দরজা খোলার সাথে সাথেই কোনো তীব্র আলো বা শব্দ তার চোখে পড়লো না। বরং চারপাশের বাতাস যেন কয়েকগুণ ভারী হয়ে গেল, যেন সে এক বিশাল, বায়ুশূন্য কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করেছে। ভেতর থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস তার চামড়া ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করলো।
আনিক এক পা ভেতরে রাখতেই দরজাটা তার পেছন থেকে "ধড়াস" শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। শব্দটা এত ভয়ঙ্কর ছিল যে তার কান কিছুক্ষণের জন্য তালাবন্ধ হয়ে গেল।
সে এখন অন্য এক জগতে। এটি একটি বিপরীত জগৎ, বা যেমন নাম দেওয়া ছিল— শব্দহীন।
আকাশের রং গাঢ়, পীড়াদায়ক পার্পল। মেঘেরা স্থির হয়ে আছে যেন কোনো ক্যানভাসে আঁকা। বাতাস আছে, কিন্তু তার কোনো শব্দ নেই। দূর থেকে ভেসে আসছে জলের কলকল শব্দ, কিন্তু তার তীক্ষ্ণতা এত বেশি যে মনে হয় কাঁচের টুকরো দিয়ে কেউ কানে আঘাত করছে। এই জগতের আইন হলো— কোনো শব্দ এখানে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারে না; প্রতিটি ধ্বনি হয় তীব্রভাবে বিকৃত, নয়তো সম্পূর্ণ বিলীন। এমনকি আলোর রেখাগুলোও এখানে বেঁকে যায়, তৈরি করে অদ্ভুত অপচ্ছায়া।
সবথেকে অদ্ভুত ছিল প্রকৃতি। গাছপালা আছে, কিন্তু তাদের রং কালো-নীল, এবং তাদের ডালপালা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেঁকে আছে, যেন কোনো অজানা কষ্টে কুঁকড়ে গেছে। পৃথিবীতে পরিচিত কোনো ফুল বা ফলের গন্ধ নেই, শুধু একটা তীব্র, ধাতব গন্ধ— যেমন গন্ধ আসে পুরোনো লোহার ওপর মরিচা পড়লে।
আনিক দাঁড়িয়েছিল একটি বিশাল ফাঁকা চত্বরে, যা হয়তো এক সময় কোনো বাজার বা জনবহুল স্থান ছিল। এখন সেখানে কোনো দোকানপাট বা চিহ্ন নেই, শুধু স্তম্ভাকৃতির কিছু ভাঙা কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। এই কাঠামোতে কোথাও কোনো মানুষ বা পশুর চিহ্ন নেই, যেন জীবন এখানে বহু যুগ আগেই হেরে গেছে।
কিন্তু জায়গাটি ফাঁকা নয়।
চত্বরের কেন্দ্রে, পাথরের ওপর দিয়ে ধীর গতিতে, গুটি কয়েক মূর্তি হেঁটে যাচ্ছিল। তারা মানুষ নয়।
তারা ছিল ‘শব্দহীন’ (The Soundless)।
মানুষের মতোই তাদের শরীর, কিন্তু তাদের চামড়া ফ্যাকাসে, যেন সাদা মোম দিয়ে তৈরি। তাদের মাথাগুলো সামান্য লম্বা, কিন্তু তাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হলো— তাদের মুখ নেই। মুখের জায়গায় শুধু মসৃণ চামড়া, সেখানে চোখ, নাক বা ঠোঁটের কোনো চিহ্ন নেই।
তারা শব্দহীন, তাই তাদের হাঁটার বা নড়াচড়ার কোনো শব্দ হয় না। তারা যেন শূন্যে ভাসমান ছায়ার মতো, এক পা-ও না ফেলে এগিয়ে চলে। তাদের গতি অস্বাভাবিক দ্রুত, এবং তারা শব্দহীনতার মাধ্যমেই তাদের শিকারকে চিহ্নিত করে— হয়তো শিকারের শরীরের ভেতরের কম্পন বা হৃদস্পন্দনের পরিবর্তন দিয়ে। তারা আলোর প্রতি সংবেদনশীল, কিন্তু ধ্বনির প্রতি তাদের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ অবিশ্বাস্য তীব্র।
আনিক তাদের দেখামাত্রই পাথরের একটি ভাঙা স্তম্ভের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। তার হৃদস্পন্দন এত দ্রুত হচ্ছিল যে সে ভয় পেল, এই জগতের শব্দহীনতা ভেদ করে যেন তার হৃদয়ের শব্দই শুনতে পাবে ‘শব্দহীন’রা।
তাদের চলাচলের ভঙ্গি ছিল অদ্ভুত। তারা সোজা হয়ে হাঁটছিল না; প্রতিটি শব্দহীনের শরীর একটু বেঁকে ছিল, যেন তারা কোনো অদৃশ্য মাধ্যাকর্ষণ বলের টানে ঝুঁকে আছে। তাদের কোনো চোখ নেই, তবুও আনিক স্পষ্ট বুঝতে পারছিল— তারা খুঁজছে। তারা শিকার খুঁজছে।
আনিক বুঝতে পারল: এটি এক ভয়ানক, সমান্তরাল বাস্তবতা, যেখানে আলো, শব্দ, এমনকি জীবনের স্বাভাবিক নিয়মগুলোও বিকৃত। আর সে এখানে একজন বহিরাগত, একজন অবাঞ্ছিত শিকার।
ফেরার রাস্তা! তাকে ফিরতে হবে।
ঘণ্টাখানেক লুকিয়ে থাকার পর আনিক বুঝতে পারল, সে ফিরে যেতে পারবে না। সেই দরজাটি এখন বন্ধ, এবং এই জগতে সেটিকে বাইরে থেকে খোলা সম্ভব নয়। তাকে অন্য কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
‘শব্দহীন’রা সাধারণত দলবদ্ধভাবে চলে না। তারা একাকী, ধীর পদক্ষেপে চত্বরটি টহল দিচ্ছিল। তাদের নিস্তব্ধ উপস্থিতিতে একটা ঠান্ডা আতঙ্ক ছিল, যা আনিকের ভেতরে জমে থাকা ভয়কে আরও বাড়িয়ে তুলছিল।
হঠাৎ আনিক স্তম্ভের আড়াল থেকে সামান্য উঁকি দিতেই দেখল, একটি ‘শব্দহীন’ মূর্তি তার দিকে ঘুরে গেল। সে কি শব্দ শুনতে পেল? নাকি অন্য কিছু?
‘শব্দহীন’র মুখের জায়গায় মসৃণ চামড়া, কিন্তু আনিকের মনে হলো সে যেন তার দিকেই ‘তাকিয়ে’ আছে।
দ্রুত পালাও!
আনিক দৌড়তে শুরু করল। তার পায়ের নিচে ভাঙা পাথরের নুড়ি এবং শুকিয়ে যাওয়া লতানো গাছের ডাল। তার দৌড়ানোর শব্দ এই নীরব জগতে যেন বোমার শব্দের মতো প্রতিধ্বনিত হলো।
পিছন থেকে কোনো শব্দ আসছিল না, কিন্তু আনিক বুঝতে পারছিল, ‘শব্দহীন’টা তার পিছু নিয়েছে। সে একটি ভাঙা দেওয়াল টপকে অন্য একটি সংকীর্ণ গলিতে প্রবেশ করল। সেই গলিতে সে দেখল, আরও তিন-চারটি ‘শব্দহীন’ মূর্তি তাদের টহল বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের গতি এখন অনেক বেশি, অস্বাভাবিক দ্রুততায় তারা এগিয়ে আসছে।
গলিতে দমবন্ধ করা ধাতব গন্ধ আরও তীব্র। আনিক ছুটতে ছুটতে প্রায় হাঁপিয়ে গেল।
তখনই তার চোখে পড়ল, গলির শেষ মাথায়, একটা ভাঙা দালানের ভেতরের দিকে— আরেকটি দরজা।
সেটা ঠিক তার নিজের ঘরের দরজার মতো দেখতে।
পরিচিত কাঠ, পরিচিত নকশা, এমনকি তার আসল দরজার গায়ে সামান্য যে আঁচড় ছিল, সেটাও সেখানে স্পষ্ট! এটি অবশ্যই সেই বিপরীত দরজা, যা তাকে তার বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু দরজাটির ঠিক সামনে দাঁড়িয়েছিল এই জগতের সবথেকে ভয়ঙ্কর সত্তা।
সেটি ‘শব্দহীন’ নয়। সেটির কোনো মুখ না থাকলেও, তার শরীরের ভাঁজে, তার অঙ্গভঙ্গিতে ছিল এক অসহনীয় অহঙ্কার। তার শরীরের চামড়া সাদা নয়, ছিল কালো পাথরের মতো, এবং তার কাঁধ থেকে চারটি অতিরিক্ত হাত বেরিয়েছিল।
এটি ছিল ‘প্রতিশব্দ’ (The Counter-Echo)। এই জগতের রক্ষক।
‘প্রতিশব্দ’র কোনো নড়াচড়া ছিল না, সে দরজা আগলে স্থির দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আনিক তার দিকে তাকানোর সাথে সাথেই ‘প্রতিশব্দ’-এর চারটি হাতের আঙুলগুলো নড়ে উঠল, যেন সে এক অদৃশ্য সুরের মূর্ছনা বাজাচ্ছে।
আনিকের মনে হলো, সে কথা বলছে। শব্দ ছাড়া কথা। এই জগতের নিস্তব্ধতা যেন তার নিজের মস্তিষ্কের ভেতরে প্রবেশ করে এক আতঙ্কিত প্রশ্ন তুলল: কে তুমি? কেন এসেছ?
‘শব্দহীন’রা এখন গলির দু'দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলছিল। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
আনিকের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। তবে তার কাছে ছিল এক আর্কিভিস্টের জ্ঞান, তার স্বপ্ন, এবং তার সাহস।
সে মনে করল সেই লিপিগুলোর কথা, "শব্দহীন" (Shobdohin)। এই জগৎ শব্দের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। যদি তার হৃদস্পন্দন শব্দহীনরা শুনতে পায়, তবে কি আরও তীব্র কিছু তাদের মনোযোগ নষ্ট করতে পারে?
আনিক দ্রুত তার পকেট থেকে তার ফোনের ছোট টর্চটা বের করলো। সেটিকে জোরে মেঝেতে আছাড় মারল।
টর্চটা ভেঙে গেল না, কিন্তু তাতে একটা শর্ট সার্কিট হলো। ফোন থেকে বেরিয়ে এলো একটা তীব্র, কর্কশ "বী-ই-ই-ই-প" শব্দ!
নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে সেই সামান্য ইলেকট্রনিক শব্দটা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল, যেন একটা তীব্র বিস্ফোরণ ঘটল।
‘শব্দহীন’দের গতি তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। তারা যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তাদের মসৃণ মুখের চামড়াগুলো কেঁপে উঠল, যেন অদৃশ্য চোখ বা কান দিয়ে তারা সেই কষ্ট অনুভব করছে। এই জগৎ শব্দের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
এই সুযোগ!
আনিক এক লাফে ‘প্রতিশব্দ’-এর পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে ছুটল। ‘প্রতিশব্দ’ মূর্তিটা ঘুরে তাকানোর আগেই সে দরজার হাতল ধরে প্রাণপণে টান মারল।
দরজা খুলে গেল। ভেতরের আলোটা ছিল তার চেনা, উজ্জ্বল, বাস্তব আলো।
সে দ্রুত দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল এবং কোনো দিকে না তাকিয়েই দরজাটা বন্ধ করে দিল, তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে তালা লাগিয়ে দিল।
মুহূর্তের নীরবতা। সে হাঁপাচ্ছিল।
সে এখন লাইব্রেরির সেই আলমারির পেছনের করিডোরে দাঁড়িয়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা যানবাহনের শব্দ— বাস্তবের সব শব্দ তাকে এক তীব্র স্বস্তি এনে দিল।
আনিক কাঁপতে কাঁপতে সেই কাঠের দরজাটার দিকে তাকাল। ঘন শাল কাঠ, পুরোনো নকশা, শীতল পিতলের হাতল। কিন্তু নকশাগুলো এখন যেন আরও কুঁকড়ানো, আরও ভয়ের।
সে দ্রুত সেই আলমারিটা টেনে এনে দরজার মুখে বসিয়ে দিল। এরপর সে লাইব্রেরি থেকে কোনো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion