কলকাতা, ২০৪০ সাল।
শহরটা আর আগের মতো নেই। স্কাইলাইনের বুক চিরে ছুটে চলেছে উড়ন্ত গাড়ি, তাদের নিঃশব্দ গতিপথের নিচে পুরনো কলকাতার হলুদ ট্যাক্সিগুলো যেন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী। নিওন আলোয় ভেসে যায় রাতের রাজপথ, হলোগ্রাম বিজ্ঞাপনগুলো কাঁচের দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে এক অপার্থিব জগৎ তৈরি করে। কিন্তু এই প্রযুক্তির মোড়কের আড়ালে মানুষের মনটা আজও একইরকম—একাকী, স্মৃতি কাতর।
নীলাদ্রি সেনগুপ্তের জীবনটাও ঠিক তাই। এক বছর আগে এক তথাকথিত পথ দুর্ঘটনায় স্ত্রী ইরাকে হারানোর পর থেকে তার পৃথিবীটা ধূসর হয়ে গেছে। বালিগঞ্জের তিন কামরার ফ্ল্যাটটা এখন একটা বিশাল সমাধির মতো মনে হয়, যেখানে সে নিজেই জীবন্ত শব। প্রতিটি কোণে শুধু ইরার স্মৃতি—তার হাসি, তার হাতের চায়ের কাপ, বইয়ের তাকের ওপর তার ফেলে যাওয়া চশমাটা, ব্যালকনির টবে লাগানো তার প্রিয় হাসনুহানা গাছটা, যা এখন অযত্নে শুকিয়ে কাঠ। এই স্মৃতিগুলোই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, আবার তিলে তিলে শেষও করে দিচ্ছে। নীলাদ্রি একটি প্রথম সারির বিজ্ঞাপন সংস্থায় গ্রাফিক ডিজাইনারের কাজ করত। তার ডিজাইন করা হলোগ্রাম শহরের আকাশে ভাসত। ইরার মৃত্যুর পর সে কাজটাও ছেড়ে দিয়েছে। তার জগৎ এখন এই ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দিনের বেলা পর্দা টানা থাকে, রাতের বেলা সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উড়ন্ত গাড়ির ছুটে চলা দেখে আর ভাবে, এর কোনোটায় পিষ্ট হয়েই কি ইরা চলে গেল?
তার একমাত্র যোগসূত্র ছিল তার ছোট ভাই বিক্রম। বিক্রম ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত—বাস্তববাদী, যুক্তিনির্ভর এবং প্রযুক্তিতে পারদর্শী এক সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট। সে প্রায়ই আসত, দাদাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করত।
“দাদা, এভাবে আর কতদিন? তোকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে,” বিক্রম একদিন কফি বানাতে বানাতে বলল।
নীলাদ্রি শূন্য দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। “কীভাবে শুরু করব? আমার সব তো ওই এক দিনেই শেষ হয়ে গেছে। আমার পৃথিবীটাকেই তো ওরা কেড়ে নিয়েছে।”
“আমি জানি এটা কঠিন। কিন্তু ইরা বৌদিও চাইত না তুই এভাবে নিজেকে শেষ করে দিস। অন্তত ওর জন্য তোকে স্বাভাবিক হতে হবে।”
বিক্রমের কথাগুলো নীলাদ্রির কানে ঢুকছিল, কিন্তু মনে পৌঁছাচ্ছিল না। তার মন পড়ে ছিল এক বছর আগের সেই অভিশপ্ত সন্ধ্যায়।
একদিন রাতে, অনিদ্রায় ছটফট করতে করতে ইন্টারনেটে ঘুরতে ঘুরতে নীলাদ্রির চোখে পড়ল এক বিজ্ঞাপন—”নস্টালজিয়া: আপনার হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনি। অতীতকে আবার বাঁচুন, আগের মতোই স্পষ্ট।”
এটি ছিল এক নতুন প্রযুক্তি সংস্থা, যারা মানুষের মস্তিষ্ক থেকে মুছে যাওয়া বা আবছা হয়ে যাওয়া স্মৃতিকে ডিজিটালভাবে পুনরুদ্ধার করার পরিষেবা দিত। বিজ্ঞাপনটা দেখে নীলাদ্রির বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। ইরাকে ফিরে পাওয়ার কোনো উপায় নেই, কিন্তু তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো যদি আবার আগের মতো স্পষ্ট করে বাঁচা যায়? এই ভাবনাটা তাকে পেয়ে বসল। সে ‘নস্টালজিয়া’-র ওয়েবসাইটে ঢুকল। তাদের ঝাঁ-চকচকে প্রেজেন্টেশন, সফল ক্লায়েন্টদের প্রশংসাপত্র, এমনকি মনোবিদদের প্রশংসাপত্রও রয়েছে—সবকিছুই খুব আকর্ষণীয়।
পরের দিনই নীলাদ্রি বিক্রমকে কিছু না জানিয়ে पोहोचালো ‘নস্টালজিয়া’-র অফিসে। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের এক কাঁচের টাওয়ারে তাদের দপ্তর। রিসেপশন থেকে শুরু করে ভেতরের পরিবেশ—সবকিছুতেই এক ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ছাপ। সেখানে এক শান্ত, সৌম্য চেহারার মহিলা, ডক্টর সেন, তাকে পুরো প্রক্রিয়াটা বোঝালেন।
“দেখুন মিস্টার সেনগুপ্ত,” ডক্টর সেন নরম গলায় বললেন, “আমরা স্মৃতি তৈরি করি না, আমরা শুধু আপনার মস্তিষ্কে থাকা নিউরাল ছাপগুলোকে পুনরুদ্ধার করি। ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের মাধ্যমে আপনার মস্তিষ্কের সেই প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে আমরা সেগুলোকে একটি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR) প্ল্যাটফর্মে পুনর্নির্মাণ করব। আপনি যখন খুশি সেই স্মৃতির জগতে প্রবেশ করতে পারবেন। এটা অনেকটা পুরনো ভিডিও টেপ রিস্টোর করার মতো।”
“এর কোনো ঝুঁকি আছে?” নীলাদ্রি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল।
“সামান্যই,” ডক্টর সেন হাসলেন। “মাঝে মাঝে মাথা ধরা বা সামান্য বিভ্রান্তি হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রযুক্তি সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমরা আপনার ব্রেনওয়েভের সাথে সিনক্রোনাইজ করে নিই, তাই কোনো বড় সমস্যা হয় না।”
নীলাদ্রি মরিয়া ছিল। সে রাজি হয়ে গেল। প্রথম সেশনের জন্য একটা মোটা টাকা জমা দিয়ে সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিল।
প্রথম সেশনটা ছিল অসাধারণ। একটা আরামদায়ক ঘরে, নরম সোফায় শুইয়ে তার মাথায় একটা মসৃণ হেলমেট পরিয়ে দেওয়া হলো। VR হেডসেট চোখে লাগাতেই প্রথমে শুধু অন্ধকার, তারপর ধীরে ধীরে দৃশ্য ফুটে উঠল। নীলাদ্রি নিজেকে আবিষ্কার করল তাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনে—কলেজ স্ট্রিটের সেই বইয়ের দোকান, বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি, আর বইয়ের তাকের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া ইরার ভেজা চুলের গন্ধমাখা মুখ। সবকিছু এতটাই জীবন্ত যে নীলাদ্রি ভুলে গেল এটা বাস্তব নয়। সে হাত বাড়িয়ে ইরাকে ছুঁতে গেল, কিন্তু তার আঙুলগুলো বাতাস ছুঁয়ে গেল। তবুও, এই অনুভূতি ছিল অমূল্য।
এরপর একে একে ফিরে আসতে লাগল তাদের বিয়ের দিন, দার্জিলিং-এ কাটানো মধুচন্দ্রিমা, মাঝরাতে ছাদে বসে কফি খাওয়ার মুহূর্তগুলো। নীলাদ্রি যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেল। সে দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটাতে লাগল সেই ভার্চুয়াল জগতে। বিক্রম যখন আসত, সে বলত সে ভালো আছে, কাজে ফেরার কথা ভাবছে। ভাইটাকে সে এই ভার্চুয়াল জগতের কথা জানাতে চায়নি। এটা ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত পলায়নের পথ।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর থেকে সমস্যাটা শুরু হলো।
একদিন সে তাদের বিবাহবার্ষিকীর স্মৃতি দেখছিল। তাদের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে একটা ঘরোয়া পার্টি চলছে। বন্ধুরা সব এসেছে, হালকা গান বাজছে। নীলাদ্রি দেখল, সে নিজে বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। কিন্তু তার চোখ খুঁজছিল ইরাকে। ইরা সেখানে ছিল না। হঠাৎ তার চোখ গেল বারান্দার দিকে। ইরা সেখানে দাঁড়িয়ে অন্য কারো সাথে কথা বলছে। লোকটার মুখটা আবছা, হলোগ্রামের মতো কাঁপছে, কিন্তু তার চোখেমুখে তীব্র উদ্বেগ। ইরা ফিসফিস করে তাকে কিছু একটা বলছে, যা নীলাদ্রি শুনতে পাচ্ছে না। এই দৃশ্যটা তার চেনা নয়। তার স্মৃতিতে এমন কোনো ঘটনা ছিল না। সে চেষ্টা করল ইরার কাছে যাওয়ার, কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের নিয়ম অনুযায়ী সে শুধু একজন দর্শক। সে নিজের পুরনো শরীরটাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, নতুন করে কিছু করতে পারে না।
সেশন শেষে নীলাদ্রি ব্যাপারটা ‘নস্টালজিয়া’-কে জানাল। ডক্টর সেন তাকে বোঝালেন, “এটাকে আমরা ‘মেমরি আর্টিফ্যাক্ট’ বলি। স্মৃতি পুনর্নির্মাণের সময় কিছু অসঙ্গতি বা ‘গ্লিচ’ আসতেই পারে। মস্তিষ্ক খুব জটিল একটা জিনিস। মাঝে মাঝে সে দুটো ভিন্ন স্মৃতিকে মিলিয়ে ফেলে অথবা শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য কাল্পনিক দৃশ্য তৈরি করে। চিন্তার কিছু নেই।”
নীলাদ্রি মনকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু অস্বস্তিটা গেল না।
এরপর থেকে এমন ঘটনা বাড়তে লাগল। সে দেখল, ইরা প্রায়ই গভীর রাতে ল্যাপটপে কিছু একটা কাজ করছে, যা সে আগে কখনো দেখেনি। নীলাদ্রি তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলত, অফিসের কাজ। কিন্তু এই স্মৃতির জগতে সে দেখল, ইরার মুখটা কঠিন, চোখেমুখে একটা চাপা উত্তেজনা। একবার সে দেখল, ইরা শহরের এক অন্ধকার গলিতে, সম্ভবত চায়না টাউনের কোনো রাস্তায়, এক অপরিচিত লোকের হাতে একটা প্যাকেট তুলে দিচ্ছে। দৃশ্যগুলো ছিল খাপছাড়া, কিন্তু প্রতিটিতেই ছিল এক গোপনীয়তার ছাপ। ইরার যে মুখটা সে চিনত—সরল, হাসিখুশি—তার সাথে এই চেহারাটা একেবারেই মিলছিল না।
নীলাদ্রি ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করল। কোনটা আসল স্মৃতি আর কোনটা প্রযুক্তির তৈরি বিভ্রম, তা সে গুলিয়ে ফেলতে লাগল। সে কি তার স্ত্রীকেই দেখছে, নাকি অন্য কাউকে? এই প্রযুক্তি কি নিছকই স্মৃতি পুনরুদ্ধার করছে, নাকি তার অবচেতনে লুকিয়ে থাকা ভয়গুলোকে উস্কে দিচ্ছে? সে কি ইরাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে? এই ভাবনাটা তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion