Episode 22249 words0 views

রায়চৌধুরী ভিলার অভিশাপ: দ্বিতীয় পর্ব

অশরীরী ফিসফিসানি ধীরে ধীরে তারা বাড়ির মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বিশাল কাঠের দরজাটি ছিল ভারী এবং জীর্ণ, তার উপর খোদাই করা পুরোনো নকশাগুলো প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে, সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়ে গেছে। দরজার কড়া ধরে আকাশ টান দিতেই এক বিকট ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটি খুলে গেল। সেই শব্দে যেন পুরো বাড়িটিই কেঁপে উঠল, আর তাদের মনে এক অজানা ভয় বাসা বাঁধল, যেন তারা এক নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশ করছে। ভেতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাদের নাকে এসে লাগল। বহু বছরের পুরোনো ধুলো, পচে যাওয়া কাঠ, মাকড়সার জাল আর এক অজানা গন্ধের মিশ্রণ, যা শ্বাস নিতে কষ্ট দিচ্ছিল, যেন বাতাস বিষাক্ত হয়ে গেছে। বাতাস যেন স্থির হয়ে আছে, কোনও নড়াচড়া নেই, যেন সময় এখানে থমকে গেছে, আর তারা এক ভিন্ন মাত্রায় প্রবেশ করেছে। বিশাল হলঘরটি অন্ধকারে ডুবে ছিল। দিনের আলো সামান্যই প্রবেশ করছিল ভাঙা জানালা দিয়ে, যা হলঘরের মাঝখানে এক অস্পষ্ট আলো-ছায়ার খেলা তৈরি করছিল। সেই আলো-ছায়ার খেলায় আসবাবপত্রগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। হলঘরের মাঝখানে একটি বিশাল ঝাড়বাতি, তার কাঁচগুলো ভেঙে ঝুলে আছে, তার উপর ধুলোর পুরু আস্তরণ। ঝাড়বাতিটি যেন এক মৃতদেহ, যা একসময় এই হলঘরকে আলোকিত করত, আর এখন তার শূন্যতা আরও ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। চারপাশে জীর্ণ আসবাবপত্র, ধুলোর পুরু আস্তরণে ঢাকা। পুরোনো সোফা, চেয়ার, টেবিল – সবই যেন অতীতের নীরব সাক্ষী, তাদের উপর জমে থাকা ধুলো যেন সময়ের চিহ্ন, যা বহু বছর ধরে কেউ স্পর্শ করেনি। মাকড়সার জাল যেন পুরো বাড়িটিকে এক বিশাল সাদা চাদরে মুড়ে রেখেছে, যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন বাড়িটি বহু বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে, আর তারা সেই ঘুম ভাঙাতে এসেছে। প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি ফাটলে যেন এক অদৃশ্য চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। “উফফ, কী নোংরা!” মিতু নাক কুঁচকে বলল। তার চোখে বিরক্তি আর ভয় মিশে ছিল। “এখানে কি সত্যিই থাকা যাবে? আমার মনে হয়, আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। আমার গা গুলিয়ে উঠছে, আমি শ্বাস নিতে পারছি না।” “আমরা শুধু এক রাত থাকব। কাল সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়ব,” আকাশ তাকে আশ্বস্ত করল, যদিও তার নিজের মনেও এক ধরনের চাপা উদ্বেগ ছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই বাড়িটি তাদের কল্পনার চেয়েও বেশি ভয়ংকর, আর তাদের এই অ্যাডভেঞ্চার তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হতে পারে। রনি তার টর্চ জ্বেলে চারপাশে আলো ফেলল। তার চোখে এখনও গুপ্তধনের নেশা। “চলো, একটা থাকার মতো জায়গা খুঁজে বের করি। যত তাড়াতাড়ি গুপ্তধন খুঁজে পাব, তত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হতে পারব।” তার গলায় এক ধরনের অস্থিরতা ছিল, যেন সে দ্রুত সবকিছু শেষ করতে চাইছে। তারা বাড়ির ভেতরে ঘুরে ঘুরে একটি কক্ষ খুঁজে পেল, যেটি তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত। কক্ষটির একটি বড় জানালা ছিল, যা দিয়ে বাইরের আলো প্রবেশ করছিল। কক্ষের মেঝেতে পুরোনো কার্পেট ছিল, যা ধুলো আর নোংরায় ভরে ছিল। কার্পেটের উপর পায়ের ছাপ দেখে মনে হচ্ছিল যেন বহু বছর ধরে কেউ এখানে হাঁটাচলা করেনি, আর সেই ছাপগুলো যেন এক অদৃশ্য পথের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তারা সেই কক্ষটি পরিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিল। ঝাড়ু আর কাপড় দিয়ে তারা ধুলো ঝাড়তে শুরু করল। ধুলোর কণাগুলো বাতাসে উড়ছিল, আর তাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, যেন তারা এক ধুলোর সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছিল। মিতু অবশ্য একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখ চারপাশে সতর্কভাবে ঘোরাচ্ছিল, যেন সে যেকোনো মুহূর্তে বিপদ আশা করছিল। তার মনে হচ্ছিল যেন অদৃশ্য কোনো চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর সেই চোখগুলো তাকে অনুসরণ করছে। পরিষ্কার করতে করতে সোহিনী হঠাৎ থেমে গেল। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, তার হাতের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। তার মনে হলো যেন কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, যদিও সেখানে কেউ ছিল না। তার কানের কাছে এক অস্পষ্ট ফিসফিসানি শোনা গেল, যা তার নাম ধরে ডাকছিল। “তোমরা কি কিছু অনুভব করছো?” তার গলা সামান্য কেঁপে উঠল, তার চোখজোড়া শূন্যে কিছু খুঁজছিল। আকাশ এবং রনি কাজ করছিল। রনি বলল, “কী অনুভব করব? ধুলো আর গরম বাতাস ছাড়া তো কিছু নেই। তুমি হয়তো ক্লান্ত হয়ে গেছো।” সে সোহিনীর কথাকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার নিজের মনেও এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছিল। “একটা ঠান্ডা বাতাস… যা হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে… আর কানের কাছে যেন কেউ ফিসফিস করছে,” সোহিনী বলল, তার চোখজোড়া যেন শূন্যে কিছু খুঁজছিল। “শব্দটা খুব অস্পষ্ট, কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ আমাকে সতর্ক করছে… ‘যাও… ফিরে যাও…'” সে তার মাথা ঝাঁকাল, যেন সেই শব্দটিকে দূর করতে চাইছে। মিতু অবশ্য সোহিনীর দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনেও এক অজানা ভয় কাজ করছিল। সে সোহিনীর সংবেদনশীলতার কথা জানত, আর তাই তার কথাকে উড়িয়ে দিতে পারছিল না। সে তার হাত দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ধরল, যেন নিজেকে কোনো অদৃশ্য বিপদ থেকে রক্ষা করতে চাইছে। তারা কক্ষটি মোটামুটি পরিষ্কার করে তাদের ব্যাগপত্র রাখল। বাইরে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আর বাড়ির ভেতরে অন্ধকার আরও গভীর হচ্ছে। তারা টর্চ জ্বেলে চারপাশে আলো ফেলল। কক্ষের এক কোণে একটি পুরোনো কাঠের আলমারি ছিল। আলমারিটির উপর ধুলোর পুরু আস্তরণ, আর তার কাঁচগুলো ভেঙে গেছে। আলমারির কাঠের উপর খোদাই করা নকশাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো পুরোনো গল্প বলছে। রনি আলমারিটি খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটি জং ধরে আটকে ছিল। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে টানল, কিন্তু আলমারিটি এক ইঞ্চিও নড়ল না। তার হাতে ব্যথা করছিল, আর তার মনে এক ধরনের হতাশা কাজ করছিল। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাস আরও তীব্র হতে লাগল। তারা সবাই কক্ষের মাঝখানে বসে ছিল, টর্চের আলোয় একে অপরের মুখ দেখছিল। তাদের চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, যা তাদের মনে এক অজানা ভয় তৈরি করছিল। সোহিনী তার ইএমএফ মিটার চালু করল। মিটারটি প্রথমে স্থির ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই তার কাঁটাটি ওঠানামা করতে শুরু করল, আর তার সাথে একটি মৃদু বীপ শব্দও শোনা গেল। বীপ শব্দটা ক্রমশ বাড়ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের আরও কাছে আসছে, তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। “দেখো! মিটারটা নড়ছে!” সোহিনী উত্তেজিত হয়ে বলল। তার চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “এখানে কিছু একটা আছে। এই রিডিংটা অস্বাভাবিক। এটা কোনো সাধারণ ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড নয়, এটা এক শক্তিশালী অশরীরী উপস্থিতি।” আকাশ মিটারটি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল। “হুম, এটা অস্বাভাবিক। কিন্তু এর পেছনে অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। হয়তো পুরোনো তার বা কোনো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড।” সে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজতে চাইছিল, কিন্তু তার নিজের মনেও এক ধরনের সংশয় ছিল। রনি অবশ্য তখনও গুপ্তধনের চিন্তায় মগ্ন। “হয়তো গুপ্তধনের শক্তি! চলো, আরও খুঁজি। যত তাড়াতাড়ি খুঁজে পাব, তত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হতে পারব.” তার চোখে এক ধরনের উন্মাদনা ছিল, যা তাকে যেকোনো ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত করছিল। রনি তার টর্চ নিয়ে বাড়ির ভেতরে আরও গভীরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিল। সে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মাতাল। “আমি একটু ঘুরে আসি। কে জানে, হয়তো গুপ্তধনের কোনো সূত্র পেয়ে যাব। তোমরা এখানে অপেক্ষা করো। আমি বেশিক্ষণ লাগাব না।” আকাশ তাকে নিষেধ করল, “অন্ধকারে একা যেও না। এটা বিপজ্জনক হতে পারে। আমরা কাল সকালে একসাথে খুঁজব। এখন রাত অনেক হয়েছে।” কিন্তু রনি শোনার পাত্র নয়। সে হাসল। “আরে বাবা, আমি একা নই। আমার টর্চ আছে, আর সাহস আছে। আর তোমরা তো এখানেই আছো। কোনো বিপদ হলে চিৎকার করব।” সে দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল, তার টর্চের আলো অন্ধকারে মিশে গেল, আর তাদের মনে এক অজানা ভয় বাসা বাঁধল। রনি একা একা বাড়ির ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে একটি বিশাল লাইব্রেরি কক্ষ খুঁজে পেল। কক্ষটি ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা। শত শত পুরোনো বই তাকের উপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। বইগুলোর পাতা হলুদ হয়ে গেছে, আর তাদের বাঁধাইগুলো জীর্ণ, তাদের উপর ধুলোর পুরু আস্তরণ। বাতাসের সাথে মিশে আসছিল পুরোনো কাগজের গন্ধ, আর এক অদ্ভুত স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। রনি যখন একটি পুরোনো বই হাতে নিল, তখন তার নিচে একটি গুপ্ত পথ দেখতে পেল। পথটি একটি অন্ধকার বেসমেন্টের দিকে চলে গেছে। পথটি এতটাই সংকীর্ণ ছিল যে একজন মানুষ কষ্ট করে প্রবেশ করতে পারবে। রনি উত্তেজিত হয়ে বন্ধুদের ডাকল। “পেয়েছি! পেয়েছি! মনে হয় গুপ্তধনের পথ!” রনি চিৎকার করে বলল। তার গলায় এক বিজয়ীর সুর, যা পুরো বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আর তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল। আকাশ, সোহিনী এবং মিতু দ্রুত লাইব্রেরি কক্ষে ছুটে এল। তারা টর্চের আলোয় গুপ্ত পথটি দেখল। পথটি খুবই সংকীর্ণ এবং অন্ধকার। তার উপর ধুলো আর মাকড়সার জাল। পথটি যেন এক অজানা জগতের প্রবেশদ্বার, যা তাদের এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাবে। “সাবধানে!” মিতু বলল। তার মুখে এক গভীর উদ্বেগ। “এই ধরনের জায়গায় অনেক বিপদ থাকতে পারে। পুরোনো ফাঁদ বা ভেঙে পড়া অংশ। হয়তো কোনো বিষাক্ত গ্যাসও থাকতে পারে। আমরা জানি না ভেতরে কী আছে।” রনি অবশ্য আর অপেক্ষা পারল না। সে টর্চ জ্বেলে পথ ধরে নিচে নামতে শুরু করল। তার চোখে গুপ্তধনের ঝলমলে স্বপ্ন, সে যেন ইতিমধ্যেই ধন পেয়ে গেছে। আকাশ, সোহিনী এবং মিতু তার পিছু নিল। মিতু অবশ্য খুব সাবধানে পা ফেলছিল, তার মন অজানা আশঙ্কায় ভরা। তার মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটি পদক্ষেপে তারা এক নতুন বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর সেই বিপদ তাদের গ্রাস করতে প্রস্তুত। বেসমেন্টটি ছিল আরও অন্ধকার এবং স্যাঁতসেঁতে। বাতাসের আর্দ্রতা এতটাই বেশি ছিল যে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মাটির গন্ধ, পুরোনো পাথরের গন্ধ, আর এক অদ্ভুত পচা গন্ধের মিশ্রণ, যা তাদের নাকে এসে লাগছিল, আর তাদের গা গুলিয়ে উঠছিল। বেসমেন্টের এক কোণে তারা একটি জীর্ণ, চামড়ার বাঁধাই করা ডায়েরি খুঁজে পেল। ডায়েরিটি ধুলোর আস্তরণে ঢাকা ছিল, কিন্তু তার বাঁধাই দেখে মনে হচ্ছিল এটি একসময় খুব মূল্যবান ছিল, তার উপর খোদাই করা নকশাগুলো ছিল অত্যন্ত সুন্দর। ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা ছিল, “রণজিৎ রায়চৌধুরী, রায়চৌধুরী ভিলা, ১৮৯৭।” আকাশ ডায়েরিটি হাতে নিল। তার চোখে এক গভীর আগ্রহ। “এটা জমিদার বাড়ির শেষ বংশধর রণজিৎ রায়চৌধুরীর ডায়েরি! এটা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। হয়তো এই ডায়েরিতেই সব রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে, আর এই অভিশাপের পেছনের কারণও।” সে উত্তেজিত হয়ে বলল। তারা দ্রুত ডায়েরিটি নিয়ে তাদের কক্ষে ফিরে এল। টর্চের আলোয় তারা ডায়েরির পাতা উল্টাতে শুরু করল। ডায়েরির লেখাগুলো পুরোনো বাংলা হরফে লেখা, যা পড়তে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। লেখাগুলো অস্পষ্ট এবং মাঝে মাঝে কালি ছড়িয়ে গেছে, দেখে মনে হচ্ছিল যেন লেখক তাড়াহুড়ো করে লিখেছিলেন, বা তার হাত কাঁপছিল। ডায়েরির প্রথম দিকের পাতাগুলোতে জমিদার বাড়ির দৈনন্দিন জীবন, পারিবারিক ঘটনা এবং কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানের বর্ণনা ছিল। জমিদার পরিবারের সুখ, দুঃখ, উৎসব – সবকিছুরই বর্ণনা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল একসময় এই বাড়িটি ছিল জীবনের আনন্দে ভরপুর, কিন্তু সেই আনন্দ এখন শুধু স্মৃতি। কিন্তু যত তারা গভীরে যেতে লাগল, ততই ডায়েরির বিষয়বস্তু পাল্টাতে শুরু করল। অভিশপ্ত ধনের সন্ধান ও অভিশাপের গ্রাস – ডায়েরির পাতা থেকে: ডায়েরির এক জায়গায় লেখা ছিল, “আজ আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। পূর্বপুরুষদের লুকানো ধনসম্পদ আমি খুঁজে পেয়েছি। এই ধন আমাকে অসীম ক্ষমতা দেবে, কিন্তু এর সাথে এক ভয়ংকর অভিশাপও জড়িত। আমার বাবা আমাকে এই ধনের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু আমি তার কথা শুনিনি। আমার লোভ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি, এই ধন শুধু সোনা বা রত্ন নয়, এটি এক প্রাচীন শক্তি, যা মানুষের লোভকে বাড়িয়ে তোলে এবং তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। এই শক্তি এক প্রাচীন মন্দিরের গভীরে লুকানো ছিল, যা বহু বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল। আমি তাকে জাগিয়ে তুলেছি।” আকাশ ডায়েরির এই অংশটি পড়ে বন্ধুদের দিকে তাকাল। “তার মানে, জমিদার প্রমোদ রায়চৌধুরী, রণজিতের বাবা, এই অভিশপ্ত ধনের সন্ধান পেয়েছিলেন। ডায়েরিতে লেখা আছে, এটি কোনো সোনা বা রত্ন নয়, বরং এক প্রাচীন শক্তি। এর সাথে এক ভয়ংকর অভিশাপ জড়িত ছিল, যা তাদের তান্ত্রিক পূর্বপুরুষ মহেন্দ্র রায়চৌধুরী লুকিয়ে রেখেছিলেন। মহেন্দ্র রায়চৌধুরী ছিলেন জমিদার বংশের তৃতীয় পুরুষ, যিনি অসীম ক্ষমতা অর্জনের জন্য ‘প্রাণ-পাথর’ নামক এক অশুভ শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি এই পাথরকে জমিদার বাড়ির বেসমেন্টের গভীরে একটি গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখেছিলেন, যেখানে তিনি নিয়মিত নিষিদ্ধ আচারের মাধ্যমে এর শক্তিকে নিজের বশে আনার চেষ্টা করতেন। এই আচারগুলো ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর – মধ্যরাতে নরবলি, অশুভ মন্ত্র পাঠ, যা এই ‘প্রাণ-পাথর’-কে আরও বেশি অভিশপ্ত করে তুলেছিল। মহেন্দ্র রায়চৌধুরী এই পাথরের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জানতেন, কিন্তু তাঁর লোভ তাঁকে অন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, তিনি এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।” ডায়েরির পরবর্তী পাতাগুলোতে প্রমোদ রায়চৌধুরীর সেই অভিশপ্ত ধন স্পর্শ করার ভয়াবহ পরিণতি বর্ণিত ছিল। “অভিশাপের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। আমার পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। আমার ছোট বোন, রাধা, গত রাতে মারা গেল। তার চোখগুলো ছিল শূন্য, যেন সে কিছু ভয়ংকর দেখেছে। তার শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল, আর তার গায়ে অদ্ভুত কালো দাগ দেখা যাচ্ছিল, যা কোনো সাধারণ রোগ নয়, বরং এক অদৃশ্য অভিশাপের চিহ্ন। আমি কি ভুল করলাম এই ধন স্পর্শ করে? আমার ভাই, শঙ্কর, দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। তার গায়েও সেই কালো দাগ দেখা যাচ্ছে, আর সে রাতে চিৎকার করে ওঠে। আমার মা দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছেন, তিনি রাতে চিৎকার করে ওঠেন, ‘তারা আসছে! তারা আমাদের শেষ করে দেবে! অভিশাপ!'” সোহিনী ফিসফিস করে বলল, “এই কালো দাগগুলোই অভিশাপের চিহ্ন ছিল। আত্মারা তাদের শরীরকে গ্রাস করছিল।” আকাশ ডায়েরির শেষ পাতায় পৌঁছাল। “শেষের দিকের পাতাগুলো অস্পষ্ট এবং এলোমেলো ছিল। কিছু জায়গায় রক্তের দাগও দেখা যাচ্ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল রণজিৎ রায়চৌধুরী প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তার হাত কাঁপছিল। শেষ পাতায় শুধু একটি অস্পষ্ট লাইন লেখা ছিল, ‘তারা আসছে… তারা আমাকে শেষ করে দেবে… অভিশাপ… এই ধন… ধ্বংস… মুক্তি… মুক্তি দাও… আমাদের মুক্তি দাও… এই যন্ত্রণার শেষ নেই…'” ডায়েরিটি পড়ে তাদের সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। রনি অবশ্য তখনও গুপ্তধনের চিন্তায় মগ্ন। “তার মানে গুপ্তধন আছে! আর এই অভিশাপের কথা হয়তো শুধু ভয় দেখানোর জন্য লেখা হয়েছে। হয়তো জমিদার নিজেই পাগল হয়ে গিয়েছিল, বা কোনো মানসিক রোগে ভুগছিল। আমাদের তো কিছু হচ্ছে না! এসব শুধু ভয় দেখানোর জন্য, যাতে আমরা গুপ্তধন না পাই.” সে হাসল, কিন্তু তার হাসিটা ছিল কিছুটা জোর করা, যেন সে নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করছিল। সোহিনী বলল, “না রনি, আমি অনুভব করতে পারছি। এই বাড়িতে সত্যিই কিছু অশুভ শক্তি আছে। আর ডায়েরির লেখাগুলো মিথ্যা নয়। এই অভিশাপটা বাস্তব। আমি তাদের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছি, তাদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি।” তার গলাটা ছিল দৃঢ়, তার চোখে এক গভীর উপলব্ধি। আকাশ বলল, “আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। এই ডায়েরি হয়তো আমাদের অনেক কিছু বলে দেবে। জমিদার পরিবারের অগ্নিকাণ্ডের পেছনে হয়তো এই অভিশাপই দায়ী। আমাদের এই ধনের প্রকৃত প্রকৃতি বুঝতে হবে, তার ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে হবে।” তারা ডায়েরিটি সাবধানে রাখল। বাইরে তখন গভীর রাত। চাঁদের আলো ভাঙা জানালা দিয়ে সামান্যই প্রবেশ করছিল, যা কক্ষের ভেতরে এক অদ্ভুত আলো-ছায়ার খেলা তৈরি করছিল। বাতাসের ফিসফিসানি এখন আরও স্পষ্ট। মনে হচ্ছিল যেন কেউ তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে। মিতু ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে বসেছিল, তার চোখ বন্ধ। সে তার হাত দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল, যেন নিজেকে কোনো অদৃশ্য বিপদ থেকে রক্ষা করতে চাইছে। রনি অবশ্য টর্চ হাতে নিয়ে চারপাশে আলো ফেলছিল, তার চোখে গুপ্তধনের নেশা। আকাশ ডায়েরির কথাগুলো নিয়ে ভাবছিল, তার মনে এক নতুন রহস্যের জাল বুনছিল। তাদের প্রথম রাত ছিল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার শুরু, যা তাদের জীবনের গতিপথ বদলে দেবে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion