Episode 2598 words1 views

অধ্যায় ২: প্রথম পদক্ষেপ

গঙ্গার ধারের একটা চায়ের দোকানে সে বসল। একটা চা আর দুটো বিস্কুট। চা'টা তার শরীরকে সামান্য উষ্ণতা দিল, কিন্তু মনের ভেতরের বরফ গলল না। সে চাবির গোছাটা টেবিলের ওপর রাখল। চাবিগুলো বেশ পুরনো। একটাতে একটা চাবি-রিংও আছে, তাতে একটা ভাঙা গাড়ির ছবি। সে প্রতীকটার ছবিটা আবার দেখল। এই ছবিটা তার পকেটে কেন? হঠাৎ তার মনে হলো, কেউ তাকে দেখছে। সে আড়চোখে তাকাল। রাস্তার উল্টোদিকে, একটা ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার মুখে একটা মাস্ক, মাথায় টুপি। সে একদৃষ্টে চায়ের দোকানটার দিকে তাকিয়ে আছে। অর্কর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। লোকটা কি তাকেই দেখছে? নাকি এটা তার প্যারানয়া? সে চট করে চা শেষ করে টাকা মিটিয়ে উঠে পড়ল। ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার জন্য সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। সে গঙ্গার দিকে না গিয়ে, শহরের ভেতরের দিকে একটা বাসে উঠে পড়ল। বাসটা ধর্মতলার দিকে যাচ্ছে। বাসে জানালার ধারে একটা সিট পেয়ে সে বসল। বাসটা ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে, সে দেখল মাস্ক পরা লোকটা দ্রুতগতিতে বাসে উঠে পড়ল। লোকটা বাসের অন্য প্রান্তে দাঁড়াল, কিন্তু তার চোখ অর্কর দিকেই। অর্কর গলা শুকিয়ে গেল। এটা প্যারানয়া নয়। লোকটা তাকে অনুসরণ করছে। সে ঘামতে শুরু করল। সে এখানে কেন, তা সে জানে না, কিন্তু কেউ একজন যে তাকে চেনে এবং তার পিছু নিয়েছে, এটা স্পষ্ট। বাসের জানালার ধারে বসে সে বাইরের শহরটাকে দেখল। সব কিছু অদ্ভুত অচেনা লাগছে। অথচ 'ধর্মতলা', 'গঙ্গা'—এই নামগুলো তার পরিচিত। সে যেন একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আছে। বাসটা ধর্মতলার মোড়ে আসতেই প্রচণ্ড ভিড় হলো। অর্ক এই সুযোগটা নিল। সে ভিড়ের সাথে মিশে বাস থেকে নেমে পড়ল। সে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে গেল। সে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখল। লোকটা বাস থেকে নামেনি। সে আপাতত নিরাপদ। এই ঘটনাটা তাকে আরও বেশি নাড়িয়ে দিল। সে ঠিক করল, তাকে ওই চাবির রহস্য ভেদ করতেই হবে। এই চাবিগুলোই তার অতীতের একমাত্র দরজা। সে একটা চাবির দোকানে গেল। "দাদা, এই চাবিগুলো দেখে কিছু বলতে পারবেন?" দোকানদার চশমার ফাঁক দিয়ে চাবিগুলো দেখল। "এ তো অনেক পুরনো মডেল। গডরেজের তালা, কিন্তু প্রায় পঁচিশ-তিরিশ বছর আগের। আজকাল আর চলে না।" "কোথায় পাওয়া যেতে পারে এমন তালা?" "বলতে পারব না দাদা। পুরনো কলকাতার কোনও বাড়িতে। উত্তর কলকাতা বা দক্ষিণ কলকাতার কোনও পুরনো পাড়ায় চেষ্টা করে দেখতে পারেন।" উত্তর কলকাতা। নামটা শুনে অর্কর বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। একটা অস্পষ্ট অনুভূতি। সে ঠিক করল, সে উত্তর কলকাতার দিকেই যাবে। হাঁটতে হাঁটতে সে আবার প্রতীকটার ছবিটা বের করল। এটা কীসের প্রতীক? কোনও ক্লাব? কোনও কোম্পানি? সে একটা সাইবার কাফেতে ঢুকল। কম্পিউটারে বসে সে গুগলে সার্চ করল: "Phoenix symbol inside circle triangle"। অসংখ্য ছবি এল। ট্যাটু, লোগো, পৌরাণিক গল্প। কিন্তু তার ছবির সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে এমন কিছু সে পেল না। এটা যেন কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা। সে যখন সাইবার কাফে থেকে বেরোচ্ছে, তার আবার মনে হলো সেই অস্বস্তিটা। সে কি একা? সে দ্রুত একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারপর আরেকটা। সে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল, সে নিজেই হারিয়ে গেছে। একটা পুরনো বাড়ির রোয়াকে সে বসে পড়ল। তার খিদে পেয়েছে, কিন্তু তার থেকেও বেশি পেয়েছে ক্লান্তি। স্মৃতিহীনতার এই বোঝা অসহনীয়। "কী খুঁজছেন?" একটা কণ্ঠস্বর শুনে সে চমকে উঠল। পাশে একজন বয়স্ক লোক বসে বিড়ি খাচ্ছেন। "না, মানে... একটা ঠিকানা।" "কাগজ দেখি?" "কাগজ নেই। শুধু... শুধু এই চাবিগুলো আছে।" সে চাবির গোছাটা দেখাল। ভদ্রলোক অদ্ভুতভাবে হাসলেন। "চাবি দিয়ে ঠিকানা খুঁজছেন? অভিনব ব্যাপার।" অর্ক উঠে দাঁড়াল। সে বুঝতে পারছে সে কতটা হাস্যকর একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল রাস্তার উল্টোদিকের একটা বাড়ির দরজায়। একটা খুব পুরনো, ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের দরজা। আর তার তালার গর্তটা... অর্কর বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে এগিয়ে গেল। চাবির গোছা থেকে সবচেয়ে বড় চাবিটা বের করল। চাবিটা তালার গর্তে ঢুকল। অর্ক একটা গভীর শ্বাস নিল। সে চাবিটা ঘোরাল। খট করে একটা শব্দ হলো। তালাটা খুলে গেল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion