তথ্যগুলো নিয়ে অনির্বাণ আর অর্ঘ্য আবার রুদ্রপুর গ্রামের দিকে ফিরলো। এবার তাদের লক্ষ্য ছিল সরাসরি অরিজিৎকে খুঁজে বের করা। কিন্তু তার কোনো ঠিকানা ছিল না।
অনির্বাণ তার বাবার ডায়েরি আর প্রশান্ত মন্ডলের নোটগুলো পুনরায় গভীরভাবে পর্যালোচনা করলো। ডায়েরিতে “গুরুচরণের শিষ্য” হিসেবে অরিজিতের কোনো সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে প্রশান্ত লিখেছিলেন, গুরুচরণ তার অনুসারীদের দিয়ে নিশীথ মন্ত্রের ক্ষমতা অপব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।
অনির্বাণ তার বাবার ডায়েরি থেকে নিশীথ প্রহরীদের প্রাচীন বিশ্বাস সম্পর্কে আরও জানলো। তারা প্রকৃতিকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করত। নিশীথ মন্ত্র তাদের কাছে প্রকৃতির শক্তিকে জাগিয়ে তোলার একটি উপায় ছিল, কিন্তু তা কোনো ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহারের জন্য ছিল না। গুরুচরণই এই মন্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং ক্ষমতা লাভের জন্য এর অপপ্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন।
সেই ভয়ঙ্কর রাতে, যখন গুরুচরণ তার অনুসারীদের নিয়ে মন্ত্র পাঠ করছিল, তখন অনির্বাণের বাবা ডঃ সুমিত দেবরায় এবং বাকি চারজন (নিহত তিন ব্যক্তি, জয়ন্ত বিশ্বাস ও দীপক সেন) এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তারা গুরুচরণকে থামাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু গুরুচরণ এবং তার কিছু অনুসারী, যার মধ্যে সম্ভবত অরিজিৎও ছিল, তাদের উপর হামলা করে। সেই হামলা এবং মন্ত্রের অপপ্রয়োগের ফলস্বরূপ একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। লজের পাশে আগুন লাগে, কিছু লোক মারা যায় এবং অনির্বাণের বাবা গুরুতর মানসিক আঘাত পান।
এই ঘটনাকে গুরুচরণ ও তার অনুসারীরা “নিশীথের অভিশাপ” হিসেবে প্রচার করেছিল, যাতে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে। অরিজিৎ হয়তো গভীরভাবে এই “অভিশাপ” বিশ্বাস করতো এবং মনে করতো, এই পাঁচজনই এই অভিশাপের মূল কারণ।
তাহলে, অরিজিৎ এখন কেন এই প্রতিশোধ নিচ্ছে? সম্ভবত সে মনে করছে, সেই “পাপের প্রায়শ্চিত্ত” করার সময় এসেছে। তার মাথায় হয়তো ঢুকে গেছে যে, নিশীথ তাকে নির্দেশ দিচ্ছে এই “পাপীদের” শাস্তি দিতে।
অনির্বাণ এবার অর্ঘ্যকে নিয়ে সেই প্রাচীন জায়গাগুলোর দিকে গেল, যেখানে তার বাবা গবেষণা করতেন এবং নিশীথ প্রহরীদের গোপন আস্তানা ছিল বলে জানা যায়। গ্রামের মানুষেরা তাদের সেই জায়গাগুলো সম্পর্কে অস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিল।
সুন্দরবনের গভীরে, ঘন ম্যানগ্রোভের ভেতরে, তারা একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেলো। মন্দিরটি ছিল প্রায় বিলুপ্ত। তার পাশেই কিছু মানুষের অস্থায়ী থাকার প্রমাণ – পুরনো আগুন পোড়ানোর চিহ্ন, কিছু ভাঙা পাত্র।
“মনে হচ্ছে, এখানে কেউ নিয়মিত আসে।” অর্ঘ্য বললো।
হঠাৎ অনির্বাণের চোখে পড়লো মন্দিরের একটি ভাঙা পাথরের ওপর। সেখানে সেই একই প্রতীক আঁকা – একটি বৃত্তের মধ্যে কিছু অস্পষ্ট রেখা, যা তারা লজের পেছনে দেখেছিল। আর তার পাশেই রক্তের শুকিয়ে যাওয়া কিছু দাগ।
“এটা খুনিদের আস্তানা, অর্ঘ্য।” অনির্বাণ বললো। “অরিজিৎ সম্ভবত এখানে তার আচারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।”
অনির্বাণ মন্দিরের ভেতরে গেল। আবছা আলোয় একটি পুরনো পাথরখণ্ড দেখা গেল, যা অনেকটা বলির বেদীর মতো। তার উপরে একটি পুরনো ডায়েরি রাখা। ডায়েরিটা ছিল অরিজিতের।
অরিজিতের ডায়েরিতে লেখা আছে, সে কীভাবে গুরুচরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, কীভাবে সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, সেই রাতের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা এবং অনির্বাণের বাবা সহ বাকিরা নিশীথকে অপমান করেছিল। অরিজিৎ বিশ্বাস করতো, সে নিশীথের দূত, এবং তাকে এই “পাপীদের” শাস্তি দিতে হবে। সে খুনের প্যাটার্নগুলো তৈরি করেছিল, ধাঁধাগুলো লিখেছিল, এবং প্রতিটি খুনের আগে নির্দিষ্ট গাছের পাতা ব্যবহার করেছিল, যা তার মতে “শুদ্ধতার প্রতীক” ছিল।
সে লিখেছিল, “নিশীথ আমার কানে ফিসফিস করে বলছে। আমাকে এই পাপীদের রক্তের মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।”
ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল, “আমার শেষ শিকার… ডঃ সুমিত দেবরায়ের ছেলে। কারণ তার বাবা ছিল এই পাপের মূল হোতা।”
অনির্বাণ ডায়েরিটা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। অরিজিতের পরবর্তী শিকার সে নিজেই!
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion