Episode 2758 words0 views

দ্বিতীয় পর্ব : ষড়যন্ত্রের জাল

সায়ন্তনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য রুদ্রাণীকে এক নতুন উদ্যম দিল। সে পরদিন সকালে প্রথমে গেল হাসপাতালের ফার্মাসিতে। গত এক মাসের স্টক রেজিস্টার ঘাঁটতে গিয়ে দেখল, ওয়ার্ড নম্বর সাত থেকেই বেশ কয়েকবার সাক্সিনাইলকোলিন ইস্যু করা হয়েছে। প্রত্যেকবারই রিকুইজিশন স্লিপে সই রয়েছে ডক্টর অরিজিৎ রায়ের। এরপর সে গেল অ্যাকাউন্টস বিভাগে। সেখানকার প্রধান, বিমল পোদ্দার, একজন অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির লোক। রুদ্রাণী স্বাস্থ্যবিমার বিলগুলো দেখতে চাইলে তিনি প্রথমে অজুহাত দিতে লাগলেন। কিন্তু রুদ্রাণীর চাপের মুখে তিনি ফাইলগুলো বের করে দিলেন। রুদ্রাণী দেখল, মৃত রোগীদের প্রত্যেকের নামে লক্ষ লক্ষ টাকার বিল করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয় টেস্ট এবং দামী ওষুধের জন্য। কিন্তু যখন সে ফাইলগুলোর ফটোকপি চাইল, পোদ্দার প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, “ম্যাডাম, আমার মেয়ের হার্টের অপারেশন। আমাকে এর মধ্যে জড়াবেন না।” ঠিক তখনই রুদ্রাণীর ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। ফোনের ওপার থেকে এক গম্ভীর গলা ভেসে এল, “ডক্টর সেন, কিছু জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো। আপনার নিজের এবং আপনার পরিবারের জন্য।” ফোনটা কেটে গেল। রুদ্রাণী বুঝল, তার তদন্তের খবর ফাঁস হয়ে গেছে। সে যখন নিজের অফিসে ফিরছে, তার সেক্রেটারি জানাল, একজন ভিজিটর তার জন্য অপেক্ষা করছেন। রুদ্রাণী তার হিমশীতল অফিসঘরে ঢুকে দেখল, চেয়ারে বসে আছেন স্বয়ং মিঃ অবিনাশ চৌধুরী। পরনে দামী স্যুট, মুখে এক শান্ত কিন্তু শীতল হাসি। “আসুন ডক্টর সেন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম,” মিঃ চৌধুরী নরম গলায় বললেন। “শুনলাম আপনি নাকি হাসপাতালের কিছু পুরনো ঘটনা নিয়ে খুব আগ্রহী। আপনার বাবা, ইন্সপেক্টর অনীশ সেন, তিনিও খুব সৎ অফিসার ছিলেন। তিনিও সিস্টেমের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু অপ্রিয় সত্য খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিস্টেমের চাকা বড় নির্মম, ডক্টর সেন। তার নিচে পড়লে কেউ আস্ত থাকে না। আশা করি আপনি আপনার বাবার মতো ভুল করবেন না।” কোনো প্রমাণ না রেখে, শুধু কথার জালে মিঃ চৌধুরী এক হিমশীতল হুমকি দিয়ে গেলেন। রুদ্রাণীর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এই লোকটা শুধু তার তদন্তের কথাই জানে না, তার বাবার মৃত্যুরহস্যের সাথেও জড়িত। সেই রাতেই রুদ্রাণী ঠিক করল, তাকে সেই ৩১২ নম্বর লকারটা খুলতেই হবে। রতন দাসের কাছ থেকে সে চাবিটা জোগাড় করল। মর্গের পাশের অন্ধকার, ভুতুড়ে স্টোররুমে ঢুকে তার গা ছমছম করছিল। ৩১২ নম্বর লকারটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা ডায়েরি বেরিয়ে এল। ডায়েরিটা ছিল সেই সুধীর বর্মনের, যিনি একজন সাংবাদিক ছিলেন। তিনি হাসপাতালের এক ভয়ঙ্কর চক্রের তদন্ত করছিলেন। ডায়েরিতে লেখা ছিল, মিঃ অবিনাশ চৌধুরীর ব্যক্তিগত নার্সিংহোমে অবৈধ অঙ্গ পাচার চক্র চলে। সুধীর বর্মন সেই চক্রের প্রমাণ জোগাড় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু চক্রটা জানতে পেরে যায় এবং তাকে অসুস্থতার নাটক করে ওয়ার্ড নম্বর সাতে ভর্তি করে। ডক্টর রায়কে ব্ল্যাকমেল করে তাকে দিয়ে খুন করানো হয়। ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল, “আমার কাছে একটা পেন ড্রাইভ আছে। তাতে সব প্রমাণ। সেটা আমি হাসপাতালের পুরনো লাইব্রেরির ‘গ্রে’s অ্যানাটমি’ বইয়ের ৪১২ নম্বর পাতার ভেতরে রেখেছি।” মিঃ চৌধুরীর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে রুদ্রাণী একটা তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে ছিল। পরদিন সকালে, সে হাসপাতালের পুরনো, জং ধরা সার্ভিস লিফটটার দিকে এগিয়ে গেল। লিফটে ঢুকে তিনতলার বোতাম টিপল। দ্বিতীয় তলা পার হওয়ার পরেই হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হলো। লিফটের তার ছিঁড়ে যাওয়ার মতো এক কানফাটানো আওয়াজ। লিফটটা তীব্র গতিতে নিচে পড়তে শুরু করল। ঠিক গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছড়ে পড়ার মুহূর্তে এমার্জেন্সি ব্রেকটা বিকট শব্দ করে কাজ করল। একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে লিফটটা থেমে গেল। কর্মীরা এসে দরজা খুলে তাকে উদ্ধার করল। রুদ্রাণী কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল। সবাই এটাকে নিছক দুর্ঘটনা বললেও সে জানত, এটা তাকে সরিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা ছিল। এই ঘটনার পর রুদ্রাণী আরও মরিয়া হয়ে উঠল। সে তার বিশ্বস্ত জুনিয়র, ডক্টর সমীরকে ফোন করে লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথা বলল। কিন্তু রুদ্রাণী জানত না, সমীরের পরিবারকে জিম্মি করে মিঃ চৌধুরী তাকে দিয়ে রুদ্রাণীর উপর নজরদারি করাচ্ছেন। সমীর ফোনটা রেখেই মিঃ চৌধুরীকে সব জানিয়ে দিল। পুরনো লাইব্রেরিতে রুদ্রাণী আর সমীর পৌঁছানোর পরেই তাদের উপর হামলা হলো। শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর লড়াই। সমীর লোকগুলোকে আটকানোর অভিনয় করতে গিয়ে সামান্য আহত হলো। রুদ্রাণী এই সুযোগে বইটা খুঁজে বের করল, কিন্তু সেখানে কোনো পেন ড্রাইভ ছিল না! পাতাটার মাঝখানটা শুধু চৌকো করে কাটা। হতাশ হয়ে সে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন তার চোখে পড়ল বইয়ের তাকের পেছনে দেওয়ালের একটা আলগা ইঁটের দিকে। কৌতূহলী হয়ে ইঁটটা সরাতেই সে একটা ছোট, কালো পেন ড্রাইভ খুঁজে পেল। ঠিক সেই মুহূর্তে, লাইব্রেরির অন্য দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে পুলিশ নিয়ে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর অরিত্র ব্যানার্জী। রুদ্রাণী লাইব্রেরিতে আসার আগেই তাকে একটা মেসেজ করে রেখেছিল। মিঃ চৌধুরীর লোকেরা ধরা পড়ল। কিন্তু রুদ্রাণীর বিপদ এখানেই শেষ হলো না। সেই রাতে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফ্ল্যাটে ফিরে রুদ্রাণী দেখল, তার বাবার ছবিটি সামান্য বাঁকানো এবং তার বাবার পুরনো ডায়েরিটা অন্যদিনের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি ডানদিকে সরানো। কেউ তার ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল। কিছু চুরি করতে নয়, শুধু তাকে এটা বোঝাতে যে, সে কোথাও নিরাপদ নয়। পরদিন সকালে, হাসপাতালের ক্যান্টিনে তার কফিতে বিষ মেশানোর চেষ্টাও হলো। একই সাথে, ডক্টর ঘোষ রুদ্রাণীকে সাসপেন্ড করে দিলেন। রুদ্রাণী বুঝল, মিঃ চৌধুরী এবার তাকে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ একা এবং কোণঠাসা করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion