ট্রেনের তীব্র হুইসেলের শব্দটা প্রথমে স্বপ্নের মধ্যে ছিল। তারপর সেটা বাস্তবের কর্কশ শব্দে পরিণত হলো।
চোখ খুলতেই মাথার ভেতরে একটা তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। যেন হাজারটা সূঁচ একসাথে ফোটানো হচ্ছে। অর্ক ধড়মড় করে উঠে বসল। সে একটা শক্ত বেঞ্চে শুয়ে ছিল। চারপাশের তীব্র কোলাহল, মানুষের চিৎকার, আর একটা অদ্ভুত পরিচিত গন্ধ—ডিজেল, বাসি চা আর ঘামের মিশ্রণ—তার নাকে এসে ধাক্কা দিল।
সে কোথায়?
চোখ রগড়ে সে তাকাল। বিশাল একটা ছাদ, লোহার প্রাচীন কড়ি-বরগা দিয়ে তৈরি। সামনে সারি সারি রেললাইন। মানুষ, লাল জামা পরা কুলি, হকার—সবাই যেন একটা অদ্ভুত তাড়াহুড়োর মধ্যে রয়েছে। একটা বড় ঘড়িতে দেখল সকাল ৮টা বেজে ১৫ মিনিট।
"হাওড়া... এটা হাওড়া স্টেশন।"
নামটা সে চিনতে পারল। কিন্তু সে এখানে কেন? সে এখানে কী করে এল?
অর্ক পকেটে হাত দিল। বুক পকেট খালি। প্যান্টের পকেটে একটা মানিব্যাগ। সে দ্রুত সেটা খুলল। ভেতরে শ'খানেক টাকা, কিন্তু কোনও পরিচয়পত্র নেই। কোনও কার্ড নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্স, আধার কার্ড, কিছুই না।
তার নাম কি?
বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে মরিয়া হয়ে মনে করার চেষ্টা করল। তার নাম... তার নাম... সে মনে করতে পারল না। তার বাড়ি কোথায়? সে কী করে? তার বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব?
কিছু না। কিচ্ছু মনে নেই।
তার মাথাটা ঘুরে উঠল। সে বেঞ্চটায় আবার বসে পড়ল। তার স্মৃতি সম্পূর্ণ ফাঁকা। একটা সাদা ক্যানভাস। সে কে, এই বোধটাই যেন তার ভেতর থেকে কেউ মুছে দিয়েছে।
সে আবার পকেট হাতড়াল। ডান পকেটে আঙুল ঠেকল শক্ত কিছুর সাথে। সে বের করে আনল। একটা ভারী চাবির গোছা। তাতে চার-পাঁচটা পুরনো ধরনের, পিতলের চাবি। আরেকটা পকেটে একটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরো।
সে কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা খুলল।
এটা একটা ছবি। খুব সম্ভবত মোবাইল থেকে প্রিন্ট করা। একটা অদ্ভুত প্রতীকের ছবি। একটা জ্যামিতিক নকশা, অনেকটা পুরনো দিনের কোনও সিলের মতো। একটা বৃত্তের মধ্যে একটা ফিনিক্স পাখির বিমূর্ত রূপ, যার ডানা দুটো একটা ত্রিভুজ তৈরি করেছে।
এই প্রতীকটার মানে কী? আর এই চাবিগুলো?
সে উঠে দাঁড়াল। মাথাটা টলছে। সে জানে না তার কোথায় যাওয়া উচিত। এই মুহূর্তে সে একটা ভিখারির থেকেও অসহায়। তার কোনও অতীত নেই।
সে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। প্রত্যেকেই তাকে অদ্ভুতভাবে দেখছে, নাকি এটা তার মনের ভুল? তার পোশাক-আশাক অবশ্য সাধারণ। একটা নীল শার্ট আর কালো প্যান্ট, কিন্তু শার্টটা সামান্য কোঁচকানো, যেন সে ওটা পরেই ঘুমিয়েছিল।
হঠাৎ তার কাঁধে একটা হাত পড়ল। সে চমকে ছিটকে উঠল।
"দাদা, একটু সরবেন?" একজন কুলি তার মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল।
অর্ক সরে দাঁড়াল। তার হৃৎপিণ্ড পাগলের মতো লাফাচ্ছে। সে বুঝতে পারল, সে ভয় পাচ্ছে। তীব্র ভয়।
সে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াল। হাওড়া ব্রিজের অস্পষ্ট অবয়বটা ভোরের কুয়াশা আর ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল না তার গন্তব্য কোনটা। এই বিশাল শহরটা তাকে গিলে খেতে আসছে।
তার শুধু দুটো সম্বল। একগোছা চাবি আর একটা অদ্ভুত প্রতীক।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion