অনেক বছর পর, শহরের কোলাহল থেকে দূরে, নিরিবিলি পরিবেশে থাকার জন্য এক দম্পতি, অর্ক এবং মিতালী, এই বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্ক একজন লেখক, আর মিতালী একজন চিত্রশিল্পী। তারা সৃজনশীল কাজ করার জন্য শান্ত পরিবেশ খুঁজছিল, যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে তাদের মন শান্ত হবে এবং নতুন সৃষ্টির জন্ম দেবে। স্থানীয়রা তাদের অনেক বারণ করেছিল, বাড়ির ভূতুড়ে গল্প শুনিয়ে তাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিল, তাদের চোখে ছিল স্পষ্ট আতঙ্ক, তাদের কণ্ঠস্বরে ছিল এক চাপা সতর্কতা। কিন্তু তারা কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিল না, বরং এই পুরনো বাড়ির স্থাপত্য আর ইতিহাস তাদের মুগ্ধ করেছিল, তাদের মনে এক রোমাঞ্চ জাগিয়েছিল, যেন তারা এক নতুন অ্যাডভেঞ্চারে পা রাখছে। তাদের কাছে এই বাড়িটা ছিল এক নতুন অধ্যায় শুরুর ঠিকানা, এক নীরব ক্যানভাস যেখানে তারা তাদের স্বপ্ন আঁকবে, এক নতুন গল্প লিখবে।
প্রথম দিন থেকেই বাড়িটার মধ্যে একটা অদ্ভুত নীরবতা ছিল। সে নীরবতা যেন কোনো সাধারণ নীরবতা ছিল না, বরং এক গভীর রহস্য আর চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, যা তাদের বুকের উপর এক অদৃশ্য চাপ সৃষ্টি করত, তাদের নিঃশ্বাস যেন ভারী হয়ে যেত। পুরনো আসবাবপত্র, ধুলো জমা দেওয়াল, আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধ – সবকিছুই যেন এক অন্যরকম অনুভূতি দিত, যা তাদের মনে এক অজানা শিহরণ জাগাত। কখনো কখনো যেন পচা মাংসের মতো এক বীভৎস গন্ধ ভেসে আসত, যা তাদের বমি বমি ভাব এনে দিত, কিন্তু তার উৎস খুঁজে পাওয়া যেত না, যেন গন্ধটা বাতাসেই মিশে আছে। দিনের আলোতেও বাড়ির ভেতরের কিছু কোণ যেন অন্ধকারে ঢাকা থাকত, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছাত না, যেন সেই অন্ধকারেই কিছু লুকানো আছে, যা আলোর সামনে আসতে চায় না, যা শুধু রাতের অপেক্ষায় থাকে। মিতালী বাড়ির প্রতিটি কোণ খুঁটিয়ে দেখছিল, তার শিল্পী মন যেন এই পুরনো স্থাপত্যের প্রতিটি ভাঁজে এক লুকানো গল্প খুঁজে পাচ্ছিল, যা তার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার জন্য অপেক্ষা করছিল। অর্ক তার নতুন উপন্যাসের প্লট নিয়ে ভাবছিল, এই বাড়ির রহস্যময় পরিবেশ তার কল্পনাকে আরও উসকে দিচ্ছিল, তার মনে নতুন নতুন চরিত্র আর ঘটনা দানা বাঁধছিল, যা তার উপন্যাসের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছিল।
প্রথম কয়েকদিন সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। তারা বাড়ির বাগান পরিষ্কার করল, আগাছা মুক্ত করে কিছু নতুন ফুল গাছ লাগালো, যা বাড়ির পরিবেশে এক নতুন সজীবতা এনে দিল। ঘরগুলো নিজেদের রুচি অনুযায়ী সাজিয়ে তুলল, পুরনো আসবাবপত্রগুলো ঝেড়ে মুছে ব্যবহারযোগ্য করে তুলল, যেন বাড়িটাকে নতুন করে প্রাণ দিল। দিনের বেলায় বাড়িটা যেন তাদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে জেগে উঠেছিল, তাদের হাসি আর কথার শব্দে বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙেছিল, এক নতুন সুর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু রাতের বেলা শুরু হলো অদ্ভুত ঘটনা, যা তাদের শান্ত জীবনকে এক অচেনা ভয়ের দিকে ঠেলে দিল, তাদের প্রতিটি রাতকে এক দুঃস্বপ্নে পরিণত করল, তাদের ঘুম কেড়ে নিল।
প্রথম রাত থেকেই শুরু হয়েছিল সেই বিভীষিকা। মাঝরাতে হঠাৎ করে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, যেন কেউ বাইরে থেকে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে, এতটাই জোরে যে পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠত, কাঁচের জিনিসপত্র ঝনঝন করে উঠত, আর তাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত। অর্ক আর মিতালী দুজনেই চমকে জেগে উঠত, তাদের বুক ধড়ফড় করত, হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত, যেন তাদের হৃদপিণ্ড তাদের বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসবে। তারা সাহস করে দরজা খুলে দেখত বাইরে কেউ নেই, শুধু অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা, যা তাদের ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিত, তাদের মনে এক অজানা আতঙ্ক জাগাত। এরপর শুরু হলো চিলেকোঠার দিক থেকে ভেসে আসা কান্নার আওয়াজ। সে কান্না এতটাই করুণ আর হৃদয়বিদারক ছিল যে, মিতালী রাতে ঘুমাতে পারত না, তার চোখে ঘুম আসত না, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে যেত, যেন বরফের মতো শীতল হয়ে গিয়েছিল। সে প্রায়ই অর্কের হাত ধরে বলত, “অর্ক, আমার খুব ভয় করছে, মনে হচ্ছে কেউ কাঁদছে, ঠিক আমাদের পাশেই, তার নিঃশ্বাস আমি অনুভব করতে পারছি।” কখনো কখনো মনে হতো যেন কেউ তাদের নাম ধরে ফিসফিস করে ডাকছে, তাদের কানের কাছে এসে শ্বাস ফেলছে, সেই শ্বাস যেন বরফের মতো শীতল ছিল, যা তাদের শিরদাঁড়া দিয়ে এক হিমশীতল স্রোত বইয়ে দিত, আর তাদের লোম খাড়া হয়ে যেত। অর্ক প্রথমে ভেবেছিল, এটা তাদের মনের ভুল, হয়তো পুরনো বাড়ির কাঠামোর শব্দ বা বাতাসের খেলা। কিন্তু মিতালী ক্রমশ ভীত হয়ে পড়ছিল, তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তার চোখ কোঠরগত হয়ে গিয়েছিল, তার শরীরের ওজন কমে যাচ্ছিল। সে প্রায়ই বলত, “অর্ক, আমার মনে হয় এই বাড়িতে কেউ আছে… আমরা একা নই, আর তারা আমাদের চায় না, তারা আমাদের তাড়িয়ে দিতে চায়।” তার কণ্ঠস্বরে ছিল স্পষ্ট আতঙ্ক, যা অর্কের মনেও ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছিল, তার যুক্তিগুলো যেন ভেঙে পড়ছিল।
একদিন রাতে, মিতালী তার স্টুডিওতে ছবি আঁকছিল। ঘড়িতে তখন রাত দুটো, চারদিকে গভীর নিস্তব্ধতা, শুধু তার তুলির শব্দ আর তার নিজের নিঃশ্বাস। হঠাৎ করে তার তুলিটা হাত থেকে পড়ে গেল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি সেটাকে ছিটকে দিল, আর তার রংগুলো ক্যানভাসের উপর ছড়িয়ে পড়ল, এক বীভৎস আকার ধারণ করল। ক্যানভাসের উপর এক অদ্ভুত ছবি ফুটে উঠল – এক তরুণী, তার চোখ থেকে রক্ত ঝরছে, মুখে এক বীভৎস হাসি, যা দেখে গা শিউরে উঠত, মনে হতো যেন সেই হাসি জীবন্ত হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছে। মিতালী ভয়ে চিৎকার করে উঠল, তার গলা দিয়ে যেন স্বর বেরোচ্ছিল না, শুধু এক চাপা আর্তনাদ, যা বাতাসে মিশে গেল, আর পুরো বাড়িটা যেন সেই আর্তনাদে কেঁপে উঠল। অর্ক ছুটে এসে দেখল, মিতালী কাঁপছে, তার চোখ বিস্ফারিত, আর ক্যানভাসের উপর সেই বীভৎস ছবিটা। অর্ক তাকে সান্ত্বনা দিল, তাকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু তার মনেও একটা অজানা ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল। সে ক্যানভাসের দিকে তাকিয়েছিল, ছবিটা যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল, তার চোখের রক্ত যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, আর তার মনে হচ্ছিল যেন সেই রক্ত তার নিজের চোখ থেকেও ঝরছে, যা তাকে পাগল করে তুলছিল।
এরপর থেকে মিতালী আর স্টুডিওতে একা যেত না, দিনের বেলায়ও সে অর্কের সঙ্গ চাইত, তার ছায়া হয়ে থাকত। রাতের বেলা তারা দুজনেই জেগে থাকত, বাইরের শব্দ শোনার জন্য, তাদের ঘুম যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল, তাদের চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। তাদের পোষা কুকুরটা, রনি, মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘেউ ঘেউ করে উঠত, যেন অদৃশ্য কিছু দেখতে পাচ্ছে, তার চোখগুলো ভয়ে বড় বড় হয়ে যেত, আর তার শরীর কাঁপত। তার লোম খাড়া হয়ে যেত, আর সে ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে থাকত, ভয়ে কাঁপত, তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে যেত, যেন সে অদৃশ্য কোনো কিছুর সাথে লড়াই করছে। কখনো কখনো রনি এমনভাবে চিৎকার করত যেন তাকে কেউ আঘাত করছে, কিন্তু আশেপাশে কেউ থাকত না, শুধু বাতাসের মধ্যে এক চাপা হিংসার গন্ধ পাওয়া যেত। অর্ক আর মিতালী বুঝতে পারছিল, এই বাড়িতে শুধু তারা দুজন নেই, আরও কিছু আছে, যা তাদের চোখে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তাদের উপস্থিতি স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে, আর তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়, তারা তাদের ক্ষতি করতে চায়।
একদিন রাতে, অর্ক যখন তার উপন্যাসের কাজ করছিল, তখন হঠাৎ করে তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে এক অদ্ভূত লেখা ভেসে উঠল। লেখাগুলো ছিল পুরনো বাংলা হরফে, রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। তাতে লেখা ছিল: “তোমরাও মরবে… যেমন আমরা মরেছি… এই বাড়িতে শান্তি নেই… শুধু প্রতিশোধ…” অর্ক ভয়ে চমকে উঠল, তার শরীর হিম হয়ে গেল। সে মিতালীকে ডাকল, কিন্তু মিতালী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অর্ক ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল, কিন্তু সেই লেখাগুলো তার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সে বুঝতে পারছিল, এই বাড়িতে তারা নিরাপদ নয়।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion