সাসপেন্ড হওয়া এবং সহকর্মীদের অবিশ্বাস রুদ্রাণীকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছিল। সে নিজেকে নিজের ফ্ল্যাটে একরকম বন্দী করে ফেলল। ইন্সপেক্টর অরিত্রের সাথে দেখা করতে গিয়ে সে আরও বড় ধাক্কা খেল। “আমার হাত-পা বাঁধা, রুদ্রাণী,” অরিত্র হতাশ গলায় বলল। “উপরের মহল থেকে প্রচণ্ড চাপ আসছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিরূপ সেনের অফিস থেকে সরাসরি আমার ডিপার্টমেন্টের মাথায় ফোন এসেছে।
উনি মিঃ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ। আমাকে স্পষ্ট বলা হয়েছে এই কেস থেকে সরে দাঁড়াতে, নাহলে আমাকে সুন্দরবনে বদলি করে দেওয়া হবে।” অরিত্রের অসহায়ত্ব রুদ্রাণীকে সম্পূর্ণ একা করে দিল। সেই রাতেই ব্রেকিং নিউজ দেখানো হলো: “ডক্টর রুদ্রাণী সেন: মানসিক বিকারগ্রস্ত নাকি ষড়যন্ত্রকারী?” মিডিয়াতে তার চরিত্রহনন শুরু হয়ে গেল। হাসপাতালের যে সহকর্মীরা এতদিন তাকে সমীহ করত, তারাই এখন তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল।
এই জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যেই এক চিলতে আলোর মতো রুদ্রাণীর কাছে একটা ফোন এল। ফোনের ওপার থেকে একজন তরুণ নিজের পরিচয় দিল, “আমি অনির্বাণ দত্ত, একজন স্বাধীন সাংবাদিক। আমি সুধীর বর্মনের অসমাপ্ত কাজটা শেষ করতে চাই। আমি জানি আপনাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই।” অনির্বাণের সাহায্য রুদ্রাণীকে নতুন করে বাঁচার রসদ দিল।
সে অনির্বাণকে পেন ড্রাইভের একটা কপি দিল। তারা দুজনে মিলে রাতের পর রাত জেগে তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করতে শুরু করল। অনির্বাণ তার নিজস্ব সোর্স ব্যবহার করে জানতে পারল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিরূপ সেন শুধু এই চক্রের অংশীদারই নন, তার নিজের কিডনিও প্রতিস্থাপন করা হয়েছে মিঃ চৌধুরীর নার্সিংহোমে, এবং সেই কিডনি এসেছিল এক গরিব রোগীর শরীর থেকে, যাকে ওয়ার্ড নম্বর সাত থেকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
তদন্ত যখন এই পর্যায়ে, ঠিক তখনই রুদ্রাণীর কাছে মিঃ চৌধুরীর কাছ থেকে একটা বৈঠকের প্রস্তাব এল। এক নির্জন, পাঁচতারা হোটেলের রেস্তোরাঁয় চৌধুরী তার সামনে একটা প্রস্তাব রাখল। “দেখুন ডক্টর সেন, আপনি যদি এই তদন্ত বন্ধ করে দেন, আমি ডক্টর রায়ের মেয়ের চিকিৎসার সমস্ত খরচ সারাজীবনের জন্য দেব। শুধু তাই নয়, এই হাসপাতালের গরিব রোগীদের জন্য আমি পাঁচ কোটি টাকার একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট তৈরি করে দেব, যার পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন আপনি।
ভাবুন, কয়েকজন মৃত মানুষের সুবিচারের জন্য লড়বেন, নাকি হাজার হাজার জীবিত, অসহায় মানুষের জীবন বাঁচাবেন? সিদ্ধান্ত আপনার।” এই প্রস্তাব রুদ্রাণীকে এক ভয়ঙ্কর নৈতিক সংকটে ফেলল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার জেদ, তার নীতিবোধ টলে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই তার বাবার মুখটা মনে পড়ল। “আমার সুবিচার কেনা যায় না, মিঃ চৌধুরী,” রুদ্রাণী শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বলে উঠে দাঁড়াল। “আপনার খেলা শেষ।”
রুদ্রাণী অরিত্রকে ফোন করল। “অরিত্র, আমার একটা শেষ সাহায্য লাগবে। এটা অফিশিয়ালি নয়, একজন বন্ধু হিসেবে।” সে তার চূড়ান্ত পরিকল্পনার কথা জানাল। “আমি নিজেই টোপ হব। আজ রাতে আমি ওয়ার্ড সাতে ডিউটি করব। ওরা জানবে আমি একা, সাসপেন্ডেড, কোণঠাসা। আমাকে শেষ করার এটাই সেরা সুযোগ।” অরিত্র আঁতকে উঠলেও রুদ্রাণীর জেদের কাছে হার মানল। “বিশ্বাস রাখো। শুধু ওয়ার্ডের বাইরে সাদা পোশাকে নজর রেখো। আর অনির্বাণকে খবর দিয়েছি। সে বাইরে থেকে লাইভ করবে। যদি আমার কিছু হয়, গোটা দুনিয়া জানবে।”
সেই রাতটা ছিল থমথমে। সাসপেন্ড হওয়া সত্ত্বেও রুদ্রাণী একটি জুনিয়র ডাক্তারের অ্যাপ্রন পরে ওয়ার্ড সাতে ঢুকল। ওয়ার্ড প্রায় অন্ধকার, শুধু নার্সিং স্টেশনের আলো জ্বলছে। রাত প্রায় তিনটে। ওয়ার্ডের দরজায় একটা ছায়া নড়ে উঠল। রুদ্রাণী আড়চোখে দেখল, নূরজাহান বেগম নিঃশব্দে প্রবেশ করছেন। তার পেছনে শঙ্কর এবং ডক্টর অনিমেষ রায়। অনিমেষ এগিয়ে এসে রুদ্রাণীর দিকে একটা সিরিঞ্জ তাক করল।
“খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছিলেন, ম্যাডাম।” ঠিক সেই মুহূর্তে, সমীর, যে পাশের ঘর থেকে সব দেখছিল, সে রুদ্রাণীকে বাঁচানোর জন্য চিৎকার করে উঠল, “ম্যাডাম, সাবধান!” শঙ্কর আর অনিমেষ সমীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নূরজাহান বেগম রুদ্রাণীকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলেন। রুদ্রাণী হাতের কাছে থাকা একটা স্টিলের ট্রে দিয়ে তার হাতে আঘাত করল। সিরিঞ্জটা ছিটকে পড়ে গেল। ঠিক তখনই অরিত্রের পাঠানো পুলিশ বাহিনী ভেতরে ঢুকে পড়ল। নূরজাহান, শঙ্কর এবং অনিমেষ ধরা পড়ল।
জেরার মুখে সবাই ভেঙে পড়ল। অনির্বাণের লাইভ রিপোর্টিং-এর ফলে গোটা শহরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। মিডিয়ার চাপে এবং অকাট্য প্রমাণের সামনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও চুপ করে যেতে বাধ্য হলেন। বিশাল পুলিশ ফোর্স নিয়ে মিঃ চৌধুরী এবং ডক্টর রায়ের বাড়িতে হানা দেওয়া হলো। রুদ্রাণীও অরিত্রের সাথে সেই টিমে ছিল। ডক্টর রায় সহজেই আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু মিঃ চৌধুরী এত সহজে হার মানার পাত্র ছিলেন না। তাকে যখন পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে, তখন তার এক অনুচর বাইরে একটা বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করল। সেই সুযোগে চৌধুরী একজন অফিসারের বন্দুক কেড়ে নিয়ে রুদ্রাণীর মাথায় ধরল। “কেউ এক পা এগোলে এর মাথা উড়িয়ে দেব!” চৌধুরী চিৎকার করে উঠল। সে রুদ্রাণীকে হিঁচড়ে হাসপাতালের নির্মীয়মাণ নতুন বিল্ডিংয়ের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।
বিল্ডিংয়ের ছাদে চৌধুরী রুদ্রাণীকে একেবারে কিনারায় নিয়ে গেল। নিচে কয়েকশো ফুট গভীর খাদ। “তুমি আমার সব শেষ করে দিয়েছ,” চৌধুরী হিসহিস করে বলল। “তোমাকেও আমার সাথে শেষ হতে হবে।” রুদ্রাণী ভয় পেলেও মাথা ঠান্ডা রাখল। সে চৌধুরীর সাথে কথা বলতে শুরু করল, “আপনার বাবাও তো একজন ডাক্তার ছিলেন, তাই না? তিনি কি আপনাকে এটাই শিখিয়েছেন?” চৌধুরী এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। রুদ্রাণী সেই সুযোগটাই নিল। সে তার কনুই দিয়ে চৌধুরীর পেটে সজোরে আঘাত করল। চৌধুরী যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতেই তার হাতের বন্দুকটা আলগা হয়ে গেল। রুদ্রাণী তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। অরিত্রের স্নাইপার ততক্ষণে পজিশন নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তার আগেই রুদ্রাণী পাশে পড়ে থাকা একটা লোহার রড তুলে নিয়ে চৌধুরীর পায়ে আঘাত করল। চৌধুরী টাল সামলাতে না পেরে ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion