Episode 5730 words0 views

রায়চৌধুরী ভিলার অভিশাপ : পঞ্চম পর্ব

এক নতুন উপলব্ধি রায়চৌধুরী ভিলা ধসে পড়ার শব্দে যখন তারা দিশাহারা, তখন রণজিৎ রায়চৌধুরীর আত্মা এবং অন্যান্য পূর্বপুরুষের ছায়ামূর্তি তাদের পথ দেখিয়ে বাড়ির পেছনের সেই গোপন সুড়ঙ্গের দিকে নিয়ে যায়। আত্মাগুলো যেন তাদের চারপাশে এক অদৃশ্য সুরক্ষা বলয় তৈরি করেছিল, যাতে ধসে পড়া অংশের কোনো পাথর তাদের গায়ে না পড়ে। আকাশ দ্রুত জ্ঞান হারানো রনিকে কাঁধে তুলে নিল। রনির শরীর ছিল ভারী, আর তার মাথায় আঘাত লেগেছিল, তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। মিতু এবং সোহিনী তার পিছু নিল, তাদের হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল, আর তাদের মনে ছিল এক তীব্র আতঙ্ক, কিন্তু তারা জানত তাদের পালাতে হবে। তারা দ্রুত সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল। সুড়ঙ্গটি ছিল সংকীর্ণ এবং অন্ধকার। বাতাসের ভারীতা, মাটির গন্ধ, পুরোনো পাথরের গন্ধ, আর এক অদ্ভুত পচা গন্ধের মিশ্রণ তাদের শ্বাসরোধ করে দিচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের মনে হচ্ছিল যেন পুরো বাড়িটি তাদের উপর ভেঙে পড়বে। ধুলো আর পাথরের গুড়ো তাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট দিচ্ছিল। তাদের পায়ের নিচে পুরোনো কাঠ আর পাথরের টুকরো ভেঙে যাচ্ছিল, যা এক অদ্ভুত শব্দ তৈরি করছিল, আর সেই শব্দে তাদের মনে এক অজানা ভয় কাজ করছিল। সোহিনী তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে পথ চিনতে সাহায্য করছিল। সে অনুভব করছিল আত্মারা তাদের সাথে আছে, তাদের পথ দেখাচ্ছে, যেন তাদের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আর তাদের কানের কাছে ফিসফিস করে পথ দেখাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সুড়ঙ্গের ছাদ থেকে ছোট ছোট পাথর খসে পড়ছিল, যা তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল, আর তাদের মনে এক তীব্র আতঙ্ক তৈরি করছিল। রনির অজ্ঞান শরীর আকাশের কাঁধে যেন আরও ভারী হয়ে উঠছিল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ কঠিন করে তুলছিল। মিতু ভয়ে কাঁপছিল, তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু সে জানত তাদের পালাতে হবে। অবশেষে, তারা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে পৌঁছাল। একটি ছোট, জং ধরা লোহার গেট তাদের পথ আটকে রেখেছিল। গেটটির উপর পুরোনো লতাপাতা জড়িয়ে ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি বহু বছর ধরে খোলা হয়নি। আকাশ তার সর্বশক্তি দিয়ে গেটটি ঠেলে খুলে দিল। গেটটি এক বিকট ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল, আর তারা বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরের তাজা বাতাস তাদের মুখে এসে লাগল, যা তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিল। তারা হাঁপাচ্ছিল, তাদের শরীর কাঁপছিল, আর তাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তারা বেরিয়ে আসার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই, রায়চৌধুরী ভিলা সম্পূর্ণরূপে ধসে পড়ে। এক বিকট শব্দে পুরো বাড়িটি ধুলোর এক বিশাল স্তূপ তৈরি করে। বাতাস ধুলোয় ভরে গেল, আর তারা কাশি শুরু করল। সেই শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে তাদের কান ঝনঝন করে উঠল, আর তাদের মনে এক গভীর আতঙ্ক তৈরি হলো। তারা যেন নিজেদের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না – এক বিশাল, ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি চোখের পলকে শুধু ধুলো আর পাথরের স্তূপে পরিণত হলো। তারা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের চোখ থেকে ভয় আর বিস্ময় ঝরে পড়ছিল। তারা বেঁচে গেছে! তাদের চোখে ছিল এক গভীর স্বস্তি, যেন তারা এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে, আর তাদের জীবনে এক নতুন সকাল এসেছে। তাদের শরীর কাঁপছিল, তাদের নিঃশ্বাস দ্রুত চলছিল, আর তাদের হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল। আকাশ রনিকে সাবধানে মাটিতে নামাল। রনি ধীরে ধীরে চোখ খুলল। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সে এখনও ঘোরগ্রস্ত। তার মাথায় আঘাত লেগেছিল, কিন্তু সে বেঁচে গিয়েছিল। মিতু ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু তার মুখে এক স্বস্তির ছাপ ছিল। সোহিনী আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসল। “আমরা বেঁচে গেছি,” সে ফিসফিস করে বলল। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন সে এক নতুন সত্য আবিষ্কার করেছে, আর তার মনে এক গভীর শান্তি ছিল। ঠিক তখনই, তাদের সামনে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। জমিদার রণজিৎ রায়চৌধুরীর আত্মা এবং অন্যান্য পূর্বপুরুষের ছায়ামূর্তিগুলো, যারা তাদের পথ দেখিয়েছিল, তারা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে শুরু করল। তাদের শরীর থেকে এক ধরনের নীল আভা বেরোচ্ছিল, যা রাতের অন্ধকারকে আলোকিত করছিল। তাদের মুখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন তারা দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল, আর তারপর ধীরে ধীরে আকাশের দিকে ভেসে গেল। তারা যেন তারাদের সাথে মিশে যাচ্ছিল, আর তাদের অস্তিত্ব বাতাসে বিলীন হয়ে গেল। তাদের চলে যাওয়াতে বাতাস যেন আরও হালকা হয়ে গেল, আর তাদের মনে এক গভীর শান্তি নেমে এল। তারা জমিদার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে ছিল। একসময় যে বাড়িটি ছিল তাদের অ্যাডভেঞ্চারের কেন্দ্রবিন্দু, সেটি এখন শুধু ধুলো আর পাথরের স্তূপ। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা তাদের জীবনে এক নতুন উপলব্ধি এনে দেয়। তারা বুঝতে পারল, লোভ মানুষকে কীভাবে অন্ধ করে দেয় এবং কীভাবে তা ধ্বংস ডেকে আনে। তারা জমিদার পরিবারের ট্র্যাজেডি এবং আত্মাদের নিঃস্বার্থ ত্যাগের মহত্ত্ব নিয়ে চিন্তা করে। আত্মারা তাদের রক্ষা করতে এসেছিল, তাদের লোভের পরিণতি থেকে বাঁচাতে এসেছিল। এই উপলব্ধি তাদের জীবনকে চিরতরে বদলে দিল। পরের দিন সকালে, তারা জিপে করে শহরের দিকে রওনা দিল। তাদের মন তখনো জমিদার বাড়ির রহস্য আর অভিশাপের চিন্তায় আচ্ছন্ন। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion