Episode 8700 words2 views

পর্ব ৮: চিরন্তন সমাপ্তি

মিনারটির অভ্যন্তর ছিল এক বিশাল ফাঁপা কাঠামো। উপরে একটি ঘূর্ণায়মান স্তম্ভ, যার শীর্ষে দুটি বেগুনি রঙের ক্রিস্টাল জ্বলছিল। সেই ক্রিস্টাল থেকেই শব্দ-শোষণ শক্তি চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আনন্দের সাথে আনিক দেখল, মিনারের ভেতরে একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মে ডঃ সোমেশ্বর মিত্রের তৈরি করা মূল 'ধ্বনিনির্গমন যন্ত্র'-টি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। যন্ত্রটি ছিল তার নিজের তৈরি করা ছোট যন্ত্রের দশগুণ বড়। আনিক দ্রুত মই বেয়ে ওপরে উঠলো। সে যন্ত্রটির প্রধান প্যানেলে নিজের ছোট, বহনযোগ্য যন্ত্রটি যুক্ত করে দিলো। তখনই 'প্রতিশব্দ' ভেতরে প্রবেশ করলো। মিনারের ভেতরে তার শক্তি আরও বেড়ে গেল। "এখানেই তোমার সমাপ্তি, বহিরাগত," প্রতিশব্দ বলল। "তুমি নীরবতার উৎসের কাছে চলে এসেছ। এখন তুমিও আমাদের একজন হবে।" আনিক অনুভব করলো, তার ভেতরের শব্দ, তার স্মৃতি, সব যেন দ্রুতগতিতে ফুরিয়ে যাচ্ছে। তার দমবন্ধ হয়ে এলো। মৃত্যুর শীতলতা তাকে আচ্ছন্ন করছিল। তখনই আনিকের মনে পড়লো বিমলের কথা এবং সোমেশ্বরের ডায়েরির শেষ পাতা। সেই নকশার নিচে একটি সূত্র লেখা ছিল, যা বিমল বলেছিলেন— অনুরণনের চাবি। সূত্রটি ছিল: "Silence is not absence of Sound, but absence of Natural Rhythm." (নিঃশব্দতা ধ্বনির অনুপস্থিতি নয়, বরং স্বাভাবিক ছন্দের অনুপস্থিতি)। আনিক তার যন্ত্রের দিকে তাকাল। সে তার তৈরি করা উচ্চ-কম্পাঙ্কের বী-ই-ই-ই-প শব্দটা চালু করলো না। পরিবর্তে, সে তার ফোনের একটি ফাইল চালু করলো, যা সে ভুলে পকেটে রেখেছিল— সেটি ছিল তার ছোট বোনের জন্মদিনের পার্টিতে গাওয়া একটি পুরোনো বাংলা গান, যেখানে অনেক মানুষের হাসি, কোলাহল, করতালি এবং বাদ্যযন্ত্রের স্বাভাবিক 'ছন্দ' ছিল। আনিক তার যন্ত্রটিকে সোমেশ্বরের মূল যন্ত্রের সাথে যুক্ত করে দিয়ে পূর্ণ শক্তিতে সেই 'ছন্দ' চালু করে দিল। তীব্র, স্বাভাবিক, বাস্তব ধ্বনি সেই শব্দহীন জগতে প্রবেশ করলো। এটি কোনো কর্কশ শব্দ ছিল না, ছিল জীবনের স্বাভাবিক লয়, যা এই জগতের বিকৃত ফ্রিকোয়েন্সিকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। মৌন মিনারের ক্রিস্টালগুলো প্রথমে কেঁপে উঠলো, তারপর বেগুনি আলো বিকিরণ করা বন্ধ করে দিল। 'শব্দহীন'রা চিৎকার করে উঠলো, যদিও তাদের মুখ ছিল না, তবুও সেই তীব্র আর্তনাদ আনিকের মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনিত হলো। এটি ছিল তাদের চরম যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। 'প্রতিশব্দ' স্থির হয়ে গেল। তার কালো পাথরের শরীরে ফাটল ধরতে শুরু করলো। তার কণ্ঠে কোনো রাগ বা ভয় ছিল না, ছিল এক তীব্র শান্তি: "অ...নু...র...ণ...ন...। সোমেশ্বর... তুমি... ছিলে... ঠিক..." প্রতিশব্দ বিদীর্ণ হয়ে গেল। তার দেহাবশেষ মিনারের মেঝেতে কালো ধুলোর স্তূপ তৈরি করলো। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ এই জগতের বিপরীত শক্তিকে ধ্বংস করে দিল। মৌন মিনার ধসে পড়তে শুরু করলো। আনিক আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। সে দ্রুত মই বেয়ে নিচে নামলো। চারিদিকে ধ্বংসের লীলা, সবকিছু ভেঙে পড়ছিল এবং পার্পল আকাশ বদলে গিয়ে গাঢ় লাল হয়ে উঠছিল। সে দৌড়তে দৌড়তে সেই বিপরীত দরজার দিকে ছুটলো, যে দরজা তাকে তার বাস্তবের ঘরে ফিরিয়ে দেবে। সে পেছনে ফিরে তাকালো না। দরজার হাতল ধরে সে প্রাণপণে টানলো, কিন্তু দরজা খুললো না। ধ্বংসে সবকিছুই যেন জ্যাম হয়ে গেছে। সে তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে দরজায় আঘাত করলো। 'ধড়াম!' দরজা খুলে গেল। ভেতরের আলোটা ছিল তার চেনা, উজ্জ্বল, বাস্তব আলো। সে দ্রুত দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। তার শরীরটা লাইব্রেরির সেই আলমারির পেছনের করিডোরে আছড়ে পড়লো। কোনো দিকে না তাকিয়েই সে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে সে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। এরপর সে কাঁপা হাতে সেই ধ্বনিনির্গমন যন্ত্রের স্পিকারটা শেষবারের মতো চালু করলো। "বী-ই-ই-ই-ই-ই-প!" করিডোরের পাথরের দেওয়াল কেঁপে উঠলো, এবং দরজার ভেতরের কাঠামোগুলো ভেঙে পড়লো। করিডোরের দেওয়াল নিজেই ধসে গেল এবং দরজাটা সম্পূর্ণরূপে পাথরের নিচে চাপা পড়ে গেল। লাইব্রেরির কর্মীরা পরের দিন সকালে ভাঙা দেওয়াল দেখতে পেল। তারা ভাবলো এটা কোনো পুরোনো নির্মাণজনিত ত্রুটি। আনিক সেখানে ছিল না। সে ততক্ষণে শহর থেকে দূরে, তার কুটিরে ফিরে গেছে। পরের দিন সকালে আনিক ঘুম থেকে উঠল। তার বিছানা, তার ঘরের পরিচিত গন্ধ। বাইরে সূর্যের আলো। এবার তার ঘুম ভাঙেনি কোনো ভয় বা প্রত্যাশা নিয়ে। সে সেদিন রাতে কোনো স্বপ্ন দেখল না। স্বপ্নলোকের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। আনিক তার কুটিরে স্বাভাবিক জীবন শুরু করলো। সে এখন একজন স্বাধীন গবেষক, যিনি মানুষের জীবনের ধ্বনি, হাসি আর ছন্দ নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু সে জানে, সেই রহস্যময় জগৎ, সেই শব্দহীন বাস্তব, চিরতরে শেষ হয়ে যায়নি। সে কেবল সেই জগতের সঙ্গে বাস্তবের সংযোগকারী ছিদ্রটা বন্ধ করতে পেরেছে। আনিক এখন যখনই কোনো নীরব, অন্ধকার করিডোরে হাঁটে, তখনই সে ভয় পায় না। কিন্তু সে সবসময় কানে ইয়ারপ্লাগ প্রস্তুত রাখে। কারণ আনিক জানে, পৃথিবীর কোনো কোনো প্রান্তে হয়তো ডঃ সোমেশ্বর মিত্রের মতো আরও কেউ শব্দের বিপরীত শক্তি নিয়ে খেলা শুরু করেছে। এবং সেই নীরবতা আবার ফিরে আসতে পারে। আর তখন হয়তো সে একা থাকবে না, আরও কেউ সেই নীরবতাকে জয় করার জন্য প্রস্তুত থাকবে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion