Episode 12571 words0 views

দ্বাদশ অধ্যায়: দুই নতুন সাক্ষী

অনির্বাণ এবং অর্ঘ্য জয়ন্ত বিশ্বাস ও দীপক সেনের খোঁজে বের হলো। জয়ন্ত বিশ্বাস ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ইঞ্জিনিয়ার, আর দীপক সেন একটি ছোট প্রিন্টিং প্রেস চালাতেন। দুজনেই কলকাতায় বাস করতেন। প্রথমেই তারা জয়ন্ত বিশ্বাসের বাড়িতে গেল। তিনি একজন স্বাস্থ্যবান, হাসিখুশি মানুষ। অর্ঘ্য পরিচয় দিয়ে খুনের ঘটনার কথা বলতেই তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! ওরা মারা গেছে?” জয়ন্ত বিশ্বাস বললেন, “আমি ওদের চিনি। রুদ্রপুর লজে দেখা হয়েছিল। কী ভয়াবহ ব্যাপার!” “স্যার, আমরা ওই লজে আগুন লাগার ঘটনা সম্পর্কে জানতে এসেছি।” অর্ঘ্য বললো। জয়ন্ত বিশ্বাস কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেন। “আগুন? হ্যাঁ, লেগেছিল। আমিও তখন লজেই ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ চিৎকার শুনে উঠেছিলাম।” অনির্বাণ ছবিটা বের করে দেখালো – পাঁচজন লোক, যাদের মধ্যে অনির্বাণের বাবা এবং নিহত তিন ব্যক্তি ছিলেন। “এই ছবিতে যারা আছেন, তাদের কি আপনি চেনেন? আর এই পঞ্চম ব্যক্তি কে?” জয়ন্ত বিশ্বাস ছবিটি খুঁটিয়ে দেখলেন। “হ্যাঁ, এদের চিনি। ইনি ডঃ সুমিত দেবরায়। আর এই তিনজন… রঞ্জন, অমল, শংকর। আর এই যুবক… ওর নাম ছিল অরিজিৎ। ও আমার পাশের কটেজেই ছিল। গুরুচরণের এক শিষ্য।” অনির্বাণ আর অর্ঘ্য চমকে উঠলো। “গুরুচরণের শিষ্য? আপনি কি নিশ্চিত?” অনির্বাণ জানতে চাইলো। “হ্যাঁ। ওর সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা হতো। ও সুন্দরবনের লোককথা আর নিশীথ মন্ত্র নিয়ে খুব আগ্রহী ছিল। বলতো, গুরুচরণ নাকি তাকে এই সব শিখিয়েছে। অরিজিৎ দেখতে রোগা হলেও তার চোখে একটা অদ্ভুত উন্মাদনা ছিল।” জয়ন্ত বিশ্বাস বললেন। “আসলে ও গুরুচরণের হয়ে লজের গেস্টদের মধ্যে প্রচার চালাচ্ছিল।” “আপনার কি মনে আছে, সেই রাতে অরিজিৎ কোথায় ছিল?” অর্ঘ্য প্রশ্ন করলো। জয়ন্ত বিশ্বাস কিছুক্ষণ ভাবলেন। “হ্যাঁ, মনে আছে। আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে আমি কটেজের বাইরে সিগারেট খাচ্ছিলাম। তখন দেখি অরিজিৎ লজের পেছনের দিক থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তার পরনে গ্রামের লোকের মতো একটা ধুতি-পাঞ্জাবি ছিল, আর কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ ছিল। ওকে দেখে মনে হয়েছিল, সে যেন কোনো গোপন কাজ সেরে ফিরছে।” অনির্বাণ রতন, সুস্মিতা, রিকি এবং জয়ন্ত বিশ্বাসের বর্ণনা মিলিয়ে দেখলো। সব মিলে যাচ্ছে। রিকির ছবিতে দেখা অস্পষ্ট অবয়বটি ছিল অরিজিৎ! “তার মানে সেই রাতে আগুন লাগার ঘটনার পেছনে অরিজিৎ ছিল?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো। “আমি জানি না, তবে ওকে দেখেই মনে হয়েছিল, সে যেন কিছু গোপন করছে।” জয়ন্ত বিশ্বাস বললেন। তারা এরপর দীপক সেনের বাড়িতে গেল। দীপক সেন একজন রোগা, শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তিনিও রুদ্রপুরের ঘটনা শুনে রীতিমতো ভেঙে পড়লেন। “স্যার, আমি ওই লজের আগুন লাগার ঘটনা সম্পর্কে জানতে এসেছি।” অর্ঘ্য বললো। “আগুন? হ্যাঁ, লেগেছিল। খুব ভয়াবহ রাত ছিল।” দীপক সেন বললেন। অনির্বাণ সেই ছবিটা দেখালো। দীপক সেনও অরিজিৎকে চিনলেন। “অরিজিৎ? ও তো খুব অদ্ভুত প্রকৃতির ছেলে ছিল। সব সময় গুরুচরণের কথা বলতো।” “সেই রাতে আগুন লাগার আগে বা পরে, আপনি কি কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিলেন?” অনির্বাণ জানতে চাইলো। দীপক সেন কিছুটা দ্বিধা করলেন। “আসলে আমি একটা জিনিস দেখেছিলাম, যা কাউকে বলিনি। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর আমি যখন কটেজ থেকে বাইরে এসেছিলাম, তখন দেখলাম অরিজিৎ ওই পাঁচজনের সঙ্গে (ছবিতে থাকা) কথা বলছিল। তাদের মধ্যে একটা তর্ক হচ্ছিল। অরিজিৎ খুব উত্তেজিত ছিল।” “কী নিয়ে তর্ক হচ্ছিল?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো। “আমি পুরোটা শুনতে পাইনি। তবে অরিজিৎ বলছিল, ‘তোমরা নিশীথের অভিশাপ ডেকে এনেছ! এর ফল তোমাদের ভুগতে হবে!'” দীপক সেন বললেন। “আর অন্যেরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল।” অনির্বাণ আর অর্ঘ্য একে অপরের দিকে তাকালো। এবার সব স্পষ্ট। অরিজিৎই সেই খুনি। “স্যার, এই লোকগুলো কি কোনো অন্যায় করেছিল?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো। “আমি জানি না। তবে অরিজিৎ তাদের ওপর খুব রেগে ছিল।” দীপক সেন বললেন। অনির্বাণ বুঝতে পারলো, এই পাঁচজন সম্ভবত সেই রাতে গুরুচরণের সেই ভয়ঙ্কর আচারের সাক্ষী ছিল। আর অরিজিৎ বিশ্বাস করতো, তারা হয়তো এই আচারের মাধ্যমে প্রকৃতির ক্ষতি করেছে বা গুরুচরণের ওপর কোনো অন্যায় করেছে, যার জন্য নিশীথ তাদের অভিশাপ দেবে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion