Episode 4524 words1 views

চতুর্থ পর্ব : ভোরের আলো

পরের কয়েকটা দিন যেন একটা ঝড়ের মধ্যে দিয়ে কাটল। “ওয়ার্ড নম্বর সাত” কাণ্ড এবং মিঃ চৌধুরীর পতন নিয়ে গোটা দেশে তোলপাড়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিরূপ সেনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো এবং তার বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হলো। হাসপাতালের ভেতরেও চলছিল তুমুল অস্থিরতা। ডক্টর ঘোষকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। একটা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই সমস্ত কোলাহলের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও রুদ্রাণী নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। সে এখন সবার চোখে হিরো, কিন্তু এই সম্মান তার কাছে কাঁটার মুকুটের মতো মনে হচ্ছিল। তার সাসপেনশন তুলে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে আর আগের মতো কাজে মন দিতে পারছিল না। হাসপাতালের করিডোর, ওয়ার্ড, এমনকি তার নিজের অফিসঘর—সবকিছুই তাকে সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই লড়াইয়ে সে জিতেছে ঠিকই, কিন্তু তার ভেতরের অনেকটা অংশ যেন মরে গেছে। একদিন ইন্সপেক্টর অরিত্র তার সাথে দেখা করতে এলেন। “আমি দুঃখিত, ডক্টর সেন। আমি প্রথমটায় আপনাকে বিশ্বাস করিনি এবং পরেও আপনাকে একা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।” “আপনি আপনার কর্তব্যের বাইরে গিয়েও আমাকে সাহায্য করেছেন, ইন্সপেক্টর,” রুদ্রাণী ম্লান হেসে বলল। “আপনার বাবার কেসটা আমি আবার রি-ওপেন করার জন্য আবেদন করেছি। মিঃ চৌধুরীর গ্রেফতারের পর পুরনো অনেক ফাইল নতুন করে খোলা হচ্ছে। হয়তো এবার সুবিচার হবে।” দুজনের মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি হলো। কয়েক মাস কেটে গেল। ডক্টর অরিজিৎ রায়, নূরজাহান বেগম, শঙ্কর, অনিমেষ এবং মিঃ চৌধুরীর বিরুদ্ধে চার্জশিট গঠন করা হয়েছে। প্রমাণ এতটাই অকাট্য যে তাদের শাস্তি প্রায় নিশ্চিত। ডক্টর রায় রাজসাক্ষী হওয়ায় এবং ডক্টর সমীর তদন্তে সাহায্য করায় তাদের শাস্তি কিছুটা কম হতে পারে। রুদ্রাণীকে ডিপার্টমেন্টের হেড করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে ফিরিয়ে দিয়েছে। এই হাসপাতালের দেওয়ালগুলো তার কাছে এখন এক দমবন্ধ করা স্মৃতির মতো। সে ঠিক করেছে, এখান থেকে ইস্তফা দেবে। পাহাড়ের কোনো একটা ছোট শহরে গিয়ে একটা ক্লিনিক খুলবে, যেখানে সে সত্যিই মানুষের সেবা করতে পারবে, কোনো সিস্টেম বা ষড়যন্ত্রের অংশ না হয়ে। সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির এক সুন্দর সকাল। রুদ্রাণী তার ইস্তফাপত্রটা জমা দিয়ে হাসপাতাল থেকে শেষবারের মতো বেরিয়ে আসছিল। গেটের কাছে আসতেই সে দেখল, ডক্টর সমীর দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে জল। “ম্যাডাম, আমি জানি আপনি আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবেন না। কিন্তু আমি আমার ভুলের জন্য অনুতপ্ত।” রুদ্রাণী কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু তার দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। ক্ষমা করা বা না করার ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিল সে। রাস্তায় বেরিয়ে এসে রুদ্রাণী একটা গভীর শ্বাস নিল। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা, গাড়ির হর্ন, মানুষের কোলাহল—সবকিছুকে আজ নতুন বলে মনে হচ্ছে। একটা দীর্ঘ, অন্ধকার রাতের অবসান হয়েছে। ভোরের আলো ফুটেছে। উপসংহার ছয় মাস পর। দার্জিলিং-এর কাছে এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। রুদ্রাণী তার ছোট ক্লিনিকে বসে এক বয়স্ক রোগীর প্রেসার মাপছে। তার মুখে এক অনাবিল শান্তি। টেবিলের উপর একটা চিঠি পড়ে আছে, প্রিয়দর্শিনীর পাঠানো। চিঠির সাথে একটা খবরের কাগজের কাটিং। মিঃ চৌধুরী এবং ডক্টর রায়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের খবর। চিঠির ভাঁজে আরও একটি চিঠি ছিল, ইন্সপেক্টর অরিত্রের পাঠানো। তাতে লেখা, “আপনার বাবার কেসের মূল আসামীকে চিহ্নিত করা গেছে। মিঃ চৌধুরীর নির্দেশেই ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাকে খুন করানো হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এর সাথে জড়িত ছিলেন। সুবিচার হতে চলেছে, ডক্টর সেন। আপনার বাবা আজ শান্তিতে ঘুমোবেন।” রুদ্রাণী ক্লিনিকের জানালা দিয়ে বাইরের কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকাল। তার চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সেটা কষ্টের নয়, শান্তির। তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কিন্তু তার মনে আজ কোনো ভয় নেই, কোনো দ্বিধা নেই। সে জানে, সে সত্যের পথে চলেছিল। আর সেই সত্যের আলোই তাকে আগামী দিনে পথ দেখাবে। ~ সমাপ্ত ~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion