Episode 41116 words0 views

চতুর্থ ভাগ : শেষ চাল

গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া নীলাদ্রির মুখে এসে লাগছিল, কিন্তু তার ভেতরের ভয় কমছিল না। পেছনে রিষড়ার ঘাট অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিপদ যে মিলিয়ে যায়নি, তা সে জানত। ফারজানা নৌকা চালাচ্ছিল, তার মুখ কঠিন। “এখন কোথায় যাব?” নীলাদ্রি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল। “এমন কোথাও, যেখানে ওরা আমাদের খুঁজে পাবে না। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য,” ফারজানা উত্তর দিল। তারা চন্দননগরের কাছে এক পুরনো, প্রায়-পরিত্যক্ত ঘাটে এসে নামল। বিক্রমের কথামতো, সেখানে তাদের জন্য একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিল। পরের কয়েকটা দিন তাদের কাটল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে। তারা বুঝতে পারছিল, হর্ষবর্ধন রথী শুধু শক্তিশালী নয়, তার জাল অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো। তারা যে হোটেলেই উঠছিল, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের ঘর বদলাতে হচ্ছিল। একবার ডানকুনিতে একটা ধাবার বাইরে খেতে বসে তারা দেখল, কালো কাঁচের একটা গাড়ি তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কোনোমতে তারা ধাবার রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল। এই পালিয়ে বেড়ানোর মধ্যেই বিক্রম আর ফারজানা মিলে প্রমাণগুলো সাজাচ্ছিল। কিন্তু তারা বুঝতে পারছিল, শুধু প্রমাণ থাকলেই হবে না। এমন একজনের কাছে পৌঁছাতে হবে, যাকে রথী কিনতে পারেনি। “ইন্সপেক্টর রায়চৌধুরী,” ফারজানা বলল। “ইরা ওনার কথা বলেছিল। উনি সৎ, কিন্তু সিস্টেমের চাপে কোণঠাসা।” “কিন্তু আমরা ওনার কাছে পৌঁছাব কী করে? লালবাজার এখন ওদের দুর্গ,” নীলাদ্রি বলল। “সরাসরি যাওয়া যাবে না,” বিক্রম একটা সুরক্ষিত ভিডিও কলে বলল। “তোমাদের অন্য পথ ধরতে হবে। আমি রায়চৌধুরীর এক জুনিয়র অফিসারের খোঁজ পেয়েছি। সাব-ইন্সপেক্টর অভিরূপ চ্যাটার্জী। ছেলেটা নতুন, কিন্তু খুব বুদ্ধিমান আর টেক-স্যাভি। সিস্টেম ওকে এখনো পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। ওর সাথে যোগাযোগ করতে হবে।” লালবাজারের সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর রায়চৌধুরীর ঘরে বসে নীলাদ্রি যখন সবটা বলছিল, তার গলা কাঁপছিল। ভিআর স্মৃতি, খুন, পালানো—সবটা সিনেমার গল্পের মতো শোনাচ্ছিল। রায়চৌধুরী সবটা মন দিয়ে শুনলেন, তার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সব শোনার পর তিনি ইন্টারকমে কাউকে ডাকলেন। “অভিরূপ, একবার আমার ঘরে এসো।” কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে ঢুকল সাব-ইন্সপেক্টর অভিরূপ চ্যাটার্জী। তিরিশের কোঠায় বয়স, চোখে ধারালো বুদ্ধি আর আত্মবিশ্বাসের ছাপ। সে এই প্রজন্মের পুলিশ অফিসার—প্রযুক্তিতে পারদর্শী এবং যুক্তিতে বিশ্বাসী। “স্যার,” অভিরূপ ঘরে ঢুকে নীলাদ্রি আর ফারজানার দিকে তাকাল। রায়চৌধুরী সংক্ষেপে তাকে সবটা বললেন। অভিরূপের ভুরু কুঁচকে গেল। “ভিআর স্মৃতি? স্যার, আপনি কি সত্যিই ভাবছেন এই ধরনের ‘প্রমাণ’-এর ওপর ভিত্তি করে আমরা হর্ষবর্ধন রথীর মতো লোকের বিরুদ্ধে নামতে পারি?” তার গলায় অবিশ্বাসের সুর স্পষ্ট। “আমি প্রমাণ দেখতে চাই, গল্প নয়,” অভিরূপ সরাসরি ফারজানার দিকে তাকিয়ে বলল। ফারজানা ল্যাপটপটা এগিয়ে দিল। অভিরূপ সেটা নিয়ে নিজের কনসোলে প্লাগ করল। তার আঙুলগুলো কি-বোর্ডের ওপর দিয়ে দ্রুত চলতে লাগল। বিক্রম আগে থেকেই একটা সুরক্ষিত লাইনে অপেক্ষা করছিল। অভিরূপ আর বিক্রম, দুই ভিন্ন জগতের দুই প্রযুক্তিবিদ, একসাথে সেই ডিজিটাল দুর্গে প্রবেশ করল। প্রথমে অভিরূপের মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছিল। কিন্তু যত সে ডেটার গভীরে যেতে লাগল, তার মুখের ভাব বদলে গেল। সে দেখল, ‘নস্টালজিয়া’-র সার্ভারে শুধু ক্লায়েন্টদের স্মৃতিই নেই, সেই স্মৃতিগুলোকে ইচ্ছেমতো বদলানোর জন্য জটিল অ্যালগরিদমও রয়েছে। সে রথীর সাথে ডক্টর সেনের এনক্রিপ্টেড চ্যাটের সন্ধান পেল। “স্যার, এ তো সাংঘাতিক,” অভিরূপ উত্তেজিত হয়ে রায়চৌধুরীকে বলল। “এরা শুধু স্মৃতি বিকৃত করছে না, এরা মানুষের ব্রেন ডেটা ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করছে। নীলাদ্রি বাবুর স্মৃতিতেও এরা ইচ্ছে করে ভুল তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছিল, যাতে উনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।” বিক্রম ওপাশ থেকে জানাল, “অভিরূপ, আমি ‘নস্টালজিয়া’-র মূল কোডে একটা ব্যাকডোর খুঁজে পেয়েছি। ওরা ক্লায়েন্টদের নিউরাল ইন্টারফেস ব্যবহার করে তাদের ঘরের স্মার্ট ডিভাইসগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ওরা নীলাদ্রি দার ফ্ল্যাটের সব কথা শুনছিল।” এই তথ্যটা শোনার পর অভিরূপের সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, এটা শুধু একটা খুনের মামলা নয়, এটা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে घुसपैठ করার এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। “রায়চৌধুরী স্যার, আমাদের এখনই রেইড করতে হবে,” অভিরূপের গলায় এখন দৃঢ় প্রত্যয়। “ওরা প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করার আগেই।” কিন্তু রায়চৌধুরী তাকে থামিয়ে দিলেন। “অভিরূপ, এত সোজা নয়। রথীর লোক সব জায়গায় আছে। এমনকি আমাদের ডিপার্টমেন্টেও। আমরা সরাসরি অ্যাকশনে গেলে খবর ফাঁস হয়ে যাবে। রথী পালিয়ে যাবে।” রায়চৌধুরীর কথাই সত্যি হলো। অভিরূপ যখন কেস ফাইল তৈরি করার জন্য কিছু পুরনো ডেটা অ্যাক্সেস করার চেষ্টা করল, দেখল সেগুলো ‘লকড’। তার কাছে একটা বেনামী ফোন এলো, “অভিরূপ বাবু, বেশি উড়বেন না। ডানা ছাঁটা হয়ে যাবে।” অভিরূপ বুঝতে পারল, তারা এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে। “আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যাতে রথী পালানোর সুযোগ না পায়,” অভিরূপ একটা গোপন জায়গায় বসে নীলাদ্রি, ফারজানা আর বিক্রমের সাথে ভিডিও কলে বলল। “কী করতে হবে?” নীলাদ্রি জিজ্ঞেস করল। “সামনের সপ্তাহে রথী তার নতুন চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের উদ্বোধনের জন্য একটা বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শহরের সব বড় বড় লোক সেখানে থাকবে। মিডিয়া থাকবে। আমরা সেই সুযোগটাই নেব,” অভিরূপ তার পরিকল্পনাটা বোঝাল। “বিক্রম, তুমি কি পারবে অনুষ্ঠানের লাইভ ফিড হ্যাক করে আমাদের প্রমাণগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে?” “পারব,” বিক্রমের গলায় আত্মবিশ্বাস। “কিন্তু তার জন্য আমাকে ওই জায়গার নেটওয়ার্কের ভেতরে ঢুকতে হবে।” “সেই ব্যবস্থা আমি করব,” অভিরূপ বলল। “আর যখন প্রমাণগুলো সবার সামনে আসবে, তখন আমরা একযোগে সব জায়গায় রেইড করব। রথী পালানোর কোনো পথ পাবে না।” পরিকল্পনাটা ছিল সাংঘাতিক বিপজ্জনক, কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। অনুষ্ঠানের দিন, শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলে চাঁদের হাট বসেছে। হর্ষবর্ধন রথী মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার সমাজসেবার ভাষণ দিচ্ছে। অভিরূপ একজন ওয়েটারের ছদ্মবেশে হোটেলের সার্ভার রুমে ঢুকে বিক্রমকে অ্যাক্সেস পাইয়ে দিল। নীলাদ্রি আর ফারজানা হোটেলের বাইরে একটা গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে, তাদের বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে। রথী যখন তার ভাষণ শেষ করে হাততালি নিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে হোটেলের সমস্ত বড় স্ক্রিনে তার হাসিমুখের বদলে ভেসে উঠল ‘মডার্ন ক্লিনিক’-এর ভেতরের ভয়ঙ্কর দৃশ্য, তার বেআইনি লেনদেনের তথ্য, ডক্টর সেনের সাথে তার চ্যাটের রেকর্ড। মুহূর্তের মধ্যে পুরো হল জুড়ে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। তারপর শুরু হলো চিৎকার, হুড়োহুড়ি। রথীর লোকেরা কিছু বোঝার আগেই রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশ পুরো হোটেল ঘিরে ফেলল। রথী পালানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু নীলাদ্রি তার পথ আটকে দাঁড়াল। এই প্রথম সে রথীকে সামনাসামনি দেখল। তার চোখে কোনো ভয় নেই, শুধু তীব্র ঘৃণা। “আমার ইরাকে কেন মারলে?” নীলাদ্রি চিৎকার করে উঠল। রথী হাসল। “তোমার বউ বড্ড বেশি জেনে ফেলেছিল। যেমনটা তুমি জেনেছ। কিন্তু চিন্তা কোরো না, তোমার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।” রথী পকেট থেকে একটা ছোট লেজার পিস্তল বের করার আগেই অভিরূপ পেছন থেকে এসে তার হাতে আঘাত করল। হর্ষবর্ধন রথী এবং তার চক্রের সবাই ধরা পড়ল। ‘নস্টালজিয়া’-র আসল ব্যবসা ফাঁস হয়ে গেল, ডক্টর সেন সহ সবাইকে গ্রেফতার করা হলো। উপসংহার শহরটা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। কিন্তু নীলাদ্রির জীবনটা আর আগের মতো রইল না। আজ, এক বছর পর, নীলাদ্রি আবার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে কফির কাপ। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। সে এখন ইরার নামে একটা ট্রাস্ট চালায়, যা সৎ এবং সাহসী সাংবাদিকদের সাহায্য করে। ফারজানা সেই ট্রাস্টের প্রধান। বিক্রম তার দাদার পাশে এসে দাঁড়াল। “বৌদি আজ থাকলে খুব খুশি হতো,” বিক্রম বলল। নীলাদ্রি হাসল। তার আর VR হেডসেটের প্রয়োজন হয় না। প্রযুক্তির তৈরি বিকৃত স্মৃতি নয়, তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ইরার আসল স্মৃতিগুলোই এখন তার সবচেয়ে বড় শক্তি। সে জানে, ইরা চলে যায়নি। সে তার সাহসিকতায়, তার সততায় আর তাদের ভালোবাসার মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবে। কিছুদিন পর খবরের কাগজে একটা ছোট খবর ছাপা হলো। সাব-ইন্সপেক্টর অভিরূপ চ্যাটার্জী তার বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসিকতার জন্য বিশেষ পদোন্নতি পেয়েছে। খবরটা দেখে নীলাদ্রি মৃদু হাসল। সে জানে, এই লড়াইয়ে সে একা ছিল না। শহরের নিওন আলো ছাড়িয়ে নীলাদ্রির চোখ চলে গেল দূরের তারার দিকে। গোলকধাঁধাটা শেষ হয়েছে। এখন পথটা একেবারে সোজা। ~সমাপ্ত~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion