Episode 9832 words0 views

নবম অধ্যায়: মাটির নিচে লুকানো সত্য

রিকির স্টুডিও থেকে বেরিয়ে অনির্বাণ আর অর্ঘ্য সরাসরি সুন্দরবনের দিকে রওনা দিলো। এবার তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট – রুদ্রপুর ইকো-লজের পেছনের সেই পোড়া জঙ্গলে ফিরে যাওয়া। রিকির ছবিটা ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে বড় সূত্র। সেই অস্পষ্ট অবয়ব, যা আগুন লাগার ঠিক আগে জঙ্গলে কিছু পুঁতছিল। “তোমার কি মনে হচ্ছে, আমরা ওখানে কিছু খুঁজে পাবো?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো। “পেতেই হবে, অর্ঘ্য। রতন বাবু লোকটাকে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখেছিলেন, সুস্মিতা দেবী দেখেছিলেন কিছু পুঁততে, আর রিকি তার ছবি তুলেছিল। এই তিনজনের বর্ণনা আর ছবি মিলে যাচ্ছে। সেই লোকটা নিশ্চয়ই কিছু একটা পুঁতেছিল, যা এই সবকিছুর মূলে।” অনির্বাণ দৃঢ় কণ্ঠে বললো। তার চোখে এক নতুন জেদ। তারা পরের দিন সকালে রুদ্রপুর লজে ফিরে এলো। সুজিত বাবুকে কিছু না জানিয়েই তারা লজের পেছনের জঙ্গলের দিকে গেল। রিকির ছবি এবং সুস্মিতা দেবীর বর্ণনা অনুযায়ী, তারা পোড়া জায়গার আরও ভেতরে খুঁজতে শুরু করলো। মাটি নরম, বালি মিশ্রিত। প্রায় এক ঘণ্টা খোঁজার পর অনির্বাণ হঠাৎ থেমে গেল। তার চোখ মাটির এক নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে আছে। “এই যে এখানে!” অর্ঘ্য দ্রুত ছুটে এলো। জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে, কেউ হয়তো কিছুদিন আগে এখানে মাটি খুঁড়েছিল, যদিও এখন তা বৃষ্টির জল আর বাতাসের কারণে প্রায় মিলিয়ে গেছে। অনির্বাণ তার ব্যাগ থেকে একটি ছোট ফোল্ডিং বেলচা বের করলো। “সাবধানে খুঁড়ো, অনির্বাণ। জানি না কী বেরোবে।” অর্ঘ্য বললো। অনির্বাণ সাবধানে মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। কয়েক মিনিট পরই বেলচায় একটা শক্ত কিছুর স্পর্শ লাগলো। সে আরও সাবধানে মাটি সরালো। ধীরে ধীরে একটি পুরনো, পচে যাওয়া কাঠের সিন্দুক বেরিয়ে এলো। সিন্দুকটি আকারে ছোট, প্রায় একটি জুতার বাক্সের সমান। “এটা কী?” অর্ঘ্য উত্তেজিত হয়ে বললো। অনির্বাণ সিন্দুকটি মাটি থেকে তুলে আনলো। সিন্দুকটি বেশ পুরনো, স্যাঁতসেঁতে মাটিতে থেকে তার কাঠের অংশ পচে গেছে। কোনো তালা বা চাবির ব্যবস্থা নেই। অনির্বাণ সাবধানে তার ঢাকনাটা খুললো। ভেতরে কিছু শুকনো পাতার ওপর একটি পুরনো, বাদামী রঙের চামড়ার ডায়েরি রাখা। ডায়েরিটা খুলতেই এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে লাগলো – পুরনো কাগজ, কাদা আর পচনশীলতার মিশ্রিত গন্ধ। ডায়েরির প্রথম পাতায় কিছু অস্পষ্ট হাতের লেখা। তার পাশে একটি ছবি। ছবিটি জুম করতেই অনির্বাণ চমকে উঠলো। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পাঁচজন লোক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ স্পষ্ট। তারা সবাই ছিল রুদ্রপুর লজে নিহত হওয়া তিন ব্যক্তি – গড়িয়াহাটের সরকারি কর্মচারী, লেক টাউনের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, এবং পার্ক স্ট্রিটের ব্যবসায়ী। আর তাদের সঙ্গে আরও দু’জন লোক। তাদের মধ্যে একজন অনির্বাণের খুব চেনা – তার বাবা, ডঃ সুমিত দেবরায়! “অর্ঘ্য! এটা দেখো!” অনির্বাণ কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরি আর ছবিটা অর্ঘ্যর দিকে এগিয়ে দিল। অর্ঘ্য ছবিটা দেখে অবাক হলো। “তোমার বাবা! তিনি এখানে কী করছিলেন?” “আমি জানি না। কিন্তু এই পাঁচজন… তিনজন মৃত। বাকি দু’জনের মধ্যে একজন আমার বাবা।” অনির্বাণ বললো। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তারা দ্রুত ডায়েরির পাতা ওল্টাতে শুরু করলো। ডায়েরিটা তার বাবার হাতের লেখা নয়। কিন্তু লেখাগুলো দেখে মনে হলো, সেগুলো তারই কোনো ছাত্র বা সহকর্মীর হতে পারে। ডায়েরির ভাষা ছিল পুরনো বাংলা। কিছু শব্দ এবং বাক্য স্থানীয় উপভাষার মতো। ডায়েরিতে লেখা আছে, প্রায় পঁচিশ বছর আগে, ডঃ সুমিত দেবরায় একটি গবেষণার জন্য সুন্দরবনের রুদ্রপুর অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনি “নিশীথ প্রহরী” নামে একটি প্রাচীন গোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান এবং লোকবিশ্বাস নিয়ে কাজ করছিলেন। এই ডায়েরিটা তারই একজন সহকর্মী, নাম প্রশান্ত মন্ডল, লিখেছিলেন। প্রশান্ত মন্ডল তার বাবার গবেষণায় সাহায্য করতেন। ডায়েরিতে লেখা আছে, নিশীথ প্রহরী ছিল প্রকৃতির উপাসক। তারা নিশীথ মন্ত্রের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করত। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু লোক, বিশেষ করে একজন শক্তিশালী শামান, গুরুচরণ, বিশ্বাস করতেন যে নিশীথ মন্ত্রের ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ডায়েরির মাঝের পাতায় একটি গুরুতর ঘটনার উল্লেখ আছে। প্রশান্ত মন্ডল লিখেছিলেন, “আজ এক ভয়াবহ দিন। গুরুচরণ তার শিষ্যদের নিয়ে নিশীথ মন্ত্রের অপপ্রয়োগ করার চেষ্টা করেছে। তারা বিশ্বাস করে, এই মন্ত্রের মাধ্যমে তারা প্রাকৃতিক শক্তিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। ডঃ সুমিত দেবরায় এর প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু গুরুচরণ শুনলেন না। এক অশুভ শক্তির জন্ম হলো।” ডায়েরিতে আরও লেখা আছে, সেই রাতে গুরুচরণ এবং তার অনুসারীরা একটি গোপন আচারের চেষ্টা করেছিল। সেই আচারের ফলস্বরূপ লজের কাছেই একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ডায়েরিতে স্পষ্ট লেখা নেই, তবে দুর্ঘটনার পর অনেক লোক মারা গিয়েছিল। প্রশান্ত মন্ডল লিখেছিলেন, “আমরা গুরুচরণকে থামাতে পারিনি। ডঃ সুমিত দেবরায় গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন। আমরা জানি না, তিনি আর স্বাভাবিক হতে পারবেন কিনা। এই গ্রামের ওপর নিশীথের অভিশাপ নেমে এসেছে।” এবং ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা আছে: “আমাদের এই গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে। আমি এই ডায়েরিটা মাটির নিচে পুঁতে দিলাম। যদি কখনো কেউ এটা খুঁজে পায়, সে যেন জানে, এই ঘটনার পেছনের সত্য। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত একদিন হবেই।” অনির্বাণ ডায়েরিটা শেষ করে চোখ বন্ধ করলো। সব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তার বাবার অসুস্থতা, সুন্দরবন ছেড়ে আসা, এবং তার স্মৃতি থেকে সবকিছু মুছে যাওয়া – সবকিছুর কারণ ছিল এই ভয়ঙ্কর ঘটনা। তার বাবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন, কারণ তিনি এই ভয়াবহতার সাক্ষী ছিলেন। “তার মানে তোমার বাবা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সাক্ষী, একজন শিকার!” অর্ঘ্য বললো। “আর এই তিনজন… যারা মারা গেছে, তারাও এই ঘটনার সাক্ষী ছিল। তাদের নাম ছিল রঞ্জন সাহা, অমল দাস, আর শংকর রায়। রঞ্জন ছিলেন সরকারি কর্মচারী, অমল অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, আর শংকর ব্যবসায়ী।” অনির্বাণ বললো। “তারা সবাই এই ঘটনার সাক্ষী ছিল, আর হয়তো এই ঘটনার পেছনের আসল সত্য জানতো।” কিন্তু সেই ছবির পঞ্চম ব্যক্তি কে? নিহত তিনজন, অনির্বাণের বাবা এবং আর একজন। তার নাম ডায়েরিতে উল্লেখ নেই। এই ব্যক্তিই কি সেই খুনি?

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion