Episode 1784 words2 views

প্রথম পর্ব : অভিশপ্ত প্রেম ও প্রতিহিংসা

কলকাতার উপকণ্ঠে, এক নির্জন গলির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরনো, ভাঙা বাড়ি। বাড়িটা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে, কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় ভূতের গল্প। স্থানীয়রা বাড়িটাকে ‘ভুতুড়ে বাড়ি’ নামেই চেনে। দিনের বেলায়ও কেউ সেদিকে পা বাড়াতে সাহস করে না, আর রাতের কথা তো বলাই বাহুল্য। বাড়িটার চারপাশে ঘন ঝোপঝাড় আর উঁচু গাছপালা, যা দিনের আলোতেও এক অদ্ভুত অন্ধকার আর রহস্যময়তা বজায় রাখে। বাতাসের সামান্যতম শব্দেও শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি যেন এক অশরীরী উপস্থিতির জানান দেয়। বাড়ির ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে যেন এক অতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, আর তার স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালগুলো যেন শত বছরের পুরনো অভিশাপের সাক্ষী। বাড়ির প্রতিটি ইঁট, প্রতিটি কাঠের টুকরো যেন এক চাপা আর্তনাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা শুধু রাতের গভীরেই শোনা যায়। বাড়ির ইতিহাস খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় প্রায় একশ বছর আগে, যখন এই বাড়িটি ছিল এক ধনী জমিদার পরিবারের। জমিদার হেমন্ত মুখার্জি, তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী এবং তাঁদের একমাত্র পুত্র, তরুণ অনির্বাণ। জমিদার হেমন্ত মুখার্জি ছিলেন অত্যন্ত প্রতাপশালী এবং কঠোর প্রকৃতির মানুষ। তাঁর আদেশই ছিল শেষ কথা, তাঁর মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো ছিল না, তাঁর চোখের ইশারায় গ্রাম কাঁপত। তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণা, কিন্তু স্বামীর ভয়ে তিনি কোনো প্রতিবাদ করতে পারতেন না, তাঁর জীবন ছিল এক নীরব কারাবাস, যেখানে তিনি শুধু স্বামীর ইচ্ছার দাসী ছিলেন। তাঁদের একমাত্র পুত্র অনির্বাণ ছিল শান্ত স্বভাবের, পড়াশোনায় মনোযোগী এবং সংবেদনশীল। তার চোখে ছিল স্বপ্ন, আর মনে ছিল ভালোবাসা। কিন্তু তার জীবনে নেমে আসে এক ঘোর অন্ধকার, এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি, যা এই বাড়ির প্রতিটি ইঁট আর পাথরে আজও মিশে আছে, এক শীতল স্পর্শের মতো, যা আজও এই বাড়ির বাতাসে এক চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে রেখেছে। অনির্বাণ ভালোবেসেছিল গ্রামের এক সাধারণ মেয়ে, রাধাকে। রাধা ছিল রূপে গুণে অনন্যা, তার সরল হাসি আর মায়াবী চোখ যে কাউকেই মুগ্ধ করত। তার চুলের বিনুনি থেকে যেন ফুলের গন্ধ আসত, আর তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক মিষ্টি সুর। কিন্তু তার সামাজিক অবস্থান ছিল নীচু, সে ছিল এক দরিদ্র কৃষকের কন্যা, যার কোনো বংশমর্যাদা ছিল না। জমিদার হেমন্ত মুখার্জি এই সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তাঁর কাছে বংশমর্যাদা আর সামাজিক প্রতিপত্তিই ছিল সব, ভালোবাসার কোনো স্থান ছিল না, তাঁর হৃদয়ে ছিল শুধু অহংকার আর ক্ষমতা। তিনি অনির্বাণকে জোর করে অন্য এক ধনী পরিবারের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইলেন, যাতে তাদের বংশের সম্মান বজায় থাকে, আর তাদের ক্ষমতা আরও বাড়ে। অনির্বাণ রাধাকে ছেড়ে থাকতে পারেনি, তার হৃদয় শুধু রাধার জন্যই কাঁদত, তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে ছিল রাধার নাম, তার স্বপ্ন ছিল রাধাকে নিয়ে। একদিন গভীর রাতে, যখন চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল, আর চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিল, অনির্বাণ রাধাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, স্বপ্ন দেখেছিল এক নতুন জীবনের, যেখানে তারা স্বাধীনভাবে বাঁচবে, ভালোবাসার এক নতুন জগৎ তৈরি করবে। কিন্তু তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, এক বীভৎস বাস্তবতার মুখোমুখি হয় তারা। জমিদার মশাইয়ের লোকেরা তাদের ধরে ফেলে, তাদের স্বপ্নকে পদদলিত করে। রাধাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাড়ির পেছনের পুকুরে, তার নিষ্পাপ রক্তে পুকুরের জল লাল হয়ে গিয়েছিল, আর সেই রক্ত যেন আজও পুকুরের গভীরে এক অভিশাপের মতো জমাট বেঁধে আছে, যা পুকুরের জলকে কালো করে রেখেছে। তার দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেন সে কোনোদিন ছিলই না, যেন তার অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয়েছিল। আর অনির্বাণকে আটকে রাখা হয় বাড়ির চিলেকোঠায়, যেখানে সূর্যের আলোও পৌঁছাত না, শুধু অন্ধকার আর মাকড়সার জাল ছিল তার সঙ্গী, আর তার কানে বাজত রাধার শেষ আর্তনাদ। অনির্বাণ চিলেকোঠায় দিনের পর দিন বন্দি ছিল। তার একমাত্র সঙ্গী ছিল রাধার স্মৃতি আর তার প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধের আগুন, যা তার শিরায় শিরায় জ্বলছিল, তার চোখ থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছিল। সে প্রতি মুহূর্তে রাধার করুণ মুখটা দেখতে পেত, তার কানে রাধার শেষ আর্তনাদ বাজত, যা তাকে পাগল করে তুলছিল, তার মস্তিষ্ক যেন বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর মানসিক যন্ত্রণায় সে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল, তার শরীর ভেঙে যাচ্ছিল, তার হাড়গুলো যেন বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু তার মনের আগুন নিভছিল না, বরং আরও তীব্র হচ্ছিল। কয়েকদিন পর, যখন তার সহ্যশক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল, যখন সে আর কোনো আশা দেখতে পাচ্ছিল না, যখন তার মনে হয়েছিল মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথ নেই, অনির্বাণ চিলেকোঠার একটি ভাঙা জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার দেহ বাড়ির পেছনের বাগানে পড়েছিল, আর তার আত্মা যেন সেই মুহূর্ত থেকেই এই বাড়িতে আটকে গিয়েছিল, এক অতৃপ্ত প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছিল। তার মৃত্যুর পর জমিদার পরিবারে শুরু হয় একের পর এক অঘটন। হেমন্ত মুখার্জি নিজেও এক রহস্যময় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তার মৃত্যুর কারণ কেউ জানতে পারেনি, শুধু তার শরীর কালো হয়ে গিয়েছিল, আর তার চোখগুলো যেন কোঠরগত হয়ে গিয়েছিল। আর সরস্বতী দেবী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, তিনি প্রায়ই রাধা আর অনির্বাণের নাম ধরে চিৎকার করতেন, তাদের ক্ষমা চাইতেন, আর নিজের চুল ছিঁড়তেন। ধীরে ধীরে বাড়িটা জনশূন্য হয়ে পড়ে, আর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে অনির্বাণ আর রাধার অতৃপ্ত আত্মার গল্প। বলা হতো, তাদের আত্মা এই বাড়িতেই ঘুরে বেড়ায়, তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার চায়, আর যারা এই বাড়িতে আসে, তাদের উপর তাদের অভিশাপ নেমে আসে, তাদের জীবনকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion