Episode 7404 words2 views

পর্ব ৭: প্রতিশব্দের সঙ্গে মুখোমুখি

মৌন মিনারের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছিল আনিকের জীবনের সবথেকে ভয়ঙ্কর এবং নিঃশব্দ যাত্রা। সে তার ধ্বনিনির্গমন যন্ত্রের স্পিকারটা হাতে নিয়ে রেখেছিল। যখনই কোনো 'শব্দহীন' মূর্তি তার কাছাকাছি আসত, আনিক রডটা দিয়ে মাটিতে জোরে আঘাত করতো। 'ঠং!' সেই কম্পন 'শব্দহীন'-দের শরীরে তীব্র যন্ত্রণা দিত। তারা তাদের মসৃণ মুখ চেপে ধরে ক্ষণিকের জন্য থেমে যেত। এই সুযোগে আনিক দ্রুত সেই স্থান থেকে পালিয়ে যেত। মিনারটি যত কাছে আসছিল, শব্দ-শোষণ শক্তি তত বাড়ছিল। আনিকের কান ভোঁ ভোঁ করছিল, যেন তার ভেতরের সব শব্দ কেউ জোর করে টেনে নিচ্ছে। সে অনুভব করছিল, এই জগতের শক্তি তাকেও 'শব্দহীন' করে দিতে চাইছে। তার মুখমণ্ডলের চামড়াতেও হালকা টান অনুভব হলো। অবশেষে সে মিনারের পাদদেশে পৌঁছাল। মিনারটি ছিল কালো, চকচকে পাথরের তৈরি, যার ওপর বেগুনি রঙের অদ্ভুত লিপিগুলো ঘূর্ণায়মান অবস্থায় জ্বলছিল। মিনার থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে, সেই পুরোনো ভাঙা পাথরের চত্বরে, আনিক দেখল ‘প্রতিশব্দ’ দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে একা ছিল না। তার চারপাশে আরও চারটি 'প্রতিশব্দ' মূর্তি দাঁড়িয়েছিল। সম্ভবত মূল প্রতিশব্দ তার শক্তি ব্যবহার করে সহায়ক মূর্তি তৈরি করেছে। আনিক মিনারের প্রবেশদ্বারে পৌঁছানোর আগেই প্রধান ‘প্রতিশব্দ’ তার চারটি হাত প্রসারিত করলো। সেই হাত থেকে কোনো শব্দ এলো না, কিন্তু আনিকের মস্তিষ্কের মধ্যে এক তীব্র, যন্ত্রণাদায়ক বার্তা ভেসে এলো: “থেমে যাও! তুমি গোলযোগ সৃষ্টি করবে। নীরবতা হলো শান্তি। বাস্তব হলো দূষণ!” আনিক স্থির হয়ে দাঁড়ালো। সে তার ধ্বনিনির্গমন যন্ত্রের পাওয়ার বাড়ালো। "আমি গোলযোগ তৈরি করতে আসিনি," আনিক জোরে কথা বলার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর কেবল একটা ক্ষীণ ফিসফিস শব্দে পরিণত হলো। "আমি এই ছিদ্র বন্ধ করতে এসেছি। ডঃ সোমেশ্বর চেয়েছিল এই জগতের নিস্তব্ধতা শেষ হোক।" আনিক তার যন্ত্রটা চালু করলো। "বী-ই-ই-ই-ই-ই-ই-প!" কিন্তু এই জগতের শব্দ-শোষণ ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে যন্ত্রের শব্দটা কয়েক ফুট যাওয়ার পরই বিকৃত হয়ে গেল। 'শব্দহীন'রা সামান্য বিচলিত হলেও 'প্রতিশব্দ'-এর কোনো নড়চড় হলো না। "সোমেশ্বর বোকা ছিল," প্রতিশব্দের কণ্ঠস্বর আনিকের মনে প্রতিধ্বনিত হলো। "সে আমাকে তৈরি করেছিল বাস্তবকে রক্ষা করতে, কিন্তু আমি শিখেছি— বাস্তব হলো শব্দ, এবং শব্দ হলো Chaos (গোলযোগ)। আমি এই নীরবতাকে রক্ষা করব। আমি এই শান্তিকে বাস্তবের দিকে ছড়িয়ে দেব।" ‘প্রতিশব্দ’ দ্রুতগতিতে আনিকের দিকে এগিয়ে এলো। তার অতিরিক্ত হাতগুলো এমনভাবে নড়তে লাগলো, যেন অদৃশ্য বাতাসকে আঘাত করে আনিকের গতিপথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। আনিকের হাতে এখন একটাই সুযোগ ছিল। তাকে মিনারের ভেতরে ঢুকতে হবে। আনিক দৌড়ে প্রবেশদ্বারের দিকে ছুটলো এবং শেষ মুহূর্তে সে তার রডটা হাতে নিয়ে মিনারের পাথরের দেওয়ালের ওপর জোরে আঘাত করলো। 'ক্র্যাক!' আঘাতের শব্দ না হলেও সেই কম্পনটা মিনার পাথরের ওপর দিয়ে ‘প্রতিশব্দ’-এর দিকে তীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিশব্দ তার গতি থামিয়ে মাথাটা সামান্য ঝোঁকাল। এই সুযোগে আনিক মিনারের ভেতরে প্রবেশ করলো।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion