কলকাতা শহরের এক নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ল্যাব নম্বর চার। রাত দুটো। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলেও, এই ঘরের ভেতর কম্পিউটারের একটানা গুঞ্জন, কুলিং ফ্যানের মৃদু হিস্ হিস্ শব্দ আর কিবোর্ডের খটখট শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। অর্ক বোস, কম্পিউটার সায়েন্সের শেষ বর্ষের ছাত্র, তার মনিটরের দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন তার চোখের সামনে মহাবিশ্বের কোনো এক নতুন রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে। তার কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো, চশমার কাঁচ সামান্য ঝাপসা, আর চোখের নিচে গভীর কালির দাগ। সে গত ৭২ ঘণ্টায় মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছে।
"পেয়েছি! ইউরেকা!" অর্কর হঠাৎ চিৎকারে পাশে বসা তনয়া প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তনয়া, ডেটা অ্যানালিটিক্সে যার জুড়ি মেলা ভার, সে হাই তুলে বলল, "কী পেলি? বাগ? নাকি আবার নতুন কোনো ইউনিভার্সাল থিওরি? কফিটা অন্তত শেষ করতে দে।"
অর্ক তার চেয়ারটা সশব্দে ঘুরিয়ে নিল। ল্যাবের ফ্লুরোসেন্ট আলোয় তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল। "বাগ নয়, তনয়া। ফিউচার। ভবিষ্যৎ। একটা নিখুঁত, গণনাযোগ্য ভবিষ্যৎ।"
এই প্রজেক্টটা শুরু হয়েছিল মাস ছয়েক আগে। নাম 'নিয়তি' (Niyati)। অর্কর মস্তিষ্কপ্রসূত এই অ্যাপটা ছিল তার জীবনের সবথেকে বড় স্বপ্ন। অর্ক বরাবরই বিশৃঙ্খলাকে ঘৃণা করত। তার মতে, পৃথিবীর সব সমস্যার মূলে ছিল অনিশ্চয়তা। সে এমন একটা অ্যালগরিদম তৈরি করতে চেয়েছিল যা শুধু ব্যবহারকারীর অতীত ডেটা বিশ্লেষণ করবে না, বরং সেই ডেটার ওপর ভিত্তি করে, পারিপার্শ্বিক লক্ষ লক্ষ ভেরিয়েবল (যেমন ট্র্যাফিক, আবহাওয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড) মিলিয়ে তার নিকট ভবিষ্যতের ছোটখাটো ঘটনা নিখুঁতভাবে অনুমান করতে পারবে। সে চেয়েছিল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।
তাদের দলে ছিল মোট চারজন। অর্ক ছিল এই প্রকল্পের স্থপতি, কোডিং-এর মূল কারিগর। তনয়া ছিল ডেটা সায়েন্টিস্ট, যে লক্ষ লক্ষ ডেটা পয়েন্টের মধ্যে সেইসব সূক্ষ্ম সংযোগ খুঁজে বের করত যা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ত না। সে ছিল অর্কর প্রতিভার প্রধান ভক্ত এবং প্রধান সমালোচক।
রিয়া, অর্কর প্রেমিকা, ছিল দলের শৈল্পিক দিক—অ্যাপের ডিজাইন, ইউজার ইন্টারফেস (UI/UX) সবটাই তার দায়িত্বে। সে-ই 'নিয়তি'র লোগোটা ডিজাইন করেছিল—একটা শান্ত, নীল রঙের চক্র। সে চেয়েছিল অ্যাপটা যেন ব্যবহারকারীকে মানসিক শান্তি দেয়, তাদের 불안 না করে তোলে।
আর ছিল সুমিত, মার্কেটিং-এর জাদুকর। সুমিত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও তার আসল আগ্রহ ছিল ব্যবসায়। সে জানত কীভাবে একটা সামান্য জিনিসকে 'বিপ্লব' বলে বাজারে ছড়িয়ে দিতে হয়। সে-ই প্রথম দিন থেকে অর্ককে বলছিল, "তুই শুধু জিনিসটা বানা, আমি তোকে জুকারবার্গের পাশে বসিয়ে দেব।"
রিয়া কফির দুটো মগ হাতে নিয়ে ল্যাবে ঢুকল। "এখনও তোরা বাড়ি যাসনি? অর্ক, তোর চোখ দেখে মনে হচ্ছে ভ্যাম্পায়ার। তনয়া, তুই তো কাল বলছিলি বাড়ি গিয়ে ঘুমোবি।"
অর্ক রিয়ার হাত থেকে মগটা নিয়ে এক চুমুকে অর্ধেকটা শেষ করে দিল। কফিটা ছিল ঠান্ডা আর তেতো, কিন্তু তার সেদিকে খেয়াল ছিল না। "রিয়া, আমরা পেরেছি। 'নিয়তি' কাজ করছে। তনয়া, দেখ..."
অর্ক তার ফোনে অ্যাপটার বেটা (beta) ভার্সন খুলল। রিয়ার ডিজাইন করা ইন্টারফেসটা সত্যিই শান্তিদায়ক ছিল। মাঝখানে সেই নীল চক্র, তার নিচে লেখা— "আপনার আজকের 'নিয়তি' জানতে ট্যাপ করুন।"
অর্ক ট্যাপ করল। স্ক্রিনে লেখা উঠল: "আজ রাত ২:৩০ মিনিটে ল্যাবের কফি মেশিন কাজ করা বন্ধ করে দেবে। কারণ: ভোল্টেজ ফ্লাকচুয়েশন এবং দীর্ঘদিনের অব্যবহার।"
রিয়া হাসল। "খুব কাজের ভবিষ্যদ্বাণী। এটা দিয়ে কী হবে? লোকে কফি খাওয়া বন্ধ করে দেবে?"
তনয়া তার স্মার্টওয়াচে ঘড়ি দেখল। "দু'টো আঠাশ। আর দু'মিনিট। চল, দেখি।" তার চোখে অবিশ্বাস।
তিনজন কফি মেশিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেকেন্ডের কাঁটাটা বারো'র ঘর ছুঁতেই ঘড়ির কাঁটা ২:৩০ ছুঁল। ঠিক সেই মুহূর্তে ল্যাবের আলোটা একবার দপ্ করে জ্বলে উঠল। কফি মেশিনটা একটা অদ্ভুত ঘড়ঘড় আওয়াজ করে থেমে গেল। ডিসপ্লেতে জ্বলে উঠল 'ERROR 404: HEATING ELEMENT FAILURE'।
রিয়া আর তনয়ার মুখ হা হয়ে গেল।
"এটা... এটা কী করে সম্ভব?" তনয়া ফিসফিস করে বলল। "আমি তো ভোল্টেজ ডেটাটা অ্যালগরিদমে দিইনি!"
অর্ক হাসল। তার সেই হাসি, যা সে কোনো জটিল কোডের সমাধান করলে হাসে। "তুই দিসনি, কিন্তু আমি দিয়েছি। আমি কফি মেশিনের মেইনটেন্যান্স লগ, কলেজের পাওয়ার গ্রিডের গত তিন মাসের ভোল্টেজ ফ্লাকচুয়েশন ডেটা, আর এই মডেলের মেশিনের গড় আয়ু—সবকিছু আমার অ্যালগরিদমে ফিড করেছি। 'নিয়তি' শুধু ডেটা কো-রিলেট করেছে। ও জানত ঠিক এই ভোল্টেজ স্পাইকটাতেই মেশিনটার বারোটা বাজবে।"
পরের দিন সকালে তারা তাদের মেন্টর, প্রফেসর বোসের সামনে অ্যাপটা প্রেজেন্ট করল। প্রফেসর বোস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এবং মেশিন লার্নিং-এর একজন দিকপাল, সবটা মন দিয়ে শুনলেন। তিনি অর্কর বাবা'র বন্ধু ছিলেন এবং অর্ককে নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন।
তিনি প্রেজেন্টেশন শেষ হলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললেন, "অর্ক, তোমার কাজ অসাধারণ। টেকনিক্যালি, এটা একটা মাস্টারপিস। এই অ্যালগরিদম সত্যি যুগান্তকারী। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা করা খুব বিপজ্জনক।"
তিনি অর্কর দিকে সরাসরি তাকালেন। "মানুষ তার নিজের পছন্দের ওপর বাঁচে। 'ফ্রি উইল' বা স্বাধীন ইচ্ছাই মানুষকে মানুষ বানায়। তোমার অ্যাপ যদি সেই পছন্দকেই কেড়ে নেয়, যদি মানুষ অ্যাপের ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর নির্ভর করতে শুরু করে, তাহলে তার পরিণাম ভালো না-ও হতে পারে। একটা অ্যালগরিদম যেটা মানুষের পছন্দকে প্রেডিক্ট করতে পারে, সেটা খুব সহজেই মানুষের পছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে। তুমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বানাচ্ছ না, অর্ক। তুমি একটা অদৃশ্য খাঁচা বানাচ্ছ।"
সুমিত, যে এতক্ষণ চুপ করে ছিল, সে অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, "স্যার, আমরা তো শুধু ছোটখাটো মজা করার জন্য এটা করেছি। যেমন ধরুন, 'আজ আপনার লাঞ্চে বিরিয়ানি জুটবে' বা 'আজকের ক্লাসে সারপ্রাইজ টেস্ট হবে'। এটা মানুষকে তৈরি থাকতে সাহায্য করবে। একটা পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো।"
প্রফেসর বোস মৃদু, বিষণ্ণ হাসলেন। "আশা করি তাই। আশা করি তোমরা এই শক্তির ভার নিতে পারবে। অল দ্য বেস্ট।"
ল্যাব থেকে বেরিয়েই সুমিতের আসল রূপ দেখা গেল। "অসাধারণ! অর্ক, তুই জিনিয়াস! প্রফেসর বোস ওই পুরনো দিনের এথিক্স নিয়েই পড়ে থাকুন। আমরা পৃথিবী বদলে দিতে চলেছি! আমি কালকেই এটা কলেজের সার্ভারে লঞ্চ করছি। 'নিয়তি' - নো ইওর ডেসটিনি। কী বলিস?"
অর্ক প্রফেসর বোসের কথায় কিছুটা দ্বিধায় ছিল। "এত তাড়াতাড়ি? আমার মনে হয় আরও কিছু টেস্টিং দরকার। এথিক্যাল হ্যাকিং দরকার।"
সুমিত অর্কর কাঁধে হাত রাখল। "আরে ধুর! পারফেকশনের চক্করে থাকলে ট্রেন মিস হয়ে যাবে। রিয়া, তোর ডিজাইন রেডি তো? তনয়া, ডেটাবেস সামলাতে পারবি? ব্যস, তাহলেই হবে। কাল সকাল দশটায় লঞ্চ।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion