Episode 41856 words0 views

রায়চৌধুরী ভিলার অভিশাপ : চতুর্থ পর্ব

অভিশাপের উন্মোচন ডায়েরির শেষ দিকের পাতাগুলোতে রণজিৎ রায়চৌধুরী একটি ধাঁধার মতো করে গুপ্তধনের আসল অবস্থান বর্ণনা করেছিলেন। ধাঁধাটি ছিল পুরোনো বাংলা ছন্দে লেখা, যার অর্থ উদ্ধার করা সহজ ছিল না। ছন্দটি ছিল এরকম: “পশ্চিমের আলো যখন পূর্বের ছায়া ছুঁয়ে যায়, প্রধান স্তম্ভের উপর যখন চাঁদের কিরণ পড়ে, বেসমেন্টের গভীরে, যেখানে সময় ঘুমিয়ে থাকে, সেখানে লুকানো আছে সেই ধন, যা ধ্বংস ডেকে আনে। তিনটি ধাপের পর, যেখানে আগুন জ্বলেছিল, সেখানেই মুক্তি, সেখানেই অভিশাপের শেষ।” আকাশ এবং সোহিনী মিলে সেই ধাঁধার অর্থ বের করার চেষ্টা করছিল। আকাশ তার ঐতিহাসিক জ্ঞান ব্যবহার করছিল, পুরোনো মানচিত্র এবং স্থাপত্যের জ্ঞান দিয়ে ধাঁধার প্রতিটি লাইন বিশ্লেষণ করছিল। সে জমিদার বাড়ির প্রতিটি স্তম্ভের অবস্থান এবং তাদের উপর চাঁদের আলোর প্রভাব পরীক্ষা করছিল। সোহিনী তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে অশরীরী বার্তাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিল, যা তাকে ধাঁধার অস্পষ্ট অংশগুলো বুঝতে সাহায্য করছিল। সে অনুভব করছিল, এই ধাঁধাটি শুধু একটি সূত্র নয়, এটি আত্মাদের শেষ বার্তা। রনি অবশ্য অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। সে মনে করছিল, এসব ধাঁধা-টাঁধা সব সময় নষ্ট করার জন্য। “আরে বাবা, এত প্যাঁচানোর কী দরকার? চলো, সব ভেঙেচুরে দেখি, কোথায় কী আছে! সময় নষ্ট হচ্ছে, আর আমরা বিপদ বাড়াচ্ছি।” সে প্রায়শই এমন কথা বলত, যা মিতুকে আরও আতঙ্কিত করত। ধাঁধার অর্থ উদ্ধার করতে করতে তারা বুঝতে পারল, গুপ্তধনের আসল অবস্থান বাড়ির বেসমেন্টের নিচে একটি গোপন কুঠুরিতে। কুঠুরিটি একটি বিশাল পাথর দিয়ে ঢাকা, যা সরাতে অনেক শক্তি লাগবে। “তিনটি ধাপের পর, যেখানে আগুন জ্বলেছিল” – এই লাইনটি তাদের বিভ্রান্ত করছিল। তারা বাড়ির পুরোনো মানচিত্র পরীক্ষা করে দেখল, বেসমেন্টের নিচে একটি পুরোনো চুল্লিঘর ছিল, যেখানে একসময় আগুন জ্বালানো হতো। সেই চুল্লিঘরের কাছেই ছিল তিনটি ধাপ। এই চুল্লিঘরটিই ছিল সেই জায়গা যেখানে জমিদার পরিবারের অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল বলে জনশ্রুতি ছিল, আর সেই অগ্নিকাণ্ডই ছিল অভিশাপের চূড়ান্ত পরিণতি। পরের দিন সন্ধ্যায়, তারা সবাই বেসমেন্টের দিকে রওনা দিল। বেসমেন্টটি আগের চেয়েও বেশি অন্ধকার এবং স্যাঁতসেঁতে মনে হচ্ছিল। বাতাসের আর্দ্রতা এতটাই বেশি ছিল যে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, যেন বাতাস ভারী হয়ে গেছে। মাটির গন্ধ, পুরোনো পাথরের গন্ধ, আর এক অদ্ভুত পচা গন্ধের মিশ্রণ, যা তাদের নাকে এসে লাগছিল, আর তাদের গা গুলিয়ে উঠছিল। তাদের টর্চের আলোয় তারা কুঠুরির প্রবেশপথটি খুঁজে পেল। এটি ছিল চুল্লিঘরের ঠিক পাশেই। একটি বিশাল, খোদাই করা পাথর সেই পথটিকে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে রেখেছিল। পাথরটির উপর পুরোনো শ্যাওলা জমে ছিল, আর তার গায়ে অদ্ভুত কিছু প্রতীক খোদাই করা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোনো প্রাচীন মন্ত্রের অংশ, বা কোনো সতর্কবাণী, যা তাদের প্রবেশ করতে নিষেধ করছিল। তারা যখন কুঠুরি খোলার চেষ্টা করছিল, তখন অশরীরী কার্যকলাপ চরমে উঠল। প্রথমে মৃদু কম্পন শুরু হলো, তারপর পুরো বাড়িটিই কাঁপতে শুরু করল, যেন এক বিশাল ভূমিকম্প হচ্ছে, আর তার শব্দে পুরো বেসমেন্ট কেঁপে উঠছিল। তীব্র ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল, যা তাদের শরীরকে বরফের মতো ঠান্ডা করে দিচ্ছিল, তাদের হাড় পর্যন্ত কাঁপছিল, আর তাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কক্ষের কাঁচের জিনিসপত্র বিকট শব্দে ভেঙে পড়তে লাগল, আসবাবপত্রগুলো যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি দ্বারা ছিটকে পড়ছিল, আর তাদের চারপাশে এক ধ্বংসলীলা চলছিল। কক্ষের আলো হঠাৎ করেই নিভে গেল, আর তারা সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে গেল। তাদের টর্চগুলোও কাজ করছিল না, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। মনে হচ্ছিল যেন পুরো বাড়িটিই জীবন্ত হয়ে উঠেছে, তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছে, তাদের লোভের জন্য শাস্তি দিতে চাইছে। দেয়ালগুলো থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছিল, ছাদ থেকে ধুলো আর মাটি ঝরে পড়ছিল। এক মুহূর্তে যেন তারা এক ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে আটকা পড়েছিল। বাতাসের সাথে মিশে আসছিল পোড়া কাঠ আর মানুষের আর্তনাদের অস্পষ্ট শব্দ, যা ডায়েরিতে বর্ণিত অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছিল, আর তাদের মনে এক গভীর আতঙ্ক তৈরি করছিল। হঠাৎ, তাদের সামনে একটি স্পষ্ট ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল। সেটি জমিদার রণজিৎ রায়চৌধুরীর আত্মা! আত্মাটি আগের চেয়েও বেশি স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল ছিল। তার চোখ থেকে এক অদ্ভুত আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল সে তাদের কিছু বলতে চাইছে, তার মুখে এক গভীর যন্ত্রণা আর সতর্কতা। আত্মাটি তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার মুখে এক গভীর যন্ত্রণা আর সতর্কতা। তার শরীর থেকে এক ধরনের নীল আভা বেরোচ্ছিল, যা অন্ধকার বেসমেন্টকে আলোকিত করছিল, আর তার চারপাশে এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করা যাচ্ছিল, যা তাদের শরীরকে কাঁপিয়ে তুলছিল। তারা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মিতু ভয়ে চিৎকার করে উঠল, তার গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না, শুধু এক তীব্র আর্তনাদ, যা বাতাসে মিশে যাচ্ছিল। রনি, অবশ্য লোভের বশে আত্মাকে উপেক্ষা করে কুঠুরির পাথর ভাঙতে যায়। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে পাথরটি ঠেলার চেষ্টা করে। তার চোখে তখন শুধু গুপ্তধনের ঝলক, সে যেন আত্মাকেও পাত্তা দিচ্ছিল না, তার মনে তখন শুধু ধন। ঠিক তখনই, ছায়ামূর্তিটি এক অদৃশ্য শক্তি দিয়ে রনিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। রনি ছিটকে পড়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারায়। তার মাথায় আঘাত লেগেছিল, আর তার শরীর থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল, যা অন্ধকার মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছিল। আকাশ দ্রুত রনির দিকে ছুটে গেল। সোহিনী আত্মার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে অনুভব করল, আত্মাটি তাদের ক্ষতি করতে চায় না, বরং তাদের রক্ষা করতে চাইছে। আত্মাটি এরপর কুঠুরির দেয়াল থেকে একটি পুরোনো শিলালিপি উন্মোচন করে। শিলালিপিটি পাথরের উপর খোদাই করা ছিল, আর তার উপর থেকে ধুলো সরে যেতেই সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। শিলালিপিতে প্রাচীন বাংলায় লেখা ছিল: “এই ধন অভিশপ্ত। যে এর অপব্যবহার করবে, সে ধ্বংস হবে। আমরা তোমাদের রক্ষা করতে এসেছি, ভয় পেও না। লোভের আগুনে আমরা পুড়েছি, তোমরা যেন সেই ভুল না করো। এই ধন শুধু ধ্বংসই নিয়ে আসে। এটি কোনো সোনা বা রত্ন নয়, এটি একটি প্রাচীন শক্তি, যা মানুষের লোভকে বাড়িয়ে তোলে এবং তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। এই শক্তি এক প্রাচীন মন্দিরের গভীরে লুকানো ছিল, যা বহু বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল। আমরা এই শক্তিকে আটকে রেখেছিলাম, কিন্তু তোমরা তাকে মুক্ত করতে চাইছো। ফিরে যাও! ফিরে যাও! এই অভিশাপের শেষ নেই, শুধু ধ্বংস আছে। আমাদের মুক্তি দাও, এই ধনকে চিরতরে আটকে রাখো।” তারা স্তম্ভিত হয়ে যায়। তাদের মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। জমিদার পরিবার অগ্নিকাণ্ডে মারা যায়নি, বরং তারা এই গুপ্তধনের অভিশাপের শিকার হয়েছিল। এই ধন কোনো সোনা বা রত্ন ছিল না, এটি ছিল এক প্রাচীন শক্তি, যা মানুষের লোভকে বাড়িয়ে তোলে এবং তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। আত্মারা তাদের রক্ষা করতে চাইছে, যাতে তারা একই ভুল না করে। তারা বুঝতে পারল, জমিদার রণজিৎ রায়চৌধুরী ডায়েরিতে যে অভিশাপের কথা লিখেছিলেন, তা সম্পূর্ণ সত্য, আর তারা সেই অভিশাপের মুখোমুখি হয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ রাত: ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে আকাশ একটি নির্দিষ্ট অংশে এসে থমকে গেল। রণজিৎ রায়চৌধুরীর হাতের লেখা সেখানে আরও বেশি এলোমেলো এবং আতঙ্কগ্রস্ত মনে হচ্ছিল, যেন তিনি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই অংশে জমিদার বাড়ির শেষ রাতের ভয়াবহ বর্ণনা ছিল: “সেই অভিশপ্ত রাত… ১৮৯৭ সালের কার্তিক মাসের অমাবস্যা। আকাশে চাঁদ ছিল না, শুধু ঘন কালো মেঘ আর এক তীব্র দমকা বাতাস। আমার বাবা, প্রমোদ রায়চৌধুরী, ‘প্রাণ-পাথর’-এর শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে নিজের বশে আনার জন্য শেষবারের মতো এক ভয়ংকর তান্ত্রিক আচারের আয়োজন করেছিলেন। পরিবারের সবাই তখনো জানত না, এই আচারের পরিণতি কী হতে চলেছে। শুধু আমার ছোট বোন, রাধা, যে ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল, সে বারবার বলছিল, ‘দাদা, আমার কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে, বাড়িটা কাঁদছে। একটা অশুভ শক্তি আমাদের গ্রাস করতে আসছে।’ তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু আমরা তার কথা শুনিনি। আচার শুরু হওয়ার আগে থেকেই বাড়িতে এক অদ্ভুত অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। পরিবারের সদস্যরা, যারা ‘প্রাণ-পাথর’-এর ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তারা একে অপরের সাথে ঝগড়া শুরু করেছিল। কে এই ধনের মালিক হবে, কে এই ক্ষমতা ভোগ করবে – এই নিয়ে তাদের মধ্যে এক তীব্র বিবাদ চলছিল। আমার কাকা, শশধর, বাবার সাথে তর্ক করছিল, ‘এই ধন আমারও প্রাপ্য! তুমি একা এর ক্ষমতা ভোগ করতে পারবে না!’ তাদের কণ্ঠস্বর ক্রমশ বাড়ছিল, আর তাদের চোখে এক ধরনের উন্মাদনা দেখা যাচ্ছিল। মা, যিনি দিন দিন মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছিলেন, তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘থামো! থামো তোমরা! অভিশাপ! এই ধন আমাদের শেষ করে দেবে!’ কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। মধ্যরাতে, বাবা বেসমেন্টের চুল্লিঘরে সেই ‘প্রাণ-পাথর’ নিয়ে প্রবেশ করলেন। তিনি নিষিদ্ধ মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করলেন, আর তার চারপাশে এক অদ্ভুত নীল আভা তৈরি হলো। পাথরটি থেকে এক তীব্র আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিল, আর তার সাথে এক বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছিল, যা পুরো বাড়িটিকে কাঁপিয়ে তুলছিল। হঠাৎ করেই, চুল্লিঘরের আগুন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল। আগুনের শিখাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, আর তাদের চারপাশে এক ভয়ংকর নৃত্য শুরু করল। বাতাস যেন বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল, আর তার সাথে মিশে আসছিল পোড়া মাংসের গন্ধ। ঠিক তখনই, ‘প্রাণ-পাথর’-এর অভিশপ্ত শক্তি জমিদার পরিবারের সদস্যদের শরীরকে গ্রাস করতে শুরু করল। প্রথমে তাদের ত্বকে অদ্ভুত কালো দাগ দেখা গেল, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। তাদের চোখগুলো শূন্য হয়ে যাচ্ছিল, যেন তাদের প্রাণশক্তি শুষে নেওয়া হচ্ছে। তাদের শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল, আর তাদের গায়ে এক তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো, যা অসহ্য ছিল। আমার মা চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে! তারা আমাকে গ্রাস করছে! অভিশাপ!’ তার কণ্ঠস্বর ছিল যন্ত্রণায় ভরা, যা শুনে আমার হাড়হিম হয়ে গিয়েছিল। আমার ছোট বোন রাধা, যে ছিল চুল্লিঘরের বাইরে, সেও অভিশাপের শিকার হলো। তার শরীর নীল হয়ে গেল, আর তার চোখ থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করল। সে চিৎকার করে উঠল, ‘আগুন! আগুন! তারা আসছে! তারা আমাকে শেষ করে দেবে!’ তার আর্তনাদ শুনে আমার হৃদপিণ্ড ফেটে যাচ্ছিল। আমার ভাই, শঙ্কর, যে ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী, সেও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তার গায়েও সেই কালো দাগ দেখা যাচ্ছিল, আর সে রাতে চিৎকার করে উঠত, ‘আমাকে মুক্তি দাও! এই যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না!’ তার শরীর থেকে এক অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছিল, যা ছিল পচে যাওয়া মাংসের গন্ধের মতো। আমি দেখলাম, অদৃশ্য ছায়ামূর্তিগুলো তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের শরীরকে গ্রাস করছে। তারা যেন জমিদার পরিবারের সদস্যদের আত্মাকে শুষে নিচ্ছিল, আর তাদের শরীরকে এক জীবন্ত নরকে পরিণত করছিল। আগুনের শিখাগুলো ক্রমশ বাড়ছিল, আর পুরো বাড়িটি আগুনে ছেয়ে যাচ্ছিল। আমি চেষ্টা করলাম তাদের বাঁচাতে, কিন্তু আমি পারলাম না। আমার হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল, আমার শরীর কাঁপছিল। আমি শুধু তাদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘আগুন! আগুন! মুক্তি! মুক্তি দাও!’ তাদের কণ্ঠস্বর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিল, আর তাদের শরীরগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। আমি কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে বাড়ির পেছনের গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি এখানে থাকি, তাহলে আমিও অভিশাপের শিকার হব। আমি পালিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু সেই রাতের ভয়াবহ স্মৃতি আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়। আমি জানি, এই অভিশাপের শেষ নেই, শুধু ধ্বংস আছে। এই ‘প্রাণ-পাথর’ই আমাদের পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে। আমি ডায়েরিতে এই সব লিখে রাখছি, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ভুল না করে। এই ধনকে চিরতরে আটকে রাখো, তাকে মুক্ত করো না, তাহলে তোমরাও ধ্বংস হবে।” ডায়েরির এই অংশটি পড়ে আকাশ, সোহিনী, রনি এবং মিতু স্তম্ভিত হয়ে যায়। তাদের মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। জমিদার পরিবার অগ্নিকাণ্ডে মারা যায়নি, বরং তারা এই গুপ্তধনের অভিশাপের শিকার হয়েছিল। এই ধন কোনো সোনা বা রত্ন ছিল না, এটি ছিল এক প্রাচীন শক্তি, যা মানুষের লোভকে বাড়িয়ে তোলে এবং তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। আত্মারা তাদের রক্ষা করতে চাইছে, যাতে তারা একই ভুল না করে। তারা বুঝতে পারল, জমিদার রণজিৎ রায়চৌধুরী ডায়েরিতে যে অভিশাপের কথা লিখেছিলেন, তা সম্পূর্ণ সত্য, আর তারা সেই অভিশাপের মুখোমুখি হয়েছিল। ঠিক তখনই, বাড়ির একটি পুরোনো অংশ বিকট শব্দে ধসে পড়তে শুরু করে। ছাদ ভেঙে পড়ছিল, দেয়ালগুলো ফাটছিল, আর তাদের চারপাশে ধুলো আর পাথরের বৃষ্টি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন পুরো বাড়িটিই তাদের উপর ভেঙে পড়বে। হয়তো গুপ্তধনের অভিশাপের কারণে, অথবা সময়ের সাথে সাথে বাড়ির জীর্ণ দশা আর অশরীরী শক্তির প্রভাবে বাড়িটি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। ধুলো আর পাথরের গুড়ো বাতাসে উড়ছিল, আর তাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তাদের চারপাশে এক ভয়ংকর ধ্বংসলীলা চলছিল, যা তাদের অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। আকাশ দ্রুত মিতুকে নিয়ে রণজিৎ রায়চৌধুরীর আত্মার দিকে তাকাল। আত্মাটি তাদের পথ দেখিয়ে বাড়ির পেছনের একটি গোপন সুড়ঙ্গের দিকে ইশারা করল। সুড়ঙ্গটি আগে তাদের চোখে পড়েনি। এটি সম্ভবত জমিদার পরিবারের জন্য একটি গোপন পালানোর পথ ছিল, যা তারা বিপদের সময় ব্যবহার করত। আত্মাটি যেন তাদের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল, তার চোখে ছিল এক গভীর আকুতি, যেন সে তাদের কাছে শেষবারের মতো সাহায্য চাইছে, আর তাদের মুক্তি দিতে চাইছে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion