্নিত করা হয়েছিল। আমার মনে হয়, সেটাই তার চূড়ান্ত আস্তানা। সেখান থেকে সে পুরো দার্জিলিং শহর দেখতে পারে, এবং তার প্রতিশোধের ‘শিল্পকর্ম’ পর্যবেক্ষণ করতে পারে।”
ড. মিত্রের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “ঠিক ধরেছেন, ডিটেক্টিভ সেনগুপ্ত! ওয়াচটাওয়ার! এটি তার জন্য একটি আদর্শ স্থান। সেখান থেকে সে তার প্রতিশোধের দৃশ্য দেখতে পারে, এবং নিজেকে বিজয়ী মনে করতে পারে। এটি তার প্রতিশোধের চূড়ান্ত মঞ্চ।”
অরুণিমা তৎক্ষণাৎ সুব্রত রায়কে নির্দেশ দিলেন। “ইন্সপেক্টর, ওয়াচটাওয়ারের দিকে টিম পাঠান! দ্রুত! সে হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে।”
পুলিশ টিম দ্রুত ওয়াচটাওয়ারের দিকে রওনা হলো। রাস্তা ছিল দুর্গম এবং খাড়া। কুয়াশা এবং হিমেল বাতাস তাদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলছিল। অরুণিমা এবং সুব্রত রায়ও তাদের সাথে গেলেন। তাদের মনে এক ধরণের চাপা উত্তেজনা। তারা জানতেন, এটাই চূড়ান্ত লড়াই।
ওয়াচটাওয়ারের কাছাকাছি পৌঁছাতেই তারা দেখতে পেলেন, টাওয়ারের চূড়ায় একটি অস্পষ্ট ছায়া। সিদ্ধার্থ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার পিঠ তাদের দিকে। তার হাতে একটি ছোট যন্ত্র, যা থেকে একটি মৃদু আলো বের হচ্ছিল। সে যেন পুরো দার্জিলিং শহরকে দেখছিল, তার প্রতিশোধের সফলতার সাক্ষী হচ্ছিল।
“সিদ্ধার্থ! তুমি চারদিক থেকে ঘেরা!” অরুণিমা চিৎকার করে বললেন, তার কণ্ঠস্বর পাহাড়ের নীরবতা ভেঙে দিল। “আত্মসমর্পণ করো! তোমার পালানোর কোনো পথ নেই!”
সিদ্ধার্থ ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তার মুখে সেই বিকৃত হাসি। তার চোখে প্রতিশোধের আগুন আরও তীব্র হলো। “পালানো? আমি পালাচ্ছি না, ডিটেক্টিভ সেনগুপ্ত। আমি আমার প্রতিশোধের চূড়ান্ত ধাপের জন্য অপেক্ষা করছি। আমি চেয়েছিলাম আপনারা আসুন। আমি চেয়েছিলাম আপনারা আমার ‘শিল্পকর্ম’ দেখুন।”
তার হাতে থাকা যন্ত্রটি ছিল একটি ছোট আকারের বোমা, যা টাইটানিয়াম-নিকেল সংকর ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, এবং তাতে একটি টাইম বোমা সেট করা ছিল। বোমার গায়ে ‘S’ অক্ষর খোদাই করা ছিল। বোমাটি থেকে একটি মৃদু টিক টিক শব্দ শোনা যাচ্ছিল, যা বাতাসের সাথে মিশে আরও তীব্র মনে হচ্ছিল। তার ছোট্ট ডিজিটাল ডিসপ্লেতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ৩ মিনিট ৩০ সেকেন্ড।
“এই বোমাটি দার্জিলিং শহরের ইতিহাসের সাক্ষী হবে,” সিদ্ধার্থ উন্মাদ কণ্ঠে বলল। তার কণ্ঠস্বর পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হলো। “এটি মুখার্জী এবং বর্মা পরিবারের পাপের চূড়ান্ত প্রায়শ্চিত্ত করবে। এটি তাদের সম্মান এবং প্রতিপত্তিকে চিরতরে ধ্বংস করবে। এই বিস্ফোরণ হবে আমার প্রতিশোধের শেষ চিহ্ন, যা কেউ কখনো ভুলতে পারবে না।” তার চোখে এক ধরণের নির্মম আনন্দ ফুটে উঠল।
অরুণিমা এবং সুব্রত রায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সিদ্ধার্থ শুধু তাদের মানসিক আঘাত দিতে চায়নি, সে চেয়েছিল একটি চূড়ান্ত ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে। এই বোমাটি যদি শহরের কেন্দ্রে বিস্ফোরিত হয়, তাহলে তা দার্জিলিংয়ের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় রচনা করবে। বোমার আকার ছোট হলেও, এর নির্মাণশৈলী এবং ব্যবহৃত ধাতু দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এটি অত্যন্ত শক্তিশালী।
“বোমাটা ফেলে দাও, সিদ্ধার্থ!” অরুণিমা চিৎকার করে বললেন, তার হাতের অস্ত্র সিদ্ধার্থের দিকে তাক করা। সুব্রত রায়ও প্রস্তুত ছিলেন, তার চোখেও দৃঢ় সংকল্প। “তুমি যা চাও, তা হয়ে গেছে। তোমার প্রতিশোধের বার্তা সবাই জেনেছে। আর কোনো ক্ষতি করো না! নিরীহ মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলো না!”
“ক্ষতি?” সিদ্ধার্থ বিদ্রূপের হাসি হাসল। তার হাসি কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের বুকে এক ভয়ংকর প্রতিধ্বনি তৈরি করল। তার চোখে এক ধরণের বিকৃত যুক্তি, যা তার প্রতিশোধের উন্মাদনাকে আরও বাড়িয়ে তুলছিল। “আমি শুধু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করছি, ডিটেক্টিভ সেনগুপ্ত। এই সমাজ আমাকে যা দিয়েছে, আমি তার প্রতিশোধ নিচ্ছি। এই পাহাড়ের প্রতিটি পাথর আমার পরিবারের যন্ত্রণার সাক্ষী। এবার এই দার্জিলিং দেখবে, পাপের ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে!”
সে হঠাৎ করে বোমাটি উঁচু করে ধরল, যেন সে এটিকে ওয়াচটাওয়ারের চূড়া থেকে ছুঁড়ে ফেলবে। বোমাটির ডিজিটাল কাউнтডাউন তখন ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে নেমে এসেছে। অরুণিমা এবং সুব্রত রায় দ্রুত পজিশন নিলেন। তাদের হাতে অস্ত্র, কিন্তু তারা জানতেন, একটি ভুল পদক্ষেপ পুরো শহরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এই উঁচু ওয়াচটাওয়ারে কোনো আড়াল ছিল না, পালানোর কোনো পথ ছিল না। তাদের সামনে ছিল এক বিপদজনক ফাঁদ, যা সিদ্ধার্থ নিজেই পেতেছিল।
“সিদ্ধার্থ, শোনো!” অরুণিমা শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, তার চোখে তীব্র মনোনিবেশ। তিনি সিদ্ধার্থের উন্মাদনার গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেন। “তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। তুমি এত বুদ্ধিমান। তুমি কি চাও তোমার সব মেধা, তোমার সব কাজ শুধু ধ্বংসের জন্য ব্যবহার হোক? তোমার পরিবারের যন্ত্রণা কি আরও নিরীহ মানুষের যন্ত্রণার কারণ হবে? তোমার প্রতিশোধ কি তোমার পরিবারকে ফিরিয়ে আনতে পারবে?”
সিদ্ধার্থের মুখে এক ঝলক দ্বিধা দেখা গেল, তার উন্মাদ চোখগুলো এক মুহূর্তের জন্য যেন একটু ম্লান হলো। তার চোখের গভীরে এক ঝলক পুরনো কষ্ট ফুটে উঠল, যা তার প্রতিশোধের আড়ালে চাপা পড়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখের পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠল, যেন সে সেই দুর্বলতাকে ঝেড়ে ফেলল। “আমার পরিবার ধ্বংস হয়েছে। আমার শৈশব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমি শুধু চাই এই যন্ত্রণাটা সবাই অনুভব করুক। আমি চাই না কেউ আমাকে ভুলে যাক! আমার নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে!”
সে বোমার কাউন্টডাউন ডিসপ্লে অরুণিমার দিকে তাক করল। তখন ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড বাকি। বাতাস হিমশীতল হয়ে উঠল, সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড যেন এক অনন্তকাল মনে হচ্ছিল। টাওয়ারের চূড়ায় বাতাসের তীব্র শব্দ যেন ঘড়ির টিক টিক শব্দকে আরও জোরদার করে তুলছিল।
“তুমি একা নও, সিদ্ধার্থ,” অরুণিমা তার দিকে ধীরে ধীরে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন, তার কণ্ঠস্বর আরও নরম কিন্তু দৃঢ়। “তোমার প্রতিশোধের এই পথ তোমাকে শান্তি দেবে না। বরং, তা তোমাকে আরও গভীরে ঠেলে দেবে। তুমি চাইলে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি। তোমার ভেতরের এই ক্ষত নিরাময় করতে পারি। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞ তোমাকে কোনো সমাধান দেবে না। তুমি শুধু আরও বেশি মানুষকে তোমার যন্ত্রণার অংশীদার করবে।”
সিদ্ধার্থের চোখ অরুণিমার চোখে স্থির। তার মধ্যে যেন এক ধরণের তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল। তার মনস্তত্ত্বের গভীরে অরুণিমার কথাগুলো আঘাত হানছিল, তার দীর্ঘদিনের লালিত প্রতিশোধের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। তার হাত সামান্য কাঁপছিল, যেন তার ভেতরের দুটি সত্তা একে অপরের সাথে লড়াই করছিল – একজন প্রতিশোধপরায়ণ উন্মাদ, অন্যজন সেই ছোট ছেলেটি যে ন্যায়বিচার চেয়েছিল।
হঠাৎ, সে চিৎকার করে উঠল, “না! আপনারা কিছুই বোঝেন না! আমার যন্ত্রণা কেউ বোঝে না! এই সমাজ আমাকে ধ্বংস করেছে!” তার কণ্ঠস্বর উন্মাদনায় ফেটে পড়ল, যেন তার সমস্ত চাপা ক্ষোভ একবারে বেরিয়ে আসছে।
সে বোমাটি ওয়াচটাওয়ারের কিনারায় নিয়ে গেল, তার হাত তখনও কাঁপছে, যেন নিচে ফেলে দেবে। বোমার কাউন্টডাউন তখন ৫৫ সেকেন্ডে নেমে এসেছে। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে লাল অক্ষরে জ্বলজ্বল করছিল সংখ্যাগুলো, প্রতিটি সেকেন্ড যেন মৃত্যুর বার্তা নিয়ে আসছিল।
“ইন্সপেক্টর! প্রস্তুত থাকুন!” অরুণিমা সুব্রত রায়কে ফিসফিস করে বললেন, তার চোখ সিদ্ধার্থের প্রতিটি নড়াচড়ার উপর স্থির। তাদের টিমও প্রস্তুত ছিল, তাদের অস্ত্র সিদ্ধার্থের দিকে তাক করা।
অরুণিমা হঠাৎ করেই একটি দ্রুত এবং অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ নিলেন। সিদ্ধার্থের উন্মাদনার সুযোগ নিয়ে তিনি তার দিকে বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার লক্ষ্য ছিল সিদ্ধার্থের হাত থেকে বোমাটি কেড়ে নেওয়া। সুব্রত রায়ও একই মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সিদ্ধার্থের হাতকে লক্ষ্য করে।
পাহাড়ের চূড়ায় এক শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই শুরু হলো। সিদ্ধার্থ শক্তিশালী ছিল, এবং তার মনে ছিল প্রতিশোধের উন্মাদনা। সে অরুণিমাকে ধাক্কা মারল, তার হাতের কনুই দিয়ে অরুণিমার পেটে আঘাত করল, কিন্তু অরুণিমা তার কব্জি শক্ত করে ধরলেন, তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বোমাটি নিজের দিকে টানলেন। বোমাটি তাদের হাত থেকে ছিটকে পড়ার উপক্রম হলো, কিনারার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল। সুব্রত রায় সিদ্ধার্থকে ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সিদ্ধার্থ তার দিকে একটি প্রচণ্ড ঘুঁষি মারল, যা সুব্রতের চোয়ালে আঘাত করল। সুব্রত এক মুহূর্তের জন্য টলে গেলেন, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন।
৪০ সেকেন্ড… ৩৫ সেকেন্ড…
সিদ্ধার্থ অরুণিমাকে ধাক্কা দিয়ে ওয়াচটাওয়ারের কিনারার দিকে নিয়ে গেল। অরুণিমা অনুভব করলেন, তিনি প্রায় কিনারায় চলে এসেছেন। তার পায়ের নিচে পাথরের টুকরোগুলো আলগা হয়ে যাচ্ছিল। এক ভুল পদক্ষেপেই তারা দুজনেই হাজার ফুট নিচে পড়ে যেতে পারেন, যেখানে শুধু পাথরের খাঁজ আর পাইন গাছের চূড়া। সুব্রত রায় আবার সিদ্ধার্থকে ধরার চেষ্টা করলেন, তার হাত সিদ্ধার্থের কাঁধে পৌঁছাল।
৩০ সেকেন্ড… ২৫ সেকেন্ড…
অরুণিমা তার সমস্ত শক্তি এক করে সিদ্ধার্থের হাত থেকে বোমাটি ছিনিয়ে নিলেন। বোমাটি তখন ২০ সেকেন্ডের কাছাকাছি। অরুণিমা তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করলেন। তার কাছে বোমাটি নিষ্ক্রিয় করার সময় ছিল না। তিনি জানতেন, এই বোমা শহরের মধ্যে বিস্ফোরিত হলে ভয়ংকর পরিণতি হবে। তার একমাত্র উপায় ছিল এটিকে এমন কোথাও নিক্ষেপ করা, যেখানে এটি কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি দ্রুত তার চারপাশটা দেখে নিলেন। ওয়াচটাওয়ারের ঠিক উল্টো দিকে একটি গভীর খাদ, যা শহরের মূল অংশ থেকে অনেক দূরে, এবং যেখানে কোনো জনবসতি ছিল না, শুধু পাথর আর ঘন গাছপালা।
১৫ সেকেন্ড… ১০ সেকেন্ড…
অরুণিমা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বোমাটি ওয়াচটাওয়ারের ঠিক উল্টো দিকে, সেই গভীর খাদে ছুঁড়ে দিলেন, তার প্রতিটি পেশী টান টান হয়ে উঠল। বোমাটি বাতাসের মধ্যে দিয়ে তীব্র গতিতে নিচে নেমে গেল, একটি ছোট কালো বিন্দুর মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। তার চোখ বোমার গতিপথ অনুসরণ করছিল, তার মনে ছিল এক তীব্র প্রার্থনা।
৫ সেকেন্ড… ৪… ৩… ২… ১…
এক বিকট শব্দে বোমাটি খাদে বিস্ফোরিত হলো। পুরো পাহাড় কেঁপে উঠল, যেন ভূমিকম্প হয়েছে। ধোঁয়ার বিশাল, কালো কুণ্ডলী আকাশের দিকে উঠে গেল, যা কুয়াশার চাদর ভেদ করে উপরে উঠে যাচ্ছিল, আর বিস্ফোরণের শব্দ দার্জিলিং শহরের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হলো, প্রতিটি বাড়ির জানালা কাঁপিয়ে দিল। পাহাড়ের বুক থেকে যেন এক ভয়ংকর আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, যা প্রকৃতির সমস্ত নীরবতাকে ভেঙে দিল, এবং শহরের প্রতিটি মানুষকে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিল।
বিস্ফোরণের পর অরুণিমা দ্রুত সিদ্ধার্থের দিকে ঘুরলেন। সিদ্ধার্থ তখন ওয়াচটাওয়ারের কিনারা ধরে দাঁড়িয়েছিল, তার চোখ শূন্যে স্থির। তার প্রতিশোধের ‘মাস্টারপিস’ সম্পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু তার মুখে কোনো আনন্দ ছিল না, বরং এক ধরণের গভীর শূন্যতা। সে যেন তার সমস্ত উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে, তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তার চোখে এক ধরণের ক্লান্তি এবং অবসাদ, যেন দীর্ঘদিনের ঘুম তার চোখে নেমে এসেছে। তার প্রতিশোধের আগুন নিভে গেছে।
সুব্রত রায় ততক্ষণে সিদ্ধার্থের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে নিরস্ত্র করেছেন। সিদ্ধার্থ কোনো প্রতিরোধ করল না। সে যেন তার সমস্ত শক্তি, তার সমস্ত উন্মাদনা সেই বিস্ফোরণের সাথে নিঃশেষ করে ফেলেছে। তার চোখে এক ধরণের ক্লান্তি এবং অবসাদ। তার প্রতিশোধের আগুন নিভে গেছে, এবং তার জায়গায় এক গভীর শূন্যতা বাসা বেঁধেছে।
পুলিশ টিম দ্রুত ওয়াচটাওয়ারে পৌঁছাল এবং সিদ্ধার্থকে গ্রেফতার করল। তার হাতে হাতকড়া পরানো হলো। সে কোনো কথা বলল না, শুধু শূন্য দৃষ্টিতে দার্জিলিং শহরের দিকে তাকিয়ে রইল, যেখানে তার প্রতিশোধের চিহ্নগুলো এখন কেবল স্মৃতি হয়ে থাকবে। তার মুখে ছিল এক ধরণের নীরব স্বীকারোক্তি, যেন সে বুঝতে পারছিল যে তার প্রতিশোধ তাকে কোনো শান্তি দিতে পারেনি, বরং তাকে আরও একা করে দিয়েছে।
অরুণিমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। দার্জিলিং শহর রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা শহরের মানুষের মনে এক গভীর ক্ষত রেখে গেল। সিদ্ধার্থের প্রতিশোধের আগুন নিভে গেলেও, তার বার্তা সমাজের বুকে এক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরল – পুরনো পাপের ফল কি আসলেই বর্তমান প্রজন্মকে ভোগ করতে হয়? মৌন উপত্যকার বুকে চূড়ান্ত লড়াই শেষ হলো। কিন্তু এই নীরবতা এবার অনেক বেশি প্রশ্ন নিয়ে ফিরে এসেছে, যা দার্জিলিংয়ের ইতিহাসকে চিরতরে বদলে দেবে। এই পাহাড়, যা এতদিন নীরব সাক্ষী ছিল, এবার তার বুকে এক নতুন গল্প বয়ে নিয়ে যাবে, প্রতিশোধ, যন্ত্রণা, এবং ন্যায়বিচারের এক জটিল গল্প।
~সমাপ্ত~
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion