Episode 3509 words1 views

অধ্যায় ৩: প্রথম ঠিকানা

দরজাটা ক্যাঁচ করে একটা শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে একটা স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার প্যাসেজ। ধুলো আর পুরনো কাগজের গন্ধ। অর্কর বুকটা কাঁপছিল। এটা কি তার বাড়ি? সে ভেতরে ঢুকল। প্যাসেজটা পার হয়ে একটা ছোট উঠোন। চারদিকে দোতলা বাড়ি। রঙচটা দেওয়াল, খড়খড়ি দেওয়া জানালা। দেখেই বোঝা যায় বাড়িটা বহু পুরনো। "কেউ আছেন?" অর্কর গলাটা নিজের কাছেই অচেনা শোনাল। কোনও সাড়া নেই। সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সিঁড়ির ধাপগুলোও ক্ষয়ে গেছে। দোতলার একটা ফ্ল্যাটের দরজায় আরেকটা তালা। সে দ্বিতীয় চাবিটা ব্যবহার করল। দরজা খুলে গেল। ভেতরে আসবাবপত্র বলতে প্রায় কিছুই নেই। একটা ছোট ঘর, একপাশে একটা চৌকি, তাতে একটা নোংরা তোষক পড়ে আছে। একটা ছোট টেবিল আর প্লাস্টিকের চেয়ার। এক কোণে একটা ছোট রান্নাঘর, তাতে কয়েকটা এঁটো বাসন। এটা তার বাড়ি হতে পারে না। এই পরিবেশে সে থাকত? সে টেবিলের ড্রয়ারটা খুলল। ভেতরে কিছু কাগজপত্র। ইলেকট্রিকের বিল, পুরনো খবরের কাগজ। বিলগুলো "অরুণাভ বোস" নামে একজনের। অরুণাভ বোস। এটা কি তার নাম? অর্ক নামটা উচ্চারণ করল। কোনও অনুভূতি হলো না। সে ঘরের কোণে একটা ব্যাগ দেখতে পেল। একটা রুকস্যাক। সে দ্রুত সেটা খুলল। ভেতরে কিছু জামাকাপড়, একটা জলের বোতল, আর একটা ডায়েরি। কাঁপা কাঁপা হাতে সে ডায়েরিটা খুলল। প্রথম কয়েক পাতা জুড়ে হিজিবিজি লেখা। অঙ্ক, কিছু সাংকেতিক চিহ্ন, আর ওই প্রতীকটা—যেটা তার পকেটে ছিল। তারপর একটা পাতা সে খুঁজে পেল, তাতে স্পষ্ট করে কিছু কথা লেখা: "ওরা আমাকে খুঁজে পেয়েছে। আমাকে পালাতে হবে। স্মৃতিই আমার শত্রু। যদি সব ভুলে যাই, হয়তো বেঁচে যাব। কিন্তু প্রমাণটা... প্রমাণটা রাখতেই হবে।" তারিখটা তিন দিন আগের। অর্কর মাথা ঘুরে গেল। সে কীসের প্রমাণ লুকিয়ে রেখেছে? কারা তাকে খুঁজছে? সে ডায়েরির পাতা ওল্টাতে লাগল। শেষের দিকে একটা ঠিকানা লেখা: "১৭/বি, পাম এভিনিউ। চাবিটা তার কাছে।" কার কাছে? হঠাৎ বাইরে একটা শব্দ হলো। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। একাধিক লোক ওপরে উঠছে। অর্কর রক্ত হিম হয়ে গেল। ওরা তাকে খুঁজে পেয়েছে। সে ঘরটার চারদিকে তাকাল। পালানোর কোনও রাস্তা নেই। শুধু একটা জানালা আছে, যেটা একটা সরু গলির দিকে খোলে। দরজায় ধুম ধুম করে ধাক্কা পড়ল। "ভেতরে কে? দরজা খোলো!" অর্ক সময় নষ্ট করল না। সে ডায়েরিটা রুকস্যাকে ভরল, প্রতীকটার ছবিটা পকেটে রাখল, আর চাবির গোছাটা হাতে চেপে ধরল। সে জানালার দিকে দৌড় দিল। জানালার খড়খড়িটা সে এক ঝটকায় খুলে ফেলল। নিচটা বেশ কিছুটা দূরে, কিন্তু লাগোয়া বাড়ির একটা কার্নিশ আছে। দরজা ভাঙার শব্দ হলো। অর্ক কার্নিশের ওপর লাফ দিল। কোনওরকমে ভারসাম্য রেখে সে পাশের বাড়ির ছাদের দিকে এগোল। ঠিক সেই মুহূর্তে, ঘরের দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। দুটো লোক, দুজনেই বেশ লম্বা আর বলিষ্ঠ চেহারার, ঘরে ঢুকল। তাদের একজন অর্ককে দেখতে পেল। "ওই যে! পালাচ্ছে!" লোকটা জানালার দিকে ছুটে এল। অর্ক মরিয়া হয়ে ছাদের ওপর উঠে পড়ল। সে দৌড়াতে শুরু করল। এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে। পুরনো কলকাতার এই একটা সুবিধা। ছাদগুলো সব লাগোয়া। সে শুনতে পাচ্ছিল লোকগুলোও তাকে তাড়া করছে। "ধর ওকে! জ্যান্ত!" অর্ক একটা বাড়ির ছাদ থেকে নিচের একটা সরু গলিতে লাফ দিল। প্রায় দশ ফুট। সে গোড়ালিতে চোট পেল, কিন্তু থামল না। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়াতে লাগল। সে গলি থেকে রাজপথে এসে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়ল। বাসে বসে সে হাঁপাচ্ছিল। তার গোটা শরীর কাঁপছে। এটা কোনও দুঃস্বপ্ন নয়। এটা বাস্তব। কারা তাকে মারতে চায়? আর "অরুণাভ বোস" যদি তার নাম হয়, তবে পাম এভিনিউর ঠিকানায় কী আছে?

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion