বাসটা তাকে বালিগঞ্জের কাছে নামিয়ে দিল। পাম এভিনিউ।
তার গোড়ালির যন্ত্রণাটা এখন বেশ তীব্র। সে একটা ওষুধের দোকান থেকে ব্যান্ডেজ আর একটা পেইনকিলার কিনল।
১৭/বি, পাম এভিনিউ। এটা একটা বেশ অভিজাত এলাকা। বাড়িগুলো সব পুরনো, কিন্তু বনেদি।
ঠিকানাটা খুঁজে পেতে তার অসুবিধা হলো না। এটা একটা পুরনো তিনতলা বাড়ি। গেটে দারোয়ান নেই। সে গেট খুলে ভেতরে ঢুকল।
ডায়েরিতে লেখা ছিল, "চাবিটা তার কাছে।" কার কাছে?
কলিংবেল বাজাতেই একজন মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুললেন। "কাকে চাই?"
"আমি... আমি অরুণাভ বোসকে খুঁজছি।" সে নিজের নামটাই বলল।
মহিলাটি অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকালেন। "অরুণাভ? সে তো এখানে থাকে না।"
"আমি জানি। সে আমাকে একটা জিনিস আনতে পাঠিয়েছে। এই ঠিকানাটা সে-ই দিয়েছে।"
"কী জিনিস?"
অর্ক দ্বিধা করল। "একটা প্যাকেট।"
মহিলাটি যেন কিছু একটা বুঝলেন। "তুমি ও? যার কথা অরুণ বলেছিল? বলেছিল খুব বিপদে পড়লে একজন আসবে।"
"হ্যাঁ, আমিই।" অর্ক মরিয়া হয়ে বলল।
"ভেতরে এসো।"
মহিলাটি তাকে একটা বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা খুব ছিমছাম করে গোছানো। "অরুণ আমার বোনের ছেলে। যদিও সে বলত, আমিই তার সব। আমার নাম মীনাক্ষী।"
"অরুণ... মানে, অরুণাভ কোথায়?"
"আমি জানি না," মীনাক্ষী দেবীর গলাটা ধরে এল। "তিন দিন আগে সে এসেছিল। খুব তাড়ার মধ্যে ছিল। বলল, কয়েকজন লোক ওর পেছনে লেগেছে। ও এই প্যাকেটটা আমার কাছে রেখে গেল। বলল, যদি ও নিজে না আসে, তাহলে একজন লোক আসবে এই প্রতীকটা নিয়ে।"
মীনাক্ষী দেবী একটা ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করলেন। তার ওপর সেই ফিনিক্সের প্রতীকটা আঁকা।
অর্ক পকেটে হাত দিয়ে দেখল তার ছবিটা নেই। হয়তো পালানোর সময় পড়ে গেছে।
"প্রতীকটা?" মীনাক্ষী দেবী সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
"ওটা আমার কাছে ছিল! কিন্তু আমি... আমি যখন ওই উত্তর কলকাতার বাড়িটা থেকে পালাচ্ছিলাম..."
"ওরা তোমাকেও তাড়া করেছিল?" মীনাক্ষী দেবী আঁতকে উঠলেন।
"হ্যাঁ। দুজন লোক। ওরা আমাকে মেরে ফেলত।"
মীনাক্ষী দেবী আর কথা বাড়ালেন না। তিনি খামটা অর্কর হাতে দিলেন। "অরুণ বলেছিল, এটা খুব জরুরি। এটা নাকি অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে।"
অর্ক খামটা খুলল। ভেতরে আরেকটা চাবি। এটা দেখতে একেবারে অন্যরকম। একটা সেফ ডিপোজিট ভল্টের চাবি। আর একটা কার্ড। তাতে লেখা, "সেন্ট্রাল আর্কাইভস। লকার নং: ৭৩৮।"
"সেন্ট্রাল আর্কাইভস? সেটা কোথায়?"
"আমি জানি না বাবা। অরুণ আর কিছু বলে যায়নি।"
অর্ক বুঝতে পারল, তাকে আবার একটা নতুন খোঁজের সন্ধানে বেরোতে হবে।
সে মীনাক্ষী দেবীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল। তার মাথায় হাজারটা প্রশ্ন। সে কে? অরুণাভ বোস? সে এমন কী প্রমাণ লুকিয়ে রেখেছে যার জন্য এত লোক তার পেছনে পড়েছে?
রাস্তায় বেরিয়ে সে হাঁটছিল। গোড়ালির ব্যথাটা আবার জানান দিচ্ছে।
"এক্সিডেন্ট হয়েছে নাকি?"
একটা মিষ্টি গলার স্বর শুনে সে তাকাল। একটা মেয়ে, তার বয়সীই হবে, স্কুটি থামিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করছে।
"না, মানে... একটু মচকে গেছে।"
"কোথায় যাবেন? চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিই। আপনার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে।"
অর্ক সাধারণত এতটা বিশ্বাসপ্রবণ নয়। এই মুহূর্তে তার সত্যিই সাহায্যের দরকার, কিন্তু হাওড়া স্টেশনের সেই লোকটার কথা তার মনে পড়ল। সে দ্বিধা করছিল।
"ভয় পাবেন না," মেয়েটি হাসল। "আমি কিডন্যাপার নই। দেখুন, আমার প্রেস কার্ড।" সে একটা কার্ড দেখাল। "রিয়া সান্যাল। 'দ্য সেন্টিনেল'-এর জার্নালিস্ট।"
"আমি যাব... সেন্ট্রাল আর্কাইভস।"
মেয়েটি হেসে ফেলল। "সেন্ট্রাল আর্কাইভস? ওটা তো কোনও দর্শনীয় স্থান নয়। ওটা তো পুরনো নথিপত্রের গুদাম। তা আপনার ওখানে কী কাজ?"
"কিছু... কিছু ব্যক্তিগত নথি।"
"বেশ। চলুন। আমি ওই দিকেই যাচ্ছি। আমার নাম রিয়া।"
অর্ক স্কুটিতে বসল।
"আপনার নাম?" রিয়া আয়নায় তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
অর্ক এক মুহূর্ত ভাবল। "অর্ক। আমার নাম অর্ক।" সে ঠিক করল, অরুণাভ নামটা সে ব্যবহার করবে না। যদি ওটা তার আসল নামও হয়, তবুও না।
"অর্ক। সুন্দর নাম।"
স্কুটি চলতে শুরু করল। অর্ক বুঝতে পারছিল না, এই মেয়েটিকে সে বিশ্বাস করতে পারে কি না। মেয়েটা বড্ড বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ।
রিয়া তাকে সেন্ট্রাল আর্কাইভসের বিশাল, পুরনো বিল্ডিংটার সামনে নামিয়ে দিল। "চলুন, আমিও আপনার সাথে ভেতরে আসছি। জায়গাটা আমার চেনা। আমার কাজের জন্য প্রায়ই আসতে হয়।"
অর্ক আপত্তি করল না, কিন্তু সে সতর্ক রইল।
ভেতরে ঢুকে রিসেপশনে সে লকারের কার্ডটা দেখাল। লোকটি তাকে একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে দিল।
"নাম?"
"অর্ক... বোস।" সে অরুণাভের পদবীটাই ব্যবহার করল।
তারা একটা বিশাল ঘরে ঢুকল, যেখানে সারি সারি লকার। রিয়া তার পাশেই হাঁটছিল।
"আপনি এখানে কী খুঁজছেন, অর্ক? আপনার হাবভাব খুব একটা স্বাভাবিক লাগছে না।"
"বললাম তো, কিছু ব্যক্তিগত..."
"আপনি মিথ্যে বলছেন," রিয়া তার দিকে সরাসরি তাকাল। "আজ সকালে আমি হাওড়া স্টেশনে ছিলাম। আমি আপনাকে দেখেছি। আপনি খুব বিভ্রান্ত ছিলেন। তারপর আমি আপনাকে একটা বাসে উঠতে দেখি। তারপর আবার এখানে। ব্যাপারটা কী?"
অর্কর বুকটা ধড়াস করে উঠল। "তুমি আমাকে ফলো করছ?"
"না," রিয়া শান্তভাবে বলল। "আমি একটা স্টোরি কভার করতে গেছিলাম। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার কৌতূহল হয়। আর এখন, এখানে... বলুন, কীসের মধ্যে ফেঁসেছেন আপনি?"
অর্ক ৭৩৮ নম্বর লকারের সামনে এসে দাঁড়াল। সে চাবিটা ঢোকাল। সে রিয়ার দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখে অদম্য কৌতূহল। এটা কি শুধু সাংবাদিকের কৌতূহল? নাকি আরও কিছু?
"আমি জানি না," অর্ক সত্যি কথাটাই বলল। "আমি আজ সকালে হাওড়া স্টেশনে জেগে উঠি। আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমার নাম, বাড়ি... কিচ্ছু না। আমার কাছে শুধু এই চাবিটা ছিল।"
রিয়া অবাক হয়ে তার কথা শুনছিল।
অর্ক লকারটা খুলল।
ভেতরে একটা মেটাল বাক্স।
সে বাক্সটা বের করে আনল। রিয়া উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে।
অর্ক বাক্সটা খুলল। ভেতরে একটা পেনড্রাইভ, আর একটা ভাঁজ করা কাগজ।
কাগজটা সে খুলল।
"অর্ক,
যদি তুমি এটা পড়ো, তার মানে আমার প্ল্যান 'এ' কাজ করেনি। ওরা আমাকে 'অবলিভিয়ন' দিয়েছে। ওরা আমার স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। হয়তো পেরেছে, হয়তো পারেনি।
কিন্তু আসল প্রমাণ এই পেনড্রাইভে। এটা 'প্রজেক্ট ফিনিক্স'-এর সব তথ্য। ওরা শহরের জল শোধনাগারের মাধ্যমে একটা ভয়ঙ্কর জিনিস পরীক্ষা করতে চাইছে। হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপদে।
এই পেনড্রাইভটা খুলো না। এটাতে একটা বায়োমেট্রিক লক আছে, যেটা শুধু আমার বা তোমার আঙুলের ছাপে খুলবে। আর একটা পাসওয়ার্ডও আছে। পাসওয়ার্ডটা হলো: 'তোমার প্রথম আঁকা ছবির নাম'।
আমাকে বিশ্বাস কোরো না। কাউকেই বিশ্বাস কোরো না। এমনকি নিজেকেও না।
অরুণাভ।"
অর্ক চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। অরুণাভ আর সে কি আলাদা লোক? নাকি সে নিজেই নিজেকে এই চিঠি লিখেছে?
"অর্ক... আপনার আঙুলের ছাপ?" রিয়া ফিসফিস করে বলল।
অর্ক পেনড্রাইভটা হাতে নিল। সেটার একপাশে একটা ছোট সেন্সর। সে তার বুড়ো আঙুলটা সেন্সরে রাখল।
একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠল।
"খোদা!" রিয়া চাপা গলায় বলল। "অর্ক, আপনিই অরুণাভ বোস। আপনি আপনার স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন।"
"প্রজেক্ট ফিনিক্স..." অর্ক নামটা উচ্চারণ করল।
"অর্ক, দাঁড়ান," রিয়া তার হাতটা চেপে ধরল। "ফিনিক্স? আপনি কি এই প্রতীকটার কথা বলছেন?" রিয়া তার ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করল। তার ভেতরে সেই ফিনিক্সের প্রতীকটা আঁকা।
"তুমি... তুমি এটা কোথায় পেলে?"
"আমার বাবা," রিয়ার গলাটা ধরে এল। "আমার বাবা একজন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট ছিলেন। তিনি 'প্রজেক্ট ফিনিক্স' নিয়ে কাজ করছিলেন। দু'বছর আগে একটা হিট-অ্যান্ড-রান কেসে তিনি মারা যান। আমি জানি ওটা খুন ছিল।"
রিয়া অর্কর চোখের দিকে তাকাল। "অর্ক, আমরা দুজনেই একই বিপদের মধ্যে আছি।"
ঠিক সেই মুহূর্তে, আর্কাইভের ঘরের দরজাটা খোলার শব্দ হলো। সেই দুজন লোক, যারা তাকে উত্তর কলকাতার বাড়িতে তাড়া করেছিল, তারা ভেতরে ঢুকল। তাদের সাথে আরেকজন। লম্বা, ছিপছিপে, পরনে দামি স্যুট।
"মিঃ বোস," স্যুট পরা লোকটি শান্তভাবে বলল। "অবশেষে আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগল। জিনিসটা আমার হাতে দিন।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion