Episode 91242 words0 views

মৌন উপত্যকা : নবম অধ্যায়

ফাঁদ পাতা সিদ্ধার্থের ল্যাবরেটরিতে সেই তীব্র মুখোমুখি সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল। সিদ্ধার্থকে নিরস্ত্র করা সহজ ছিল না। তার চোখে যে উন্মাদনা ছিল, তা তাকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছিল। অরুণিমা এবং সুব্রত রায় যখন তাকে ঘিরে ধরেছিল, তখন সে হঠাৎ করে তার হাতের একটি ছোট যন্ত্রের বোতাম টিপে দিল। মুহূর্তেই ঘরের ভেতরে একটি তীব্র, কান ফাটানো সাইরেন বেজে উঠল, যা পুরো বাংলো জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। একই সাথে, ঘরের কোণে রাখা একটি বিশেষ চেম্বার থেকে একটি শক্তিশালী, ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী দ্রুত ঘরটিকে ঢেকে দিল। ধোঁয়াটি এত ঘন ছিল যে এক হাতের দূরত্বেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। “সাবধান, ইন্সপেক্টর! ধোঁয়া!” অরুণিমা চিৎকার করে উঠলেন, তার কণ্ঠস্বর সাইরেনের শব্দের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছিল। তিনি দ্রুত তার মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকলেন। সুব্রত রায়ও একই কাজ করলেন এবং দ্রুত প্রিয়াঙ্কা এবং রাহুলকে আটকে রাখা কক্ষের দিকে ছুটে গেলেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। ধোঁয়ার মধ্যে তাদের কাশি শোনা যাচ্ছিল। ধোঁয়ার আড়ালে সিদ্ধার্থ বিদ্যুৎ গতিতে সরে গেল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পূর্বপরিকল্পিত। অরুণিমা তার দিকে গুলি ছুড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু ধোঁয়ার কারণে লক্ষ্য স্থির করা অসম্ভব ছিল। সাইরেনের তীব্র শব্দে তাদের কানে তালা লেগে যাচ্ছিল, যা তাদের মনোযোগ বিঘ্নিত করছিল। সিদ্ধার্থের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট – এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে পালানো। সে জানত পুলিশ তাকে ঘিরে ধরেছে, তাই পালানোর জন্য সে এই জরুরি ব্যবস্থা রেখেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়া কিছুটা হালকা হলো, যদিও সাইরেন তখনও বাজছিল। অরুণিমা দেখলেন, সিদ্ধার্থ বাংলোর পেছনের একটি গোপন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছে। দরজাটি এত সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে প্রথমবার তল্লাশির সময় তা নজরে আসেনি। এটি একটি ঘূর্ণায়মান দেওয়াল ছিল, যা তার ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতারই প্রমাণ। সুব্রত রায় দ্রুত প্রিয়াঙ্কা এবং রাহুলকে উদ্ধার করলেন। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হলেও অক্ষত ছিল, শুধু ধোঁয়ার কারণে কিছুটা কাশি হচ্ছিল। তাদের চোখগুলো ভয়ে বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। “ম্যাডাম, সে পালিয়েছে!” সুব্রত রায় হতাশ কণ্ঠে বললেন, তার মুখে স্পষ্টতই বিরক্তি। “আমরা তাকে হাতের কাছে পেয়েও ধরতে পারলাম না।” অরুণিমা তার হতাশা দমন করলেন। তার মুখ দৃঢ় ছিল। “সে পালিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে আমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু রেখে গেছে, ইন্সপেক্টর। তার ল্যাবরেটরি। তার যন্ত্রাংশ। তার পরিকল্পনা।” তারা বাংলোর ভেতরে সিদ্ধার্থের ল্যাবরেটরিটি পরীক্ষা করতে লাগলেন। টেবিলে পড়ে থাকা যন্ত্রাংশগুলো ছিল অত্যন্ত আধুনিক এবং সূক্ষ্ম। একটি ছোট ডিভাইস, যা সম্ভবত ধাতব কণা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, সেটিও টেবিলে পড়ে ছিল। ডিভাইসটি একটি ছোট লেজার খোদাই যন্ত্রের মতো দেখতে ছিল, যার পাশে টাইটানিয়াম-নিকেলের ছোট ছোট টুকরো পড়ে ছিল। দেয়ালের ম্যাপটি অরুণিমার চোখে পড়ল। ম্যাপে দার্জিলিংয়ের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাল কালিতে চিহ্নিত করা হয়েছে – মুখার্জী এবং বর্মা পরিবারের বাড়ি, এবং তৃতীয় একটি স্থান, যা ছিল দার্জিলিংয়ের একটি পুরনো স্কুল, ‘সেন্ট পলস একাডেমি’। ম্যাপের উপর কিছু জটিল গাণিতিক সূত্র এবং তারিখ লেখা ছিল, যা তার পরিকল্পনার গভীরতা প্রকাশ করছিল। একটি তারিখ বিশেষভাবে অরুণিমার নজর কাড়ল – পরের দিন, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর, একটি নির্দিষ্ট সময় চিহ্নিত করা ছিল। “সেন্ট পলস একাডেমি?” অরুণিমা বিড়বিড় করলেন, তার চোখে এক ধরণের নতুন উপলব্ধি। “কেন এই স্কুল? প্রিয়াঙ্কা এবং রাহুল দুজনেই এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু এর সাথে সিদ্ধার্থের কী সম্পর্ক?” সুব্রত রায় বললেন, “ম্যাডাম, সিদ্ধার্থের পুরনো স্কুল রেকর্ড চেক করার সময় আমরা জেনেছিলাম যে সেও এই সেন্ট পলস একাডেমিতেই পড়াশোনা করত। যদিও সে ধর্মঘটের পর শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছিল, কিন্তু তার প্রাথমিক পড়াশোনা এখানেই হয়েছিল। সে এই স্কুলের একজন মেধাবী ছাত্র ছিল, কিন্তু তার মামার ঘটনার পর তাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল।” অরুণিমা বুঝতে পারলেন। সেন্ট পলস একাডেমি। এটি কেবল একটি স্কুল নয়, এটি সিদ্ধার্থের শৈশবের স্মৃতি, তার যন্ত্রণার শুরু। সে হয়তো তার পরবর্তী শিকারকে এই স্কুল থেকে বেছে নেবে, অথবা এই স্কুলকে তার প্রতিশোধের চূড়ান্ত মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করবে। সে চায় তার প্রতিশোধের বার্তা যেন এই স্কুলের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছায়। তিনি তৎক্ষণাৎ ড. প্রবীর মিত্রকে ফোন করলেন। ড. মিত্র সমস্ত ঘটনা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, যেন তার মনের গভীরে সিদ্ধার্থের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করছিলেন। “ডিটেক্টিভ সেনগুপ্ত, সিদ্ধার্থের মনস্তত্ত্ব এখন আরও স্পষ্ট,” ড. মিত্র বললেন, তার কণ্ঠস্বরে এক ধরণের উদ্বেগ। “সে তার প্রতিশোধকে একটি চক্র হিসেবে দেখছে। সে চায় তার শিকাররা তার যন্ত্রণার উৎস সম্পর্কে জানুক। সেন্ট পলস একাডেমি তার শৈশবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সে হয়তো সেখানে এমন কিছু করতে চায়, যা তার প্রতিশোধের বার্তা আরও জোরালো করবে, যা সমাজের চোখে একটি বড় আঘাত হবে। সে চায় তার ‘শিল্পকর্ম’ যেন অমর হয়ে থাকে।” “তার মানে, সে হয়তো তৃতীয় কোনো অপহরণের চেষ্টা করবে, এবং সেটা সেন্ট পলস একাডেমির সাথে সম্পর্কিত হবে,” অরুণিমা বললেন, তার মন দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছিল। “অথবা সে সরাসরি স্কুলকে টার্গেট করবে।” “সম্ভবত,” ড. মিত্র বললেন। “অথবা সে সরাসরি স্কুলকে টার্গেট করতে পারে, যা তার প্রতিশোধের চূড়ান্ত ধাপ হবে। সে হয়তো চায় তার প্রতিশোধের বার্তা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ুক, যা কেউ কখনো ভুলতে পারবে না। মনে রাখবেন, তার উদ্দেশ্য শুধু ক্ষতি করা নয়, বরং একটি বার্তা দেওয়া, একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।” অরুণিমা দ্রুত থানায় ফিরে এলেন। প্রiaঙ্কা এবং রাহুলকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলেও, মানসিক আঘাত ছিল স্পষ্ট। প্রিয়াঙ্কা কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আর রাহুল নির্বাক হয়ে বসেছিল, তার চোখ দুটি শূন্য। তাদের কাছ থেকে সিদ্ধার্থ সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। সিদ্ধার্থ তাদের সাথে খুব বেশি কথা বলেনি, কিন্তু সে তাদের পরিবারের অতীত সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিল, বিশেষ করে ১৯৭৯ সালের ধর্মঘটের কথা এবং তাদের পরিবারের ভূমিকার কথা। সে তাদের বলেছিল, “তোমাদের বাবা-মায়েরা যা করেছে, তার ফল তোমাদের ভোগ করতে হবে। এই পাহাড়ের মাটি তোমাদের পাপের সাক্ষী।” তার প্রতিটি কথা ছিল প্রতিশোধের আগুনে ভরা। অরুণিমা এবং সুব্রত রায় সেন্ট পলস একাডেমির নিরাপত্তা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্কুলের চারপাশে সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করা হলো। স্কুলের প্রতিটি প্রবেশপথ এবং নির্গমণ পথে নজরদারি বাড়ানো হলো। এমনকি স্কুলের ছাদেও কিছু পুলিশ অফিসারকে মোতায়েন করা হলো, যারা দূর থেকে স্কুলের প্রতিটি অংশ পর্যবেক্ষণ করছিল। স্কুলের ভেতরে এবং বাইরে গোপন ক্যামেরা স্থাপন করা হলো। অরুণিমা জানতেন, সিদ্ধার্থ একজন বুদ্ধিমান অপরাধী, সে হয়তো সরাসরি আক্রমণ করবে না, বরং একটি ফাঁদ পাতবে, যা তাকে তার চূড়ান্ত প্রতিশোধের সুযোগ দেবে। “ইন্সপেক্টর, আমরাও একটা ফাঁদ পাতব,” অরুণিমা বললেন, তার চোখে এক ধরণের শীতল সংকল্প। “সিদ্ধার্থ চায় তার প্রতিশোধের বার্তা সবার কাছে পৌঁছাক। আমরা তাকে সেই সুযোগ দেব, কিন্তু আমাদের শর্তে। আমরা তাকে বিশ্বাস করাব যে সে সফল হয়েছে, এবং তারপর তাকে ধরব।” তারা সংবাদমাধ্যমকে একটি গোপন ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। সেখানে প্রিয়াঙ্কা এবং রাহুলকে উদ্ধারের খবর জানানো হলো, কিন্তু সিদ্ধার্থের পালানোর কথা গোপন রাখা হলো। বরং, বলা হলো যে পুলিশ অপরাধীকে ধরতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু তার পরিচয় এখন প্রকাশ করা হবে না, তদন্তের স্বার্থে। এই খবরটি দ্রুত শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। এর উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধার্থকে বিভ্রান্ত করা, তাকে বিশ্বাস করানো যে সে এখনও ধরা পড়েনি, এবং তাকে তার পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা। অরুণিমা জানতেন, সিদ্ধার্থ তার ‘মাস্টারপিস’ প্রতিশোধের খবর জানতে চাইবে, এবং যখন সে দেখবে যে পুলিশ তাকে ধরার মিথ্যা দাবি করছে, তখন সে হয়তো আরও বড় কিছু করার চেষ্টা করবে, যাতে তার প্রতিশোধের বার্তা স্পষ্ট হয়। সিদ্ধার্থ, তার গোপন আস্তানায় বসে সংবাদপত্রের খবর দেখছিল। যখন সে দেখল যে পুলিশ তাকে ধরার মিথ্যা দাবি করছে, তখন তার মুখে একটি বিকৃত হাসি ফুটে উঠল। “তারা ভাবে তারা আমাকে ফাঁদে ফেলেছে? তারা জানে না, খেলাটা কেবল শুরু হয়েছে।” তার চোখে প্রতিশোধের আগুন আরও তীব্র হলো। সে জানত, পুলিশ তাকে খুঁজছে, কিন্তু সে তাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে ছিল। সে তার চূড়ান্ত পরিকল্পনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তার হাতে একটি ছোট রিমোট কন্ট্রোল, যা দিয়ে সে তার চূড়ান্ত ‘মাস্টারপিস’টি সক্রিয় করবে। সেন্ট পলস একাডেমির আশেপাশের প্রতিটি কোণে পুলিশ মোতায়েন করা হলো। স্কুলের ভেতরে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হলো, যেখানে অরুণিমা এবং সুব্রত রায় বসেছিলেন। তারা স্কুলের প্রতিটি কোণে নজর রাখছিলেন, প্রতিটি ছোট নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল, এবং প্রতিটি টিক টিক শব্দ যেন তাদের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছিল। পাহাড়ের কুয়াশা আরও ঘন হয়ে আসছিল, যেন এক অদৃশ্য জাল বুনছিল, যার ভেতরে এবার অপরাধী নিজেই ধরা পড়তে চলেছে। মৌন উপত্যকা এবার তার চূড়ান্ত নীরবতা ভাঙার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, এক ভয়ংকর সংঘাতের জন্য। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion