নীলাদ্রির পরিবর্তনটা বিক্রমের চোখ এড়াল না। সে দেখল, তার দাদা আগের চেয়েও বেশি আনমনা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে একা একা কথা বলে, আবার কখনও হুট করে চমকে ওঠে।
“দাদা, তোর কি হয়েছে বল তো? তুই কি কোনো ডাক্তারের সাথে কথা বলবি?”
“আমি ঠিক আছি,” নীলাদ্রি জোর করে হাসল। “কাজের চাপ, বুঝলিই তো।”
“কাজ? তুই তো কাজে যাচ্ছিস না।”
নীলাদ্রি কথা ঘুরিয়ে নিল। সে ঠিক করল, এই রহস্যের শেষ তাকেই দেখতে হবে। সে ডক্টর সেনকে অনুরোধ করল আরও গভীরে যাওয়ার জন্য, ইরার জীবনের শেষ কয়েক মাসের স্মৃতি সে দেখতে চায়। ডক্টর সেন প্রথমে ইতস্তত করলেও, ক্লায়েন্টের অনুরোধ ফেলতে পারলেন না।
পরবর্তী সেশনগুলো ছিল আরও ভয়ঙ্কর। নীলাদ্রি দেখল, ইরার জীবনে যেন একটা দ্বিতীয় সত্তা ছিল, যার খবর সে রাখত না। সে দেখল, ইরা বিভিন্ন ছদ্মবেশে শহরের নানা জায়গায় যাচ্ছে, মানুষের সাথে কথা বলছে, ছবি তুলছে। একবার সে দেখল, ইরা পার্ক সার্কাসের এক পুরনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার গায়ে লেখা “মডার্ন ক্লিনিক”। কিন্তু ক্লিনিকটা দেখে পরিত্যক্ত মনে হচ্ছিল।
এই দৃশ্যটা দেখার পর নীলাদ্রি আর স্থির থাকতে পারল না। সেশন শেষ করে সে সোজা বিক্রমের কাছে গেল।
“বিক্রম, পার্ক সার্কাসে ‘মডার্ন ক্লিনিক’ বলে কোনো জায়গা চিনিস?”
বিক্রম অবাক হয়ে বলল, “মডার্ন ক্লিনিক? ওটা তো দশ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ওখানে এখন একটা গুদাম আছে। কেন রে?”
নীলাদ্রি সবটা খুলে বলল। ‘নস্টালজিয়া’ থেকে শুরু করে তার দেখা অদ্ভুত স্মৃতি—সবকিছু।
সব শুনে বিক্রমের মুখটা কঠিন হয়ে গেল। “দাদা, তুই বুঝতে পারছিস তুই কীসের মধ্যে নিজেকে জড়াচ্ছিস? এটা একটা স্ক্যাম। ওরা তোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে টাকা কামাচ্ছে আর তোর মাথায় যা খুশি তাই ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তুই এক্ষুনি এটা বন্ধ কর।”
“না বিক্রম,” নীলাদ্রির গলায় ছিল জেদ। “আমি যা দেখেছি, তা সবটা কাল্পনিক হতে পারে না। এর মধ্যে কোথাও একটা সত্যি লুকিয়ে আছে। ইরা আমার থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছিল।”
“লুকোচ্ছিল, নাকি তুই এখন তাই ভাবতে চাইছিস? দাদা, বৌদি তোকে খুব ভালোবাসত। তুই ওর স্মৃতিকে এভাবে অপমান করিস না।”
দুই ভাইয়ের মধ্যে তীব্র কথা কাটাকাটি হলো। বিক্রম রেগে চলে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে বলে গেল, “যদি কোনো সমস্যায় পড়িস, আমাকে জানাস।”
নীলাদ্রি একা হয়ে গেল। কিন্তু তার জেদ আরও বাড়ল। সে ঠিক করল, ভার্চুয়াল জগতের সূত্র ধরে সে বাস্তব জগতে তদন্ত করবে। পরের দিন সে সেই ‘মডার্ন ক্লিনিক’-এর ঠিকানায় গেল। জায়গাটা সত্যিই পরিত্যক্ত। কিন্তু নীলাদ্রি দেখল, গুদামের এক কোণে একটা নতুন তালা লাগানো। তার মনে হলো, ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু আছে। কিন্তু সে ভেতরে ঢুকতে পারল না।
সে চায়না টাউনের সেই গলিটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। অনেক ঘোরার পর একটা সরু গলি তার পরিচিত মনে হলো। সেখানে একটা চায়ের দোকানে সে ইরার একটা ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই মহিলাকে তারা কখনো দেখেছে কিনা। দোকানি প্রথমে না বললেও, কিছু টাকা দিতেই জানাল, হ্যাঁ, দেখেছে। মহিলাটি প্রায়ই আসত, আর এক বিশেষ লোকের সাথে কথা বলত।
নীলাদ্রির শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তাহলে সে যা দেখছে, তার কিছুটা অন্তত সত্যি।
একদিন রাতে, এক ভয়াবহ স্মৃতি দেখার পর নীলাদ্রির ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখল, ইরা এক পরিত্যক্ত গুদামে দাঁড়িয়ে আছে—যেটা অনেকটা সেই ‘মডার্ন ক্লিনিক’-এর ভেতরের মতো। তার সামনে সেই আবছা মুখটা, কিন্তু এবার লোকটার হাতে একটা পিস্তল।
“তুমি বড্ড বেশি জেনে গেছ, ইরা,” লোকটা হিসহিস করে বলল।
“সত্যিটা একদিন সামনে আসবেই,” ইরার গলায় কোনো ভয় ছিল না।
তীব্র তর্কাতর্কির পর একটা গুলির শব্দ… আর তারপর সব অন্ধকার।
এই দৃশ্যটা নীলাদ্রিকে নাড়িয়ে দিল। এটা কোনো ‘গ্লিচ’ হতে পারে না। এটা ছিল একটা हत्याর স্মৃতি। সে বুঝতে পারল, এর পেছনে কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। তার তথাকথিত ‘পথ দুর্ঘটনা’-টা আসলে ছিল একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
সে ‘নস্টালজিয়া’-র সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করল। ডক্টর সেন তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু নীলাদ্রি আর তার ফাঁদে পা দিল না।
সে বাড়ি ফিরে এল। তার মাথা কাজ করছিল না। সে যদি সত্যিটা প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে সবাই তাকে পাগল ভাববে। হঠাৎ তার মনে পড়ল ইরার পুরনো ল্যাপটপটার কথা। ইরা ওটা খুব কম ব্যবহার করত, বলত ওটা নাকি তার ‘গোপন সিন্দুক’। ল্যাপটপটা স্টোর রুমে রাখা ছিল।
নীলাদ্রি সেটা বের করল। অনেক চেষ্টার পর পাসওয়ার্ডটা ভাঙতে পারল—তাদের মেয়ের অকালপ্রয়াণের পর যে নামটা তারা ঠিক করে রেখেছিল, ‘মিষ্টি’।
ল্যাপটপ খুলতেই নীলাদ্রির পৃথিবীটা যেন ওলটপালট হয়ে গেল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion