Episode 2660 words0 views

দ্বিতীয় অধ্যায়: অর্ঘ্যের ডাক

পরের দিন সকাল। অনির্বাণ এসপি অফিসে পৌঁছালো। অর্ঘ্য মিত্র তাকে দেখে এগিয়ে এলো। অর্ঘ্য একজন দৃঢ়চেতা পুলিশ অফিসার। চোখে সবসময় একটা জেদ লেগে থাকে। “কী ব্যাপার অনির্বাণ? দেখে মনে হচ্ছে ঘুমোওনি।” অর্ঘ্য অনির্বাণের কাঁধে হাত রাখলো। “আমার ঘুম আসে না, অর্ঘ্য। তুমি তো জানোই।” অনির্বাণ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল। “এসো, ভেতরে এসো। এসপি স্যার তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।” তারা কনফারেন্স রুমে ঢুকলো। এসপি শংকর রায় বসে আছেন। তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। “অনির্বাণ, শেষবারের মতো বলছি। এই খুনগুলো সাধারণ নয়। আমরা কোনো সূত্র পাচ্ছি না। তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে এই প্যাটার্নগুলো বুঝতে পারছ।” শংকর রায় সরাসরি বললেন। অনির্বাণ একটি চেয়ার টেনে বসলো। “আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করছি, স্যার।” অর্ঘ্য একটি প্রেজেন্টেশন চালু করলো। স্ক্রিনে পার্ক স্ট্রিটের নিহত ব্যক্তির ছবি ভেসে উঠলো। পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক। তার শরীর ক্ষতবিক্ষত। “লাশটা আজ সকালে পাওয়া গেছে। পার্ক স্ট্রিটের একটা পুরনো গেস্ট হাউসের পেছনে। খুনটা গত রাতের কোনো এক সময় হয়েছে।” অর্ঘ্য বললো। অনির্বাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। “তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টা করেনি।” “আমরাও তাই দেখেছি। কিন্তু কেন? সে কি খুনিকে চিনতো?” অর্ঘ্য প্রশ্ন করলো। “সম্ভবত। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি খুনের আগে এবং পরে কিছু প্যাটার্ন আছে, যা এই খুনগুলোকে সাধারণ খুনের তালিকা থেকে আলাদা করে।” অনির্বাণ বললো। অর্ঘ্য পরের স্লাইডে গেল। স্ক্রিনে সেই একই শুকনো পাতা আর কাগজের টুকরো দেখা গেল। “এই পাতাগুলো সুন্দরবনের এক বিশেষ প্রজাতির গাছের, যা শুধুমাত্র ম্যানগ্রোভ অরণ্যে পাওয়া যায়। আমরা বন দফতরে কথা বলেছি। আর এই ধাঁধাগুলো… অনির্বাণ, তুমি এগুলো সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো। অনির্বাণ কাগজের টুকরোটা হাতে নিলো। তাতে লেখা আছে: “নিশীথের ছায়া যখন গ্রাসে, পুরনো পাপের হিসেব কষে। জলের গভীরে লুকানো বীজ, ফিরে আসে সে, ভাঙতে সব বাঁধ। আঁধারের মন্ত্রে, রক্তের রেখা, মুক্তির পথে, এক নতুন লেখা। একবার যে পথ হারায়, ফিরে সে পায় তার অন্তরায়।” অনির্বাণ এই ধাঁধাটা এর আগেও দুবার দেখেছে। প্রতিবারই এর কিছু অংশ পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু মূল থিম একই। তার মনে পড়ে যাচ্ছে কিছু পুরনো বইয়ের কথা, কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি। “এই ধাঁধাগুলো কোনো সাধারণ কবির লেখা নয়। এগুলো সম্ভবত কোনো লোককথা বা প্রাচীন আচারের অংশ।” অনির্বাণ বললো। “এগুলো সুন্দরবনের সঙ্গে, বিশেষ করে কিছু আদিবাসী সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।” এসপি শংকর রায় বিরক্ত হলেন। “লোককথা? অনির্বাণ, আমরা সিরিয়াস একটা ক্রাইম নিয়ে কথা বলছি। তোমার এই লোককথা আমাদের কীভাবে সাহায্য করবে?” “স্যার, এই খুনগুলো কোনো সাধারণ মানুষ করছে না। এর পেছনে একটা গভীর মনস্তত্ত্ব কাজ করছে। খুনি শুধু খুন করছে না, সে একটা বার্তা দিতে চাইছে। একটা আচার পালন করছে। আর এই বার্তাগুলো এই ধাঁধা এবং পাতার মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে।” অনির্বাণ দৃঢ় কণ্ঠে বললো। অর্ঘ্য অনির্বাণকে সমর্থন করলো। “স্যার, অনির্বাণের এই ধরনের বিশ্লেষণ অনেক সময় আমাদের সঠিক পথে নিয়ে গেছে। আমরা সুন্দরবনের দিকে তদন্তের একটা দল পাঠাতে পারি।” “সুন্দরবন? কলকাতা থেকে সুন্দরবন! তোমরা কি পাগল হয়ে গেছ? এই খুনি কি সুন্দরবন থেকে এসে খুন করে আবার ফিরে যাচ্ছে?” শংকর রায় হতাশ হলেন। “না স্যার। খুনি সুন্দরবনের নাও হতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে সুন্দরবনের কোনো যোগসূত্র আছে। অথবা এই খুনগুলোর উদ্দেশ্য সুন্দরবনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয়।” অনির্বাণ বললো। এসপি শংকর রায় শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। “ঠিক আছে। অর্ঘ্য, তুমি অনির্বাণকে সবরকম সাহায্য করবে। যদি সুন্দরবনে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, সেই ব্যবস্থাও করবে। কিন্তু মনে রাখবে, শহরের নিরাপত্তা আমাদের অগ্রাধিকার।” অনির্বাণ আর অর্ঘ্য কক্ষ থেকে বের হলো। অর্ঘ্য অনির্বাণের দিকে তাকালো। “তুমি কি কিছু লুকোচ্ছ অনির্বাণ?” অনির্বাণ চুপ করে রইলো। তার চোখে সেই গভীর শূন্যতা। “কিছু স্মৃতি আছে, অর্ঘ্য। যা আমি বহু বছর আগে চাপা দিয়ে রেখেছি। কিন্তু এই খুনগুলো সেই স্মৃতিগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলছে।” “কোন স্মৃতি? সুন্দরবনের সঙ্গে কি তোমার কোনো ব্যক্তিগত যোগসূত্র আছে?” অর্ঘ্য প্রশ্ন করলো। অনির্বাণ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো। “হ্যাঁ। আমার ছেলেবেলা কেটেছে সুন্দরবনের এক প্রান্তে। আমার বাবা সেখানে এক পুরনো আর্কিওলজিস্ট ছিলেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন সেখানে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সে সব অনেক পুরনো কথা।” অর্ঘ্য বিস্মিত হলো। অনির্বাণ তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কম কথা বলতো। “তোমার কি মনে হচ্ছে, এই খুনগুলো তোমার অতীতের সঙ্গে সম্পর্কিত?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো। অনির্বাণ দূরে তাকিয়ে রইলো। “আমি জানি না। তবে এই ধাঁধাগুলো আমাকে বারবার সেই পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোনো এক গভীর ছায়া আমাকে অনুসরণ করছে, যা আমি এতদিন এড়িয়ে গিয়েছিলাম।”

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion