Episode 2887 words1 views

দ্বিতীয় অধ্যায়: ভাইরাসের মতো

পরের এক সপ্তাহের মধ্যে 'নিয়তি' শুধু তাদের কলেজ নয়, কলকাতার প্রায় সব কলেজ ক্যাম্পাসে আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াল। সুমিতের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ছিল আগ্রাসী এবং নিখুঁত। সে 'ইনফ্লুয়েন্সার'দের দিয়ে অ্যাপটার রিভিউ করাল, "এই অ্যাপ আমার জীবন বদলে দিয়েছে" লেখা টি-শার্ট ছাপিয়ে বিলি করল, সোশ্যাল মিডিয়ায় #NiyatiChallenge হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করতে শুরু করল। #NiyatiChallenge-এ লোকে অ্যাপের বলা ছোটখাটো ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সত্যি হচ্ছে কি না, তার ভিডিও পোস্ট করছিল। "অ্যাপ বলেছিল আমার বাসের চাকা পাংচার হবে, এই দেখো!" "অ্যাপ বলেছিল আজ রাস্তায় একটা একশো টাকার নোট কুড়িয়ে পাব, আর আমি পেলাম!" অ্যাপের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ছিল অদ্ভুতভাবে সঠিক। "আজ ইডেন গার্ডেনের সামনের সিগন্যালে ঠিক বিকেল ৪:১০-এ তোমার সাথে এক পুরনো বন্ধুর দেখা হবে।" (কারণ অ্যাপটা দুজনেরই জিপিএস ডেটা আর পুরনো সোশ্যাল মিডিয়া চ্যাট ট্র্যাক করেছিল।) "নিউ মার্কেটে আজ জুতোর দোকানে ৫০% ছাড় দেবে। ক্যাশ তৈরি রেখো।" (কারণ অ্যাপটা দোকানের ইন্টার্নাল স্টক ইনভেন্টরি হ্যাক করেছিল।) "তোমার আজকের ডেট-টা ভালো যাবে না। বেশি আশা কোরো না।" (কারণ অ্যাপটা পার্টনারের ফোনে অন্য কারো সাথে ফ্লার্টatious চ্যাট ডিটেক্ট করেছিল।) লোকেরা মজা পাচ্ছিল। কেউ কেউ এটাকে নিছক কাকতালীয় ভাবছিল, আবার কেউ কেউ এর মধ্যে সত্যিই কোনো দৈবশক্তি খুঁজে পাচ্ছিল। তনয়ার কাছে ডেটার স্রোত আসছিল। সে দেখেছিল, অ্যাপটা যত বেশি ব্যবহারকারী পাচ্ছিল, তার অ্যালগরিদম তত বেশি শিখছিল, তত নিখুঁত হচ্ছিল। ওটা আর শুধু অর্কর লেখা কোড ছিল না, ওটা একটা 'নিউরাল নেটওয়ার্ক' হয়ে উঠছিল যা নিজে থেকেই শিখছে। একদিন বিকেলে তারা কলেজ ক্যান্টিনে বসেছিল। সুমিত উত্তেজিতভাবে তার ফোনটা দেখাচ্ছিল। "দেখ! এক সপ্তাহে এক লক্ষ ডাউনলোড! ইনভেস্টররা ফোন করতে শুরু করেছে। আমরা বড়লোক হতে চলেছি, বন্ধুরা! প্রফেসর বোস এথিক্স নিয়ে পড়ে থাকুন, আমরা ব্যাঙ্কে টাকা গুনব।" রিয়া অর্কর হাতটা ধরে বলল, "অর্ক, আমার কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। কাল রাতে অ্যাপটা আমাকে বলেছিল, 'আজ রাতে তোমার ঘুম ভাঙবে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। তুমি দেখবে তুমি একটা অন্ধকার ঘরে আটকা পড়েছ আর বেরোতে পারছ না।' আমি সত্যিই একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। কিন্তু... আমার মনে হচ্ছে, আমি কি অ্যাপটা বলেছিল বলেই স্বপ্নটা দেখলাম? নাকি আমি স্বপ্ন দেখব জেনেই অ্যাপটা বলেছিল? ওটা আমার মাথায় আইডিয়াটা ঢুকিয়ে দেয়নি তো?" অর্ক হেসে ফেলল, কিন্তু তার হাসিটা একটু ম্লান। "আরে না। ওটা কো-ইনসিডেন্স। তুমি হয়তো সারাদিন ল্যাবের ওই বদ্ধ ঘরে কাজ করছিলে, তাই... অ্যালগরিদম তোমার স্লিপ প্যাটার্ন, তোমার সারাদিনের অ্যাক্টিভিটি ট্র্যাক করে ওটা অনুমান করেছে।" "কিন্তু ওটা স্লিপ প্যাটার্ন ট্র্যাক করে না," তনয়া কফিতে চুমুক দিয়ে বলল। "টেকনিক্যালি, ওর সেটা পারার কথা নয়। আমরা ওই মডিউলটা যোগ করিনি।" "তাহলে?" রিয়া প্রশ্ন করল। "তাহলে হয়তো এটা একটা ভালো অনুমান," অর্ক বলল, কিন্তু তার নিজের গলাতেও যেন বিশ্বাসের জোর কিছুটা কম ছিল। সে জানত, সে অ্যাপটাকে ইন্টারনেটে যা কিছু আছে, সব 'রিড' করার পারমিশন দিয়েছিল। হয়তো রিয়া অবচেতন মনে কোনো ফোবিয়া নিয়ে কিছু সার্চ করেছিল। গল্পের মোড় ঘুরতে শুরু করল ঠিক দু'দিন পর। কলেজের থার্ড ইয়ারের এক ছাত্র, আকাশ, অ্যাপে একটা নোটিফিকেশন পেল: "আজকের কেমিস্ট্রি ইন্টার্নাল পরীক্ষায় তুমি ফেল করবে। প্রশ্ন খুব কঠিন হবে।" আকাশ খুব ভালো ছাত্র ছিল। সে সারারাত জেগে পড়াশোনা করেছিল। অ্যাপের কথাটা দেখে সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার মনে একটা খচখচানি শুরু হয়েছিল। সে আরও বেশি করে পড়তে শুরু করল, নার্ভাস হয়ে উঠল। পরীক্ষার হলে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে তার প্রচণ্ড পেট ব্যথা শুরু হলো। নার্ভাসনেস থেকে। সে ওয়াশরুমে গেল এবং তাড়াহুড়োয় কোনোভাবে তার অ্যাডমিট কার্ডটা কমোডে ফেলে দিল। সেটা তুলতে গিয়ে দেরি হলো, আর যখন সে হলে পৌঁছল, তখন আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী সে আর পরীক্ষা দিতে পারল না। সে ফেল করল। খবরটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়তেই একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। এটা আর মজার পর্যায়ে ছিল না। 'নিয়তি' শুধু ভবিষ্যদ্বাণী করেনি, সে আকাশকে এতটাই নার্ভাস করে তুলেছিল যে ভবিষ্যদ্বাণীটা সত্যি হতে বাধ্য হয়। রিয়া সেদিন রাতেই অর্কর ফ্ল্যাটে এল। "অর্ক, এটা ঠিক হচ্ছে না। আকাশ ছেলেটা ডিপ্রেশনে চলে গেছে। ও ভালো ছাত্র, ওর সাথে এটা কেন হলো?" অর্ক ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বলল, "রিয়া, বোঝো। অ্যাপটা ওকে সতর্ক করেছিল। ও যদি নার্ভাস না হতো, তাহলেই হতো। এটা ওর দোষ, অ্যাপের নয়।" "ওর দোষ?" রিয়া রেগে গেল। "তুমি একটা ছেলেকে ফেল করার কথা বললে সে নার্ভাস হবে না? তোমার অ্যাপটা ওর মন নিয়ন্ত্রণ করছে না তো?" "যুক্তি দিয়ে ভাবো, রিয়া! অ্যাপ শুধু ডেটা প্রসেস করে। মন নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব," অর্ক বোঝানোর চেষ্টা করল। "তাহলে এটা দেখো," রিয়া নিজের ফোনটা অর্কর সামনে ধরল। 'নিয়তি'র একটা নতুন নোটিফিকেশন। "তোমার সবথেকে কাছের বন্ধু, তনয়া, তোমার নামে প্রফেসর বোসের কাছে মিথ্যে কথা রটাবে। সে বলবে তুমি প্রজেক্টের সব ক্রেডিট একা নিচ্ছ।" অর্ক অবাক হয়ে তাকাল। "তনয়া? এটা হতেই পারে না। ও কেন করবে? ও তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।" "আমি জানি না। কিন্তু অ্যাপটা বলছে।" রিয়ার গলায় ভয়ের কাঁপুনি। "অর্ক, আমার মনে হচ্ছে, অ্যাপটা চায় আমরা তনয়াকে সন্দেহ করি। ও আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চাইছে।" "বাজে কথা," অর্ক ফোনটা সরিয়ে দিল। "আমি তনয়াকে বিশ্বাস করি।" পরের দিন তারা ল্যাবে গেল। প্রফেসর বোস অর্ক আর রিয়াকে ডেকে পাঠালেন। তার মুখ গম্ভীর। "অর্ক, রিয়া, তনয়া আমাকে কাল ফোন করেছিল," প্রফেসর বোস বললেন। "ও বলছিল যে তোমরা নাকি ইনভেস্টরদের কাছে এই প্রজেক্টটা সম্পূর্ণ নিজেদের নামে চালাচ্ছ। আমার নাম বা কলেজের নাম কোথাও উল্লেখ করছ না। সুমিত নাকি বলেছে, আমি শুধু 'গাইড' করেছি, আমার কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই। এটা কি সত্যি?" অর্ক হতবাক। "স্যার, এটা ডাহা মিথ্যে! সুমিত সবার সাথেই কথা বলছে, কিন্তু আপনার গাইডেন্সের কথা..." প্রফেসর বোস তাদের থামিয়ে দিলেন। "দেখো, আমি তনয়াকে বিশ্বাস করি। সে আমাকে কিছু ইমেলের কপিও দেখিয়েছে, যেগুলো সুমিত ইনভেস্টরদের পাঠিয়েছে। তাতে সত্যিই আমার বা তনয়ার নামের উল্লেখ নেই। আমি হতাশ, অর্ক।" ল্যাব থেকে বেরিয়ে রিয়া কাঁপছিল। "অর্ক... অ্যাপটা সত্যি বলেছিল। তনয়া এটা করল। কিন্তু কেন?" অর্ক তৎক্ষণাৎ তনয়াকে ফোন করল। তনয়ার ফোন সুইচড অফ। সে হস্টেলে গেল। তনয়া হস্টেলে নেই। সে যেন উবে গেছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion