Episode 1958 words2 views

প্রথম পর্ব : সন্দেহের সূচনা

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গটা যেন গোটা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ। পুরনো লাল ইটের বিল্ডিং-এর একেবারে পেছনে, শতাব্দী প্রাচীন এক বটগাছের ছায়ায় ঢাকা স্যাঁতসেঁতে একটা জায়গা। বাইরে জীবনের কোলাহল—অবিরাম অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, রোগীর আত্মীয়দের আর্তনাদ, দালালদের ফিসফিসানি—সবকিছু এখানে এসে কেমন যেন থমকে যায়, এক শীতল নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায়। এই জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ছিল ডক্টর রুদ্রাণী সেন। ফরেনসিক মেডিসিনের নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। বয়স তিরিশের কোঠায়, ধারালো নাক, টানা টানা চোখ, আর সেই চোখে এমন এক গভীরতা যা জীবিত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষের সঙ্গেই বেশি কথা বলে। রুদ্রাণীর এই পেশায় আসার পেছনে একটা ব্যক্তিগত কারণ ছিল। পনেরো বছর আগে তার পুলিশ অফিসার বাবা, ইন্সপেক্টর অনীশ সেন, এক কুখ্যাত গ্যাংস্টার এবং তার প্রভাবশালী সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার সময় এক রহস্যজনক ‘হিট-অ্যান্ড-রান’ কেসে মারা যান। কেসটা ধামাচাপা পড়ে যায়, কিন্তু রুদ্রাণীর মনে গেঁথে গিয়েছিল যে, সত্যকে প্রায়শই ক্ষমতার কম্বলের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়। সেই জেদ থেকেই সে এমন এক পেশা বেছে নিয়েছিল, যেখানে মৃতদেহ কথা বলে এবং সত্যকে চাপা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। সেদিন দুপুরটা ছিল বেশ গুমোট। আগস্ট মাসের ভ্যাপসা গরমে রুদ্রাণীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। সামনে পড়ে থাকা একগাদা ফাইলপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার মেজাজ খিঁচড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা নির্দিষ্ট ফাইলে এসে তার চোখ আটকে গেল। কেস নম্বর: GMC/D-418/08, নাম: বীরেন দাস, বয়স: ৬২ বছর, মৃত্যুর কারণ: অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন – অর্থাৎ, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ওয়ার্ড: জেনারেল মেডিসিন, ওয়ার্ড নম্বর সাত। সবই স্বাভাবিক। কিন্তু খটকা লাগল অন্য জায়গায়। গত এক মাসে এটা নিয়ে চার নম্বর ডেথ সার্টিফিকেট তার টেবিলে এল, যেটা ওয়ার্ড নম্বর সাত থেকে ইস্যু করা হয়েছে এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ একই। রুদ্রাণী চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একটা নির্দিষ্ট ওয়ার্ড থেকে এক মাসে চারজন রোগীর একই কারণে মৃত্যু হওয়াটা অসম্ভব নয়, কিন্তু অস্বাভাবিক তো বটেই। বিশেষ করে যখন ফাইলগুলো বলছে, এদের মধ্যে তিনজনই স্থিতিশীল ছিলেন এবং তাদের দ্রুত ছেড়ে দেওয়ার কথা চলছিল। সে পুরনো ফাইলগুলো টেনে বের করল। প্রতিটি ফাইলের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি করে অসমাপ্ত গল্প। অনন্ত সামন্ত, শেফালি রায়, করিম শেখ—প্রত্যেকেই প্রায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখছিলেন। ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু রুদ্রাণীর ফরেনসিক মন বলছিল, শান্ত জলের গভীরে কোথাও একটা চোরাস্রোত বইছে। ঘণ্টাখানেক পর বীরেন দাসের মেয়ে প্রিয়দর্শিনী এসে পৌঁছাল। কান্নায় চোখ-মুখ ফুলে গেছে, কিন্তু তার চোখে কান্নার চেয়েও বেশি ছিল অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তি। “আমি বিশ্বাস করি না বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন,” সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল। “বাবার হার্টের কোনো সমস্যা কোনোদিন ছিল না। সব রিপোর্ট নরমাল ছিল। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। প্লিজ, আপনি যদি একবার…” মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে রুদ্রাণীর ভেতরের সন্দেহটা আরও তীব্র হলো। সে প্রিয়দর্শিনীকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দ্রুত হাতে একটা সিরিঞ্জ আর দুটো ভাকুটেইনার তুলে নিল। তারপর পা বাড়াল মর্গের সেই হিমশীতল ঘরের দিকে। এটা নিয়মের বিরুদ্ধে, অনৈতিকও বটে। কিন্তু রুদ্রাণীর মন বলছিল, নিয়ম ভাঙার ঝুঁকিটা তাকে নিতেই হবে। মর্গের ঠান্ডা, জীবাণুর গন্ধমাখা ঘরে বীরেন দাসের নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে রুদ্রাণীর হাত সামান্য কাঁপছিল। দ্রুত হাতে সে বীরেন দাসের ফিমোরাল আর্টারি থেকে দশ মিলি রক্ত সংগ্রহ করে দুটো আলাদা টিউবে ভরে নিল। নিজের অফিসে ফিরে সে টিউব দুটোকে লেবেল করল। একটা সাধারণ টক্সিকোলজি স্ক্রিনিং-এর জন্য হাসপাতালের ল্যাবে পাঠাবে। অন্যটা, যেখানে তার আসল সন্দেহ, সেটাকে পাঠাতে হবে বাইরে, তার বন্ধু ডক্টর সায়ন্তন মিত্রের প্রাইভেট ল্যাবে। সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি করল না রুদ্রাণী। সে ঠিক করল, ওয়ার্ড নম্বর সাতে একবার যাবে। করিডোর ধরে হাঁটার সময় সে হাসপাতালের আসল রূপটা দেখছিল। একদিকে ঝাঁ-চকচকে পে-ক্লিনিক, যেখানে পয়সাওয়ালা রোগীদের জন্য সবরকম সুবিধা মজুত। অন্যদিকে জেনারেল ওয়ার্ডগুলোর করুণ দশা। দেওয়ালে নোনা ধরা, স্যাঁতসেঁতে মেঝে, একটা বেডে দুজন রোগী। বাতাসে ওষুধের গন্ধের সাথে মিশে আছে একরাশ অসহায়তা আর যন্ত্রণা। ওয়ার্ড নম্বর সাতে পৌঁছে সে দেখল, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। পঞ্চাশটা বেডের একটা বিশাল হল, কিন্তু রোগী তার চেয়েও বেশি। অনেকে মেঝেতে শুয়ে আছে। ক্লান্ত, অবসন্ন নার্সরা ছোটাছুটি করছেন। জুনিয়র ডাক্তারদের চোখেমুখে অনিদ্রার ছাপ। হেড নার্সের কাউন্টারে বসেছিলেন প্রৌঢ়া নূরজাহান বেগম। মুখে শান্ত, সৌম্য ভাব। রুদ্রাণীর প্রশ্ন শুনে তিনি ধীরেসুস্থে বললেন, “ডাক্তার, আমি এই লাইনে তিরিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। ভগবানের ডাক এলে ডাক্তার-বদ্যি কেউ আটকাতে পারে না।” তার উত্তরটা এত নিখুঁত আর তৈরি করা যে রুদ্রাণীর সন্দেহ আরও বাড়ল। ওয়ার্ডের ভেতরে বেড নম্বর ১৭-এর পাশের বেডের এক বয়স্ক রোগী জানালেন, “রাতে ঘুমের ঘোরে একবার দেখেছিলাম, শঙ্কর, আমাদের ওয়ার্ড বয়, বীরেনবাবুর স্যালাইনের বোতলটা পাল্টে দিচ্ছিল।” রুদ্রাণী দেখল, ওয়ার্ডের অন্য প্রান্তে ঝাঁটা হাতে এক রোগা, লম্বাটে চেহারার যুবক, শঙ্কর, তার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। ওয়ার্ডে একজন তরুণ ডিউটি ডাক্তারকেও দেখল রুদ্রাণী, নাম ডক্টর অনিমেষ রায়। ছেলেটি অত্যন্ত স্মার্ট এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী, কিন্তু রুদ্রাণীকে দেখে সে যেন কিছুটা নার্ভাস হয়ে গেল এবং দ্রুত ফাইল দেখার নাম করে অন্যদিকে সরে গেল। ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে সে সোজা গেল হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডক্টর অরুণাভ ঘোষের অফিসে। ডক্টর ঘোষ রুদ্রাণীর কথা শুনেই রেগে গেলেন। “অসম্ভব! ওয়ার্ড নম্বর সাতের ইন-চার্জ ডক্টর অরিজিৎ রায়, শহরের অন্যতম সেরা ফিজিশিয়ান। তার দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানে, হাসপাতালের সুনাম নষ্ট করা।” হতাশ হয়ে অফিসে ফিরে আসার পথে মর্গের বহু পুরনো অ্যাটেনডেন্ট, রতন দাসের সাথে দেখা হলো। “ম্যাডাম, কিছু মৃত্যু যতটা পরিষ্কার দেখায়, ততটা পরিষ্কার হয় না,” তিনি ফিসফিস করে বললেন। “সাত নম্বর ওয়ার্ডের দিকে নজর রাখবেন। ওটা সাপের গর্ত। দশ বছর আগে আমার বোনটাও ওই ওয়ার্ডেই মারা গেছিল। ডাক্তাররা বলেছিল হার্ট অ্যাটাক। আমি কোনোদিন বিশ্বাস করিনি। সাবধানে থাকবেন।” রাতে বাড়ি ফিরে রুদ্রাণী তার এক কামরার ফ্ল্যাটে ঢুকল। চারদিকে নিস্তব্ধতা। দেওয়ালে তার বাবা, ইন্সপেক্টর অনীশ সেনের একটা ছবি টাঙানো। রুদ্রাণী ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, আমি জানি না আমি ঠিক করছি কিনা। কিন্তু আমি এদেরকে জিততে দেব না।” রাত প্রায় দুটো। রুদ্রাণীর ফোনে সায়ন্তনের ফোন এল। “রু, তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলিস?” সায়ন্তনের গলায় উত্তেজনা। “না, বল। কিছু পেলি?” “পেয়েছি। এবং যা পেয়েছি, তা অবিশ্বাস্য। বীরেন দাসের রক্তে আমি সাক্সিনাইলকোলিন (Succinylcholine)-এর মেটাবলাইটের ট্রেস পেয়েছি। শুধু তাই নয়, রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রাও অস্বাভাবিক বেশি। কিন্তু আরও একটা জিনিস পেয়েছি, যেটা অদ্ভুত। একটা অজানা অর্গানিক কম্পাউন্ড, যেটা সাধারণ কোনো বিষ নয়। মনে হচ্ছে এটা কোনো কাস্টম-মেড ড্রাগ, যা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলোকে আরও তীব্র করে তোলে এবং পোস্টমর্টেমে ধরা পড়া প্রায় অসম্ভব করে দেয়।” অবশেষে রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। এটা শুধু খুন নয়, এটা অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং বৈজ্ঞানিকভাবে sofisticated খুন। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion