আনিকের ঘুম ভাঙতো সব সময় একটাই অনুভূতি নিয়ে – বুকফাটা প্রত্যাশা এবং ভয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। গত ছ’মাস ধরে প্রতি রাতে সে একই স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্ন তার দৈনন্দিন জীবনের উপর এক গভীর, মন্থর ছায়া ফেলেছিল। সে মানুষের কোলাহল, বাজারের চিৎকার, এমনকি নিজের অফিসের টাইপিংয়ের শব্দ— সব কিছুতেই এক ধরণের দূরত্ব অনুভব করতো। বাস্তব তার কাছে ক্রমশঃ শব্দময়, ক্লান্তিকর এবং অগভীর মনে হতে শুরু করেছিল।
স্বপ্নটা শুরু হয় তার অতি পরিচিত বারান্দা থেকে, যেখানে সকালের চা হাতে সে প্রায়শই দাঁড়াতো। কিন্তু কিছুদূর যেতেই পরিবেশ পাল্টে যায়।
সে নিজেকে আবিষ্কার করে এক দীর্ঘ, নীরব করিডোরে। করিডোরটা যেন ইতিহাস আর স্যাঁতসেঁতে ধুলোর গন্ধে ভরা, যা বহু যুগ ধরে কেউ স্পর্শ করেনি। দেওয়ালের রং চুন-খসা বিবর্ণ হলুদ, আর মেঝেতে কোথাও কোনো শব্দ নেই। সেখানে কোনো আলো নেই, শুধু করিডোরের শেষ প্রান্তের একটা জানলা থেকে আসা ম্লান, পীড়াদায়ক বেগুনি রঙের এক ক্ষীণ আভা।
আর সেই করিডোরের একদম শেষে দাঁড়িয়ে থাকে সেই জিনিসটা— একটি দরজা।
সেটা সাধারণ কোনো দরজা নয়। ঘন শাল কাঠের দরজা, সম্ভবত শ’খানেক বছরের পুরোনো। কাঠের পালিশ উঠে গিয়েও তার ওপরের জটিল নকশাগুলো স্পষ্ট, যা দেখতে অনেকটা প্রাচীন কোনো লতানো গাছের শাখার মতো— প্রতিটি শাখাই যেন নিঃশব্দে কোনো অশুভ বার্তা বহন করছে। দরজার হাতলটা ভারী পিতলের, ঠাণ্ডা আর অদ্ভুত মসৃণ।
আনিক জানে না দরজাটা কেন সেখানে। কিন্তু সে জানে, তার অস্তিত্বের প্রতিটি কণা চাইছে দরজাটা খুলতে। সে হেঁটে যায়, প্রতি রাতে একটু একটু করে। সেই নীরবতার মধ্যে তার জুতোর শব্দ হয় না, নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও যেন কোথাও হারিয়ে যায়। শুধু তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দেয়, যেন সেটাই তার একমাত্র সঙ্গী, একমাত্র প্রমাণ যে সে এখনও বেঁচে আছে।
প্রতি রাতে সে দরজার ঠিক এক হাত দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। শীতল, ভারি পিতলের হাতলটা ছোঁয়ার জন্য সে হাত বাড়ায়—
ঠিক এই মুহূর্তেই তার ঘুম ভেঙে যায়।
সকাল হলেই স্বপ্নের রেশ কেটে যায়, কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়: কেন সে দরজাটা ছুঁতে পারে না? কেন যেন মনে হয়, সেই দরজাটা হলো তার জীবন আর বাস্তবের শেষ সীমারেখা। সে বারবার ডাক্তার দেখিয়েছে, কিন্তু তারা একে নিছকই অতিরিক্ত স্ট্রেস-জনিত বিভ্রম বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
আনিক পেশায় একজন ডিজিটাল আর্কিভিস্ট। পুরনো নথি, ছবি এবং মানচিত্রকে ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষণ করাই তার কাজ। স্বপ্ন আর বাস্তবতার এই দোলাচল নিয়ে সে যখন জর্জরিত, তখনই তার অফিসে একটি বিশেষ প্রকল্পের ডাক আসে। তাকে কলকাতার একটি প্রায় পরিত্যক্ত লাইব্রেরিতে পাঠানো হলো, যার নাম 'প্রাচীন পান্ডুলিপি ভবন'।
ভবনটি ছিল ঔপনিবেশিক আমলের, বিশাল, এবং ভেতরে ঢুকে মনে হলো সময় যেন সেখানে থেমে গেছে। ধুলো আর বইয়ের পাতার পুরোনো গন্ধ, কাঠ পোকা খাওয়ার শব্দ আর করিডোরে প্রতিধ্বনিত হওয়া নিজের পদশব্দ— সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ। আনিকের মনে হলো, এই স্থানটি যেন তার ভেতরের নীরবতার সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, যখন আনিক লাইব্রেরির শেষ প্রান্তে, কর্মীদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত একটি অংশে কাজ করছিল। সে একটা পুরনো আলমারির পাল্লা সরাতে গিয়ে থমকে গেল। আলমারির পেছনের দেওয়ালটি ফাঁপা মনে হলো। কৌতূহলী হয়ে সে আলমারিটা সরিয়ে দেখল, সেখানে দেওয়াল নেই, আছে একটা সরু, ঢাকা করিডোর।
করিডোরটি লাইব্রেরির নকশায় ছিল না। সেটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, যেন বাস্তবতার বাইরে সেলাই করা একটি গোপন পথ।
আনিকের শরীর হিম হয়ে গেল। এই করিডোরটা... এই করিডোরটা ঠিক তার স্বপ্নের মতো!
বিবর্ণ হলুদ দেওয়াল, স্যাঁতসেঁতে ধুলোর গন্ধ, আর কোথাও কোনো আলোর উৎস নেই। শুধুমাত্র করিডোরের শেষ প্রান্ত থেকে আসছে সেই ম্লান, বেগুনি আভা।
আর সেই আভার নিচে— সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই দরজা।
ঘন শাল কাঠ, প্রাচীন লতানো গাছের শাখার মতো নকশা, আর ভারি, শীতল পিতলের হাতল।
দরজাটা দেখে আনিকের মনে হলো তার বহুদিনের হারানো কোনো জিনিস সে খুঁজে পেয়েছে। ছয় মাসের স্বপ্ন যেন বাস্তবে এসে দাঁড়িয়েছে। এই আবিষ্কারের তীব্রতা তাকে কাঁপিয়ে দিল, কিন্তু ভয়ের চেয়ে কৌতূহল ছিল বেশি। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
এবার আর তার জুতো বা নিঃশ্বাসের শব্দ হারালো না। সে হাঁটছে, বাস্তবে, তার নিজের হাতে গড়া স্বপ্নের দিকে।
সে দরজার সামনে দাঁড়াল। পিতলের হাতলটা ধরল। স্বপ্নে যে স্পর্শ থেকে তাকে বারে বারে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, আজ সেই স্পর্শ পেল সে। হাতলটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা, যেন বরফের মতো। তাতে এক ধরণের অদ্ভুত শক্তি অনুভব করলো আনিক— এক তীব্র আকর্ষণ, যা তাকে ভেতরে টানছে।
মুহূর্তের দ্বিধা। এই দরজা কি সত্যিই স্বপ্নলোকের? নাকি অন্য কোনো ভয়ঙ্কর স্থানের? কিন্তু পিছু হটার উপায় ছিল না। সে ততক্ষণে এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করে ফেলেছে।
আনিক হাতলটা ঘোরানোর আগে করিডোরের দেওয়ালের দিকে তাকাল। সে দেখল, দরজার ঠিক পাশে একটি ছোট্ট, পুরোনো পাথরের ওপর খোদাই করা কিছু লিপি। লিপিগুলো অদ্ভুত— বাংলা বর্ণমালার মতো দেখতে হলেও সেগুলো অচেনা। তবে লিপিগুলোর ওপর একটা শব্দ স্পষ্ট করে লেখা:
“শব্দহীন” (Shobdohin)।
এরপর আর কোনো চিন্তা নয়। আনিক শ্বাস ধরে হাতলটা পুরোপুরি ঘোরালো এবং দরজাটা ভেতরের দিকে ঠেলে দিল।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion