চরিত্র পরিচিতি:
আকাশ: দলের নেতা, ইতিহাসের ছাত্র। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা তাকে রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। সে যুক্তিবাদী হলেও, অজানা এবং অলৌকিকতার প্রতি তার এক গভীর কৌতূহল আছে। তার পরিবারে পুরোনো গল্প এবং লোককথা নিয়ে চর্চা হয়, যা তাকে এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। সে বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত এবং ধৈর্যশীল। তার বিশ্বাস, প্রতিটি রহস্যের পেছনেই একটি যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা থাকে, কিন্তু এই জমিদার বাড়ি তার সেই বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল। তার স্বপ্ন ছিল এমন একটি ঐতিহাসিক আবিষ্কার করা, যা তার নাম ইতিহাসে অমর করে রাখবে, কিন্তু সে জানত না, এই আবিষ্কার তাকে এক ভিন্ন জগতের মুখোমুখি করবে। তার শৈশবে শোনা দাদু-দিদার ভূতের গল্পগুলো তার মনে এক অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি করেছিল, যা তাকে বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে উৎসাহিত করত।
সোহিনী: প্যারানর্মাল বিষয়ে আগ্রহী, সংবেদনশীল এবং কিছুটা স্বাপ্নিক। সে ছোটবেলা থেকেই অদৃশ্য শক্তি অনুভব করতে পারে, যা তাকে অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা করে তুলেছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত প্রখর। সে প্রায়শই অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করে এবং তাদের বার্তা বোঝার চেষ্টা করে। তার এই ক্ষমতা কখনও কখনও তাকে ভীত করে তোলে, আবার কখনও তাকে রহস্যের সমাধানের দিকে চালিত করে। তার স্বপ্ন ছিল একদিন এমন একটি স্থানে যাবে যেখানে অলৌকিকতা এতটাই স্পষ্ট যে তা আর অস্বীকার করা যাবে না। রায়চৌধুরী ভিলা যেন তার সেই স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলছিল, কিন্তু তার কল্পনার চেয়েও ভয়ংকরভাবে। ছোটবেলায় তার প্রিয় পোষা বিড়ালটি হারিয়ে যাওয়ার পর সে তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারত, তার গায়ে বিড়ালের লোমের স্পর্শ অনুভব করত, যা তাকে অদৃশ্য শক্তির প্রতি বিশ্বাসী করে তুলেছিল।
রনি: অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, কিছুটা বেপরোয়া এবং গুপ্তধনের প্রতি তার এক তীব্র লোভ রয়েছে। সে শারীরিক শক্তি এবং সাহসের উপর বেশি নির্ভর করে। তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে, যা তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত করে। সে মনে করে, এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে গুপ্তধনই আসল পুরস্কার। তার এই লোভই তাকে কখনও কখনও বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, কিন্তু সে বরাবরই বিশ্বাস করে যে ঝুঁকি না নিলে বড় কিছু পাওয়া যায় না। তার চোখে সবসময়ই এক ঝলমলে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, যেখানে সে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে। তার পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন ছিল, যা তাকে সবসময়ই দ্রুত বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখাত।
মিতু: বাস্তববাদী, সতর্ক এবং কিছুটা ভীতু। সে বিজ্ঞান ও যুক্তিতে বিশ্বাসী। যেকোনো পরিস্থিতিতে সে প্রথমে বিপদ এড়ানোর চেষ্টা করে এবং বন্ধুদের সতর্ক করে। তার ভয় তাকে অযৌক্তিক করে তোলে না, বরং তাকে আরও সতর্ক করে তোলে। সে বন্ধুদের নিরাপত্তার বিষয়ে অত্যন্ত চিন্তিত এবং এই অ্যাডভেঞ্চার থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার পক্ষপাতী। তার মন সবসময়ই সম্ভাব্য বিপদগুলো নিয়ে ভাবে, আর তার এই স্বভাবই অনেক সময় তাদের রক্ষা করে। তার কাছে, এই বাড়িটি ছিল এক বিপজ্জনক জুয়া, যেখানে তারা নিজেদের জীবন বাজি ধরছিল, আর সে এই জুয়ায় অংশ নিতে চায়নি। ছোটবেলায় একটি পুরোনো, অন্ধকার বাড়িতে আটকে পড়ার অভিজ্ঞতা তাকে অন্ধকার এবং অজানা স্থানের প্রতি এক গভীর ভীতি তৈরি করেছিল।
বৃদ্ধ হরিপদ: গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা, রায়চৌধুরী ভিলার অন্ধকার ইতিহাস সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান আছে। সে রহস্যময় এবং সতর্কবাণী দিতে পছন্দ করে, কিন্তু সরাসরি কিছু বলে না। তার চোখে এক দীর্ঘদিনের ভয় আর ক্লান্তি লেগে আছে, যা দেখে মনে হয় সে অনেক কিছু দেখেছে এবং সহ্য করেছে। তার নীরবতা এবং অস্পষ্ট কথাগুলো গল্পের সাসপেন্স বাড়িয়ে তোলে। সে যেন অতীতের এক জীবন্ত সাক্ষী, যা বর্তমানকে সতর্ক করতে চায়।
এক রহস্যের হাতছানি
গ্রীষ্মের প্রখর দুপুর। সূর্য যেন আকাশ থেকে আগুন ঝরাচ্ছে, তার তীব্র রশ্মি দিগন্তের ধূসর রেখায় মিশে এক অদ্ভুত বিভ্রম তৈরি করছে। বাতাস ছিল স্থির, তাতে কোনো আর্দ্রতা নেই, শুধু শুষ্কতার এক তীব্র অনুভূতি, যা ত্বককে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। চার বন্ধু – আকাশ, সোহিনী, রনি এবং মিতু – একটি পুরোনো, কিন্তু শক্তিশালী জিপে করে ছুটে চলেছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে। তাদের এবারের অ্যাডভেঞ্চারের নাম ‘রায়চৌধুরী ভিলা’। এই নামটা শুনলেই স্থানীয়দের চোখে এক মিশ্র ভয় আর শ্রদ্ধার ভাব ফুটে ওঠে, তাদের মুখে এক অস্পষ্ট ফিসফিসানি শুরু হয়। শহরের কোলাহল থেকে বহু দূরে, প্রায় তিনশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, এক নির্জন গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি। চারপাশে ঘন জঙ্গল আর পুরোনো আমলের গাছপালা, যা দিনের বেলাতেও এক অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। জিপের জানালা দিয়ে আসা গরম বাতাস তাদের মুখে লাগছিল, কিন্তু তাদের মনে এক ভিন্ন উত্তেজনা কাজ করছিল, এক অজানা রহস্যের হাতছানি তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক অচেনা গহীনতার দিকে।
রায়চৌধুরী পরিবার ছিল বাংলার এক প্রাচীন এবং প্রভাবশালী জমিদার বংশ, যারা প্রায় তিন শতাব্দী ধরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতাপের সাথে রাজত্ব করেছিল। তাদের জমিদারী ছিল বিশাল, যা গ্রামের পর গ্রাম বিস্তৃত ছিল। মূল ভিলাটি ছিল স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন, যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণ দেখা যেত। জমিদারী শুধু ধনসম্পদেই সমৃদ্ধ ছিল না, বরং তাদের সংস্কৃতি, জ্ঞানচর্চা এবং প্রজাবাৎসল্যের জন্যও তারা পরিচিত ছিল। জমিদার বংশের প্রথম পুরুষ, শ্রীকান্ত রায়চৌধুরী, ছিলেন একজন দূরদর্শী এবং ন্যায়পরায়ণ শাসক। তার সময়ে প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করত, আর জমিদার বাড়ি ছিল জ্ঞান ও শিল্পের এক কেন্দ্র।
তবে, সময়ের সাথে সাথে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পরিবারের মূল্যবোধে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। একসময় যে পরিবার জ্ঞান এবং ন্যায়পরায়ণতাকে মূল্য দিত, ধীরে ধীরে তারা ভোগবিলাস এবং ক্ষমতার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। বিশেষ করে, জমিদারী প্রথার শেষ দিকে, যখন ব্রিটিশ শাসন এবং অর্থনৈতিক চাপ বাড়তে শুরু করে, তখন রায়চৌধুরী পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। তাদের বিশাল জমিদারী থেকে আয় কমে যায়, আর তাদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এই সময়, পরিবারের সদস্যরা দ্রুত অর্থ উপার্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা পুরোনো দলিলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে, গুপ্তধনের সন্ধানে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, যা তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
আকাশ, তার ল্যাপটপে জমিদার বাড়ির পুরোনো মানচিত্র আর কিছু ঐতিহাসিক নথি ঘাঁটছিল। তার চোখে ছিল এক গভীর মনোযোগ, যেন সে প্রতিটি শব্দ আর রেখার মধ্যে লুকিয়ে থাকা রহস্য উন্মোচন করতে চাইছে। তার আঙুলগুলো পুরোনো মানচিত্রের রেখাগুলোর উপর দিয়ে ঘুরছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে প্রতিটি কোণকে নিজের মনে এঁকে নিচ্ছে। “এই বাড়িটা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, জানিস? প্রায় একশো বছর আগে, জমিদার রায়চৌধুরীর পুরো পরিবার এক রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিল। কেউ জানে না আগুনটা কীভাবে লেগেছিল, বা কেন তারা কেউ পালাতে পারেনি। শুধু একটা গুজব আছে, তাদের বিপুল ধনসম্পদ নাকি বাড়ির গোপন কুঠুরিতে আজও লুকিয়ে আছে,” আকাশ বলল, তার গলায় এক গবেষকের দৃঢ়তা। তার পরিবারে পুরোনো গল্প এবং লোককথা নিয়ে চর্চা হয়, যা তাকে এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। সে বিশ্বাস করত, ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় নয়, পুরোনো ইঁটের দেওয়ালেও লুকিয়ে থাকে, আর তাকে খুঁজে বের করাই আসল চ্যালেঞ্জ। তার দাদু প্রায়শই তাকে পুরোনো জমিদার বাড়িগুলোর গল্প বলতেন, যেখানে গুপ্তধন আর অভিশাপের কাহিনি মিশে থাকত, আর সেই গল্পগুলোই আকাশের মনে এক গভীর কৌতূহল তৈরি করেছিল।
রায়চৌধুরী পরিবারের ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় ছিল – জমিদার বংশের তৃতীয় পুরুষ, মহেন্দ্র রায়চৌধুরী, যিনি ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ তান্ত্রিক। তাঁর ক্ষমতা ছিল কিংবদন্তী, কিন্তু সেই ক্ষমতার উৎস ছিল এক ভয়ংকর গোপনীয়তা। মহেন্দ্র রায়চৌধুরী শুধু জমিদারী শাসন করতেন না, তিনি গভীর রাতে অশুভ শক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতেন, প্রাচীন পুঁথি ঘেঁটে নিষিদ্ধ মন্ত্রের সাধনা করতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অসীম ক্ষমতা অর্জন করা, যা তাঁকে শুধু ধনসম্পদ নয়, বরং অমরত্ব এনে দেবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই পৃথিবীতে এমন কিছু শক্তি লুকিয়ে আছে, যা সাধারণ মানুষের কল্পনারও অতীত। তাঁর এই সাধনা তাঁকে গ্রামের মানুষের কাছে এক মিশ্র ভয় আর শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল। গ্রামের লোকেরা তাঁকে “তান্ত্রিক জমিদার” বলে ডাকত, তাঁর নাম শুনলেই তাদের মনে এক অজানা আতঙ্ক তৈরি হতো।
মহেন্দ্র রায়চৌধুরী তাঁর তান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমে এক প্রাচীন মন্দিরের গভীরে লুকানো একটি “প্রাণ-পাথর” খুঁজে পেয়েছিলেন। এই পাথরটি ছিল কোনো সাধারণ রত্ন নয়, এটি ছিল এক জীবন্ত শক্তি, যা হাজার হাজার বছর ধরে মাটির গভীরে ঘুমিয়ে ছিল। এই পাথরটি ধারণ করত অসীম ক্ষমতা, যা মানুষের লোভ এবং আকাঙ্ক্ষাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিত, আর তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেত। মহেন্দ্র রায়চৌধুরী জানতেন এই পাথরের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে, কিন্তু তাঁর লোভ তাঁকে অন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, তিনি এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং এটিকে নিজের কাজে লাগাতে পারবেন। তিনি এই পাথরকে জমিদার বাড়ির বেসমেন্টের গভীরে একটি গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখেছিলেন, যেখানে তিনি নিয়মিত নিষিদ্ধ আচারের মাধ্যমে এর শক্তিকে নিজের বশে আনার চেষ্টা করতেন। তাঁর এই আচারগুলো ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর – তিনি মধ্যরাতে নরবলি দিতেন, অশুভ মন্ত্র পাঠ করতেন, আর তাঁর চারপাশে এক ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি হতো। এই আচারগুলোই এই “প্রাণ-পাথর”-কে আরও বেশি অভিশপ্ত করে তুলেছিল।
সোহিনী, জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। তার চোখজোড়া যেন দূরের গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অশরীরী কিছু খুঁজছিল। তার চুলগুলো বাতাসে উড়ছিল, আর তার মুখমণ্ডলে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল, যা তার সংবেদনশীলতার পরিচয় দিচ্ছিল। তার চোখজোড়া যেন এক অদৃশ্য জগতের দিকে তাকিয়ে ছিল, যা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে না। “আর স্থানীয়রা বলে, জমিদার পরিবারের অতৃপ্ত আত্মারা নাকি আজও সেই বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়, তাদের গুপ্তধন পাহারায় ব্যস্ত,” সে ফিসফিস করে বলল, তার গলায় এক অদ্ভুত উত্তেজনা। সোহিনীর এই প্যারানর্মাল বিষয়ে আগ্রহ বহুদিনের। সে ছোটবেলা থেকেই অদৃশ্য শক্তি অনুভব করতে পারে, যা তাকে অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা করে তুলেছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত প্রখর। সে প্রায়শই অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করে এবং তাদের বার্তা বোঝার চেষ্টা করে। তার স্বপ্ন ছিল একদিন এমন একটি স্থানে যাবে যেখানে অলৌকিকতা এতটাই স্পষ্ট যে তা আর অস্বীকার করা যাবে না। রায়চৌধুরী ভিলা যেন তার সেই স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলছিল, কিন্তু তার কল্পনার চেয়েও ভয়ংকরভাবে। ছোটবেলায় তার প্রিয় পোষা বিড়ালটি হারিয়ে যাওয়ার পর সে তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারত, তার গায়ে বিড়ালের লোমের স্পর্শ অনুভব করত, যা তাকে অদৃশ্য শক্তির প্রতি বিশ্বাসী করে তুলেছিল।
রনি, গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে হাসল। তার চোখে এক ঝলমলে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, যেখানে সে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে। তার হাতে স্টিয়ারিং, আর তার মনে এক অদম্য সাহস। “আত্মা-টাত্মা সব বাজে কথা। আসল জিনিস হলো গুপ্তধন! যদি সত্যিই কিছু থাকে, তাহলে তো আমাদের কপাল খুলে যাবে! আমরা কোটিপতি হয়ে যাব!” তার কথায় এক ধরনের বেপরোয়া ভাব ছিল, যা তার আর্থিক টানাপোড়েনের অতীতকে লুকিয়ে রাখতে চাইছিল। রনি সবসময়ই অ্যাডভেঞ্চার আর ঝুঁকির সন্ধানে থাকে, আর এই ধরনের পুরোনো বাড়িতে গুপ্তধনের সম্ভাবনা তাকে আরও বেশি উৎসাহিত করে তুলেছে। সে মনে করত, সাহস আর একটু বুদ্ধি থাকলেই যেকোনো কিছু জয় করা যায়, আর এই গুপ্তধন তার জীবনের সবচেয়ে বড় জয় হতে চলেছে।
মিতু, পিছনের সিটে বসে ছিল, তার মুখে এক উদ্বেগের ছাপ। তার চোখজোড়া বারবার পথের দু’পাশের ঘন জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিল, যেন সে যেকোনো মুহূর্তে কোনো বিপদ আশা করছিল। তার হাতগুলো তার ব্যাগের চেইন ধরে শক্ত করে চেপে ধরেছিল। “তোমরা কি নিশ্চিত যে এটা ভালো আইডিয়া? আমি শুনেছি, ওই বাড়ির আশেপাশে নাকি কেউ যায় না। গ্রামবাসীও নাকি ওদিক মাড়াতে ভয় পায়। এটা কি আদৌ নিরাপদ? আমার মনে হচ্ছে, আমরা এক বড় বিপদের দিকে যাচ্ছি।” মিতু বরাবরই বাস্তববাদী এবং সতর্ক। তার মনে সবসময়ই একটা অজানা ভয়ের বাসা বেঁধে থাকে, আর এই ধরনের ভূতুড়ে বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনলেই তার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। তার কাছে, এই বাড়িটি ছিল এক বিপজ্জনক জুয়া, যেখানে তারা নিজেদের জীবন বাজি ধরছিল, আর সে এই জুয়ায় অংশ নিতে চায়নি। ছোটবেলায় একটি পুরোনো, অন্ধকার বাড়িতে আটকে পড়ার অভিজ্ঞতা তাকে অন্ধকার এবং অজানা স্থানের প্রতি এক গভীর ভীতি তৈরি করেছিল।
আকাশ মিতুকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। “আরে বাবা, আমরা তো আর ভূত ধরতে যাচ্ছি না। আমরা শুধু একটা ঐতিহাসিক বাড়িতে যাচ্ছি, কিছু পুরোনো জিনিসপত্র দেখতে। আর যদি গুপ্তধন থাকে, সেটা তো বোনাস! আমরা শুধু তথ্য সংগ্রহ করব।” সে হাসল, কিন্তু তার হাসির পেছনেও এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ছিল, যা সে গোপন করার চেষ্টা করছিল।
তাদের জিপ আঁকাবাঁকা, কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। পথের দু’পাশে ঘন জঙ্গল ক্রমশ আরও গভীর হতে লাগল, গাছগুলো যেন একে অপরের সাথে মিশে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ তৈরি করছিল, যা সূর্যালোককে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছিল। সূর্যালোক গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সামান্যই প্রবেশ করছিল, যার ফলে এক অদ্ভুত ছায়া-ছায়া পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বাতাসের সাথে মিশে আসছিল পুরোনো পাতার গন্ধ, পচে যাওয়া কাঠের গন্ধ, আর মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল অজানা পাখির ডাক, যা একাকীত্বের অনুভূতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে তারা কিছু পুরোনো, জীর্ণ কুঁড়েঘর দেখতে পাচ্ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল বহু বছর ধরে কেউ সেখানে বাস করে না। এই কুঁড়েঘরগুলোর ভাঙা জানালাগুলো যেন তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, এক নীরব প্রশ্ন নিয়ে, তাদের অতীত জীবনের গল্প বলতে চাইছে। গ্রামবাসীরা যখন তাদের জিপ দেখতে পেত, তারা দ্রুত তাদের ঘরের ভেতরে ঢুকে যেত, তাদের চোখে ছিল এক গভীর ভয়। কিছু শিশু অবশ্য কৌতূহলবশত উঁকি মারত, কিন্তু তাদের মায়েরা দ্রুত তাদের টেনে ভেতরে নিয়ে যেত।
গ্রামের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তারা একটি সরু পথ ধরে এগিয়ে গেল। পথটি ক্রমশ আরও সংকীর্ণ হয়ে আসছিল, আর দু’পাশের ঝোপঝাড় এতটাই ঘন ছিল যে জিপ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। রনি সাবধানে জিপ চালাচ্ছিল, তার চোখ সামনের পথের দিকে নিবদ্ধ। গাড়ির চাকা থেকে ধুলো উড়ছিল, যা সন্ধ্যার আবছা আলোয় এক কুয়াশার মতো দেখাচ্ছিল, যেন তারা এক অদৃশ্য জগতে প্রবেশ করছে, যেখানে সময় থমকে গেছে।
অবশেষে, প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার মুখে, তারা রায়চৌধুরী ভিলার সামনে পৌঁছাল। বিশাল লোহার গেটটি জং ধরে লাল হয়ে আছে, তার উপর লতাপাতা জড়িয়ে এক ভৌতিক রূপ ধারণ করেছে। গেটের উপরে জমিদার বাড়ির নাম লেখা একটি ফলক, কিন্তু সেটিও প্রায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে, শুধু ‘রায়চৌধুরী ভিলা’ নামটি অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল, তার উপর শ্যাওলা জমে ছিল। ফলকের উপর জমে থাকা শ্যাওলা আর ধুলো তার পুরোনো ঐতিহ্যকে আরও রহস্যময় করে তুলেছিল। গেটের ওপাশে বিশাল এক বাগান, যা বহু বছর ধরে পরিচর্যাহীন। শুকনো পাতা আর আগাছায় ভরা সেই বাগান পেরিয়ে বাড়িটির মূল কাঠামো দেখা যাচ্ছিল। বাড়িটি দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক বিশাল দানব ঘুমিয়ে আছে, তার চোখগুলো বন্ধ, আর তার শরীর ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা। ভাঙা জানালাগুলো যেন তার শূন্য চোখ, যা অতীতের সব ভয়াবহতা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এক নীরব সাক্ষী হয়ে।
মিতু শিউরে উঠল। তার শরীর কাঁপছিল, তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। “আমার কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে, বাড়িটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে আমাদের স্বাগত জানা জানাচ্ছে না, বরং সতর্ক করছে। আমার মনে হচ্ছে, এখানে কিছু একটা ভুল আছে।” তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।
সোহিনী শান্তভাবে বলল, “হ্যাঁ, বাড়িটার মধ্যে একটা শক্তি আছে। আমি অনুভব করতে পারছি। এটা শুধু পুরোনো বাড়ি নয়, এটা এক জীবন্ত সত্তা, যা বহু বছর ধরে এখানে আটকে আছে।” তার চোখজোড়া যেন বাড়ির প্রতিটি কোণকে স্ক্যান করছিল, অদৃশ্য কিছুকে খুঁজছিল।
রনি হেসে বলল, “শক্তি তো থাকবেই, গুপ্তধনের শক্তি! চলো, আর দেরি না করে ভেতরে ঢুকি। যত তাড়াতাড়ি গুপ্তধন পাব, তত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হতে পারব।” তার মুখে এক বিজয়ীর হাসি, যেন সে ইতিমধ্যেই গুপ্তধন পেয়ে গেছে।
তারা জিপ থেকে তাদের ব্যাগপত্র নামাল। টর্চলাইট, জলের বোতল, কিছু শুকনো খাবার, আর প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম – সবকিছু সাবধানে গুছিয়ে নিল। আকাশ তার ক্যামেরা আর নোটবুক নিল, তার মনে নতুন তথ্যের সন্ধানে এক গভীর আগ্রহ। সোহিনী তার প্যারানর্মাল ডিটেকশন কিট, যার মধ্যে একটি ইএমএফ মিটার এবং একটি ভয়েস রেকর্ডার ছিল, সেগুলো গুছিয়ে নিল। তারা প্রস্তুত ছিল, কিন্তু তারা জানত না, এই বাড়ির ভেতরে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। এক শতাব্দীর পুরোনো রহস্য, অতৃপ্ত আত্মাদের ফিসফিসানি, আর এক ভয়ংকর অভিশাপ – সব মিলে এক অদৃশ্য জাল তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, যা তাদের জীবনকে চিরতরে বদলে দেবে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion