ডায়েরি আর ছবি হাতে নিয়ে অনির্বাণ আর অর্ঘ্য গ্রামের দিকে ফিরে এলো। তাদের এবার গুরুচরণ আর সেই রহস্যময় পঞ্চম ব্যক্তিটিকে খুঁজে বের করতে হবে।
তারা হরিচরণ দাদুর দোকানে গেল। অনির্বাণ ডায়েরিটা হরিচরণ দাদুর হাতে দিয়ে বললো, “দাদু, আপনি কি প্রশান্ত মন্ডলকে চিনতেন? আর গুরুচরণ নামে কাউকে?”
হরিচরণ ডায়েরিটা দেখে চমকে উঠলেন। তার চোখ বড় হয়ে গেল। “প্রশান্ত! ও তো বহু বছর আগে এই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ও ছিল খুব ভালো ছেলে। আর গুরুচরণ… ও ছিল এক ভয়ংকর লোক। আমাদের গ্রামের শামান ছিল। কিন্তু ও খারাপ পথে চলে গিয়েছিল।”
“গুরুচরণ কি এখনও বেঁচে আছে? বা তার সম্পর্কে কোনো খবর আছে?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো।
হরিচরণ মাথা নাড়লেন। “না বাবা। ওই দুর্ঘটনার পর গুরুচরণ আর তার কিছু অনুসারী গ্রাম থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, নিশীথের অভিশাপেই তারা মারা গেছে।”
“আর এই ছবিতে যে পঞ্চম ব্যক্তি আছে, তাকে আপনি চিনতে পারছেন?” অনির্বাণ ছবিটি দেখালো।
হরিচরণ ছবিটি খুঁটিয়ে দেখলেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সেই পঞ্চম ব্যক্তিটি ছিল একজন যুবক। তার মুখটা কেমন যেন অচেনা। কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত জেদ ছিল।
“আমি নিশ্চিত নই বাবা। ওর মুখটা মনে পড়ছে না। ও হয়তো গুরুচরণের কোনো শিষ্য ছিল। গুরুচরণের অনেক শিষ্য ছিল, যারা বাইরে থেকে আসতো।” হরিচরণ বললেন।
অনির্বাণ হতাশ হলো। তাহলে সেই পঞ্চম ব্যক্তিটি কে?
অর্ঘ্য বললো, “আমাদের কাছে এখন দুটো কাজ আছে। প্রথমত, খুনি যে ‘জলের গভীরে লুকানো বীজ’ পুঁতেছিল, সেই স্থানটি আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করা। আর দ্বিতীয়ত, গুরুচরণের সেই শিষ্যদের খুঁজে বের করা। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ এখনও বেঁচে আছে।”
অনির্বাণ ডায়েরিটা আবার খুললো। প্রশান্ত মন্ডল লিখেছিলেন, “এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত একদিন হবেই।” এই লাইনটা অনির্বাণকে ভাবিয়ে তুলছিল। খুনি হয়তো মনে করে, সে এই ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করছে।
তারা রুদ্রপুর গ্রামে আরও কয়েকদিন রইলো। গ্রামের বিভিন্ন বয়সের মানুষের সঙ্গে কথা বললো। কিছু মানুষ গুরুচরণের গল্প বললো, কিছু লোক নিশীথ প্রহরী সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস জানালো। কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারলো না সেই পঞ্চম ব্যক্তি সম্পর্কে।
অনির্বাণ সিদ্ধান্ত নিলো, তাদের এবার শহরে ফিরে যেতে হবে। ডায়েরিটা ভালো করে বিশ্লেষণ করতে হবে। আর সেই জীবিত তিন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে, যারা ওই ঘটনার সময় লজে ছিল, কিন্তু এখনও বেঁচে আছে। রতন দাস, সুস্মিতা সেন এবং রিকি মুখার্জী।
তারা রুদ্রপুর ইকো-লজে ফিরে এলো। সুজিত বাবুকে এবার বিস্তারিত জানালো। সুজিত বাবু শুনেই আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। “তার মানে আমার লজের পাশেই এত বড় একটা রহস্য চাপা পড়ে ছিল! আর এই লোকগুলো…!”
“সুজিত বাবু, আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি, এই ডায়েরি বা এখানকার ঘটনা সম্পর্কে কাউকে কিছু বলবেন না। এতে তদন্তের ক্ষতি হতে পারে।” অনির্বাণ বললো।
সুজিত বাবু মাথা নাড়লেন। “ঠিক আছে স্যার। আমি কাউকে কিছু বলবো না।”
অনির্বাণ তার বাবার ডায়েরিটা হাতে নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার বাবার ট্র্যাজেডির পেছনের সত্য এখন তার চোখের সামনে। কিন্তু খুনি কে? এবং কেন সে এতদিন পর এই প্রতিশোধ নিচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি।
অনির্বাণ এবার বুঝতে পারছিল, এই রহস্য কেবল কিছু খুনের ঘটনা নয়। এটা তার পরিবারের, তার শৈশবের এক বিশাল কালো অধ্যায়। আর সেই অধ্যায়ের শেষ পাতাটা তাকেই লিখতে হবে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion