ল্যাপটপের ভেতরে ছিল এক অন্য ইরা। যে ইরাকে নীলাদ্রি চিনত না। ইরা আসলে একজন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট ছিল। সে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করত, আর তার বিষয় ছিল শহরের অন্ধকার জগৎ—ড্রাগ মাফিয়া, বেআইনি নির্মাণ, আর তার শেষ প্রজেক্ট ছিল—অঙ্গ পাচার চক্র।
ফাইলগুলো ঘেঁটে নীলাদ্রি বুঝতে পারল, ইরা এক বিশাল চক্রের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করছিল, যার সাথে শহরের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। এই চক্র গরিব, অসহায় মানুষদের টাকার লোভ দেখিয়ে বা কিডন্যাপ করে তাদের অঙ্গ বের করে নিত এবং বিদেশে চড়া দামে বিক্রি করত। পার্ক সার্কাসের সেই ‘মডার্ন ক্লিনিক’ ছিল তাদের অপারেশনের কেন্দ্র।
‘নস্টালজিয়া’ কোম্পানিটাও ছিল সেই চক্রের অংশ। তারা স্মৃতি নিয়ে গবেষণা করার আড়ালে মানুষের ব্রেন ডেটা চুরি করত। যাদের স্মৃতি পুনরুদ্ধার করা হতো, তাদের মধ্যে যদি কেউ এই চক্রের কোনো গোপন কথা জেনে থাকত, তাহলে ‘নস্টালজিয়া’ সেই তথ্য চক্রের মাথায় পৌঁছে দিত। এছাড়াও, তারা ব্ল্যাকমেইলিং-এর জন্য মানুষের গোপন স্মৃতি ব্যবহার করত। ইরা তাদের মুখোশ খুলে দেওয়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
নীলাদ্রি একটা ফোল্ডার খুলল, যার নাম “ফারজানা”। ভেতরে ছিল অনেকগুলো ইমেইল চালাচালি। ফারজানা ছিল ইরার সহকর্মী এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সেও একজন টেক জার্নালিস্ট। শেষ ইমেইলটা ছিল ইরার মৃত্যুর ঠিক দুদিন আগের। ইরা লিখেছিল, “ফারজানা, আমি সব প্রমাণ পেয়ে গেছি। লোকটার নাম রথী। হর্ষবর্ধন রথী। শহরের সবচেয়ে বড় শিল্পপতিদের একজন। ওই এই চক্রের মাথা। কিন্তু ওরা জেনে গেছে। আমাকে সাবধানে থাকতে হবে। যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তাহলে ‘প্রথম বৃষ্টির গান’ মনে রাখিস।”
নীলাদ্রি বুঝতে পারল, তাকে ফারজানাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? তার কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর ছিল না। সে ইন্টারনেটে ফারজানার নাম দিয়ে সার্চ করল। জানতে পারল, ইরার মৃত্যুর পর সেও চাকরি ছেড়ে দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।
নীলাদ্রি যখন এসব নিয়ে ভাবছে, তখনই তার ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই সে দেখল, দুজন অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরনে কালো স্যুট, চোখে রোদচশমা।
“নীলাদ্রি সেনগুপ্ত?” একজন কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ।”
“ডক্টর সেন আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। আমাদের সাথে চলুন।”
নীলাদ্রির বুঝতে বাকি রইল না, এরা ‘নস্টালজিয়া’-র লোক। সে ল্যাপটপটা চালু করে ফেলেছে, আর ওরা কোনোভাবে জেনে গেছে।
“আমি কোথাও যাব না,” নীলাদ্রি দরজা বন্ধ করতে গেল।
কিন্তু লোকগুলো জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তাদের সাথে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে নীলাদ্রি টেবিলে রাখা একটা ভারী পেপারওয়েট দিয়ে একজনের মাথায় আঘাত করে এবং অন্যজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাট থেকে পালিয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল, তার নিজের বাড়ি আর নিরাপদ নয়।
সে সোজা বিক্রমের কাছে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে সবটা বলল। বিক্রম এবার আর অবিশ্বাস করল না। তার দাদার চোখের ভয়, કપালের ঘাম—সবকিছুই সত্যি বলছিল।
“দাদা, তুই এখন কী করবি?”
“আমাকে ফারজানাকে খুঁজে বের করতে হবে। ওই একমাত্র জানে ‘প্রথম বৃষ্টির গান’-এর মানে কী।”
বিক্রম তার নিজের ল্যাপটপ বের করল। “আমি চেষ্টা করছি। ফারজানার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট খুঁজে বের করতে হবে।”
কয়েক ঘণ্টার চেষ্টার পর, ডার্ক ওয়েবের সাহায্য নিয়ে বিক্রম ফারজানার একটা সম্ভাব্য ঠিকানা বের করল—রিষড়ার কাছে একটা পুরনো বাড়ির ঠিকানা।
নীলাদ্রি আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। বিক্রমের থেকে কিছু টাকা আর একটা বার্নার ফোন নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। রিষড়ায় পৌঁছে সে দেখল, বাড়িটা গঙ্গার ধারে। খুব শান্ত পরিবেশ। দরজায় টোকা দিতেই এক মহিলা দরজা খুললেন। তার চোখেমুখে একটা সতর্ক ভাব।
“কাকে চাই?”
“আমি নীলাদ্রি। ইরার স্বামী।”
নামটা শোনার সাথে সাথে ফারজানার চোখের ভাব বদলে গেল। সে নীলাদ্রিকে ভেতরে নিয়ে গেল।
ফারজানার কাছ থেকে নীলাদ্রি বাকিটা জানতে পারল। হর্ষবর্ধন রথী এক ভয়ংকর লোক। পুলিশ, প্রশাসন—সব তার পকেটে। ইরা আর ফারজানা একসাথে এই তদন্ত শুরু করেছিল। কিন্তু রথীর লোকেরা তাদের পিছু নেয়। ইরা খুন হওয়ার পর ফারজানা বুঝতে পারে, তার জীবনও বিপন্ন। তাই সে গা ঢাকা দেয়।
“প্রথম বৃষ্টির গান’ মানে কী?” নীলাদ্রি জিজ্ঞেস করল।
ফারজানা হাসল। “এটা কোনো গান নয়। এটা একটা ক্লাউড সার্ভারের নাম। ইরা ওর সব প্রমাণ ওখানে রেখেছিল। কিন্তু ওটা খুলতে গেলে তিনটে পাসওয়ার্ড লাগবে। প্রথমটা হলো ‘মিষ্টি’। দ্বিতীয়টা ও আমাকে বলে গিয়েছিল। আর তৃতীয়টা…”
ফারজানা চুপ করে গেল। “তৃতীয়টা ও শুধু তোমাকেই দিয়ে গেছে, নীলাদ্রি। তোমাকে মনে করতে হবে।”
নীলাদ্রি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। সে কিছুই মনে করতে পারছিল না।
নীলাদ্রি আর ফারজানা মিলে সেই সার্ভার অ্যাক্সেস করার চেষ্টা করতে লাগল। প্রথম দুটো পাসওয়ার্ড কাজ করল। কিন্তু তৃতীয়টার জন্য তারা আটকে গেল। ওদিকে রথীর লোকেরা তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিক্রম ফোন করে জানাল, তাদের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে আবার লোক এসেছিল, সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে।
নীলাদ্রি হতাশ হয়ে পড়ছিল। সে ইরার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। তাদের কত কথা, কত গোপন মুহূর্ত। কোনটা সেই পাসওয়ার্ড?
হঠাৎ তার ‘নস্টালজিয়া’-র কথা মনে পড়ল। বিকৃত হলেও, সেই স্মৃতিগুলোই ছিল তার একমাত্র চাক্ষুষ প্রমাণ। সে ঠিক করল, তাকে শেষবারের মতো সেই ভার্চুয়াল জগতে ফিরতে হবে। কিন্তু ‘নস্টালজিয়া’-র কাছে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে বরণ করা।
“একটা উপায় আছে,” বিক্রম ফোন লাইনের ওপার থেকে বলল। “‘নস্টালজিয়া’ যে সফটওয়্যার ব্যবহার করে, তার একটা ক্র্যাকড ভার্সন ডার্ক ওয়েবে পাওয়া যায়। কিন্তু ওটা চালাতে গেলে একটা শক্তিশালী নিউরাল ইন্টারফেস লাগবে।”
“সেটা কোথায় পাব?”
“আমার কাছে,” ফারজানা বলল। “ইরা আর আমি তদন্তের জন্য একটা কিনেছিলাম।”
পরিকল্পনা তৈরি হলো। বিক্রম সফটওয়্যারটা পাঠাবে। ফারজানা ইন্টারফেসটা সেট আপ করবে। আর নীলাদ্রি শেষবারের মতো ডুব দেবে তার স্মৃতির গোলকধাঁধায়।
সেই রাতেই তারা কাজ শুরু করল। ফারজানার বাড়ির একটা গোপন ঘরে সেট আপ তৈরি হলো। নীলাদ্রি যখন হেলমেটটা পরছে, তার হাত কাঁপছিল। সে কি পারবে?
“তুমি পারবে, নীলাদ্রি,” ফারজানা তার কাঁধে হাত রাখল। “ইরা তোমাকেই বিশ্বাস করেছিল।”
VR জগতে প্রবেশ করতেই নীলাদ্রি দেখল, দৃশ্যগুলো আগের চেয়েও বেশি খাপছাড়া, বিকৃত। ‘নস্টালজিয়া’ যেন তার ব্রেন ডেটা নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সে জোর করে নিজের মনকে কেন্দ্রীভূত করল। সে খুঁজতে লাগল তাদের শেষ ভালো মুহূর্তটা।
অবশেষে সে পেল। ইরার মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগের এক রাত। তারা ছাদে বসেছিল। আকাশ তারায় ভরা।
ইরা তার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল, “জানো, নীলাদ্রি, যদি কোনোদিন আমি হারিয়ে যাই, তুমি আমাকে কোথায় খুঁজবে?”
নীলাদ্রি হেসেছিল। “কেন, তোমার বইয়ের তাকের আড়ালে।”
“ধুর,” ইরা কপট রাগ দেখিয়েছিল। “না, তুমি আমাকে খুঁজবে আমাদের প্রথম ঠিকানায়। যেখানে আমাদের গল্পটা শুরু হয়েছিল।”
“আমাদের প্রথম ঠিকানা…” নীলাদ্রির ঠোঁট নড়ে উঠল। তাদের প্রথম ঠিকানা! বিয়ের পর তারা এক বছরের জন্য টালিগঞ্জের এক ভাড়া বাড়িতে ছিল। সেই বাড়ির ঠিকানাটা ছিল ‘১৭/১, লেক ভিউ রোড’।
“পেয়ে গেছি!” নীলাদ্রি চিৎকার করে হেডসেটটা খুলে ফেলল। “পাসওয়ার্ডটা হলো 17/1, Lake View Road।”
ফারজানা দ্রুত পাসওয়ার্ডটা টাইপ করল। এন্টার চাপতেই স্ক্রিনে একটা ফাইল খুলে গেল। ভেতরে ছিল ভিডিও, ছবি, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্বীকারোক্তি—রথীর বিরুদ্ধে সমস্ত অকাট্য প্রমাণ।
কিন্তু তাদের আনন্দ বেশিক্ষণ থাকল না। হঠাৎ বাইরে গাড়ির শব্দ হলো। রথীর লোকেরা তাদের খুঁজে পেয়েছে।
“পালাতে হবে,” ফারজানা ল্যাপটপটা একটা ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল।
তারা বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গঙ্গার দিকে দৌড়াতে লাগল। পেছনে লোকজনের চিৎকার আর পায়ের শব্দ।
তারা একটা নৌকায় উঠে পড়ল। মাঝরাতে, গঙ্গার বুকে, তাদের নৌকা এগিয়ে চলল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion