অনির্বাণ তার ফ্ল্যাটে ফিরে এলো। অর্ঘ্য তাকে আরও কিছু তথ্য দিয়ে গেছে। নিহত ব্যক্তিদের প্রোফাইল, তাদের জীবনযাত্রা, পারস্পরিক সম্পর্ক। আপাতদৃষ্টিতে তাদের মধ্যে কোনো মিল নেই। একজন সরকারি কর্মচারী, একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, আর এখন একজন ব্যবসায়ী। বিভিন্ন বয়স, বিভিন্ন পেশা। কিন্তু তাদের খুনের ধরণ একই।
অনির্বাণ ল্যাপটপে সুন্দরবনের ম্যাপ খুললো। তার জন্মস্থান, সেই ছোট গ্রামটির নাম খুঁজলো। অনেক বছর হয়ে গেছে। গ্রামটির নামও তার মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে, সেখানকার গাছপালা, নদী, আর রাতের বেলার নিস্তব্ধতা। আর কিছু রহস্যময় গল্প, যা তার বাবা তাকে বলতেন।
তার বাবা, ডঃ সুমিত দেবরায়, ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রত্নতত্ত্ববিদ। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি প্রাচীন সভ্যতার কিছু নিদর্শন খুঁজছিলেন। অনির্বাণ তখন খুব ছোট। বাবা তাকে মাঝে মাঝে তার কাজের জায়গায় নিয়ে যেতেন। সেই সময় সে কিছু অদ্ভুত লোকের সঙ্গে মিশেছিল, যারা নিজেদের “নিশীথ প্রহরী” বলতো। তারা কিছু প্রাচীন প্রথা, কিছু মন্ত্র এবং কিছু রহস্যময় আচার পালন করতো। অনির্বাণের মনে পড়লো, তার বাবাও তাদের কিছু রীতিনীতি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই তার বাবার গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়, এবং তারা সুন্দরবন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসে। কারণটা অনির্বাণের স্পষ্ট মনে নেই, শুধু মনে আছে, বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এবং তাদের গ্রাম ছেড়ে আসতে হয়েছিল।
অনির্বাণ পুরনো ডায়েরি খুঁজলো। তার বাবার হাতের লেখা কিছু নোট পাওয়া গেল। সেখানে কিছু অস্পষ্ট ছবি, কিছু প্রতীক এবং কিছু লোককথার অংশ লেখা আছে।
“নিশীথের ছায়া যখন গ্রাসে…” অনির্বাণ সেই ধাঁধার প্রথম লাইনটি মনে মনে আওড়ালো। তার বাবার ডায়েরিতেও এই “নিশীথ” শব্দটির উল্লেখ আছে। এটি কি কোনো গোপন গোষ্ঠীর নাম? নাকি কোনো কাল্পনিক সত্তা?
অনির্বাণ টেবিলের ওপর রাখা একটি পুরনো খবরের কাগজের কাটিং হাতে নিলো। বহু পুরনো কাটিং। একটি পুরনো দুর্ঘটনার খবর। সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে একটি আগুন লেগেছিল। কয়েকজন মারা গিয়েছিল। অনির্বাণ এই খবরটা আগে কখনও দেখেনি। তার বাবা কি এই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন? নাকি এই দুর্ঘটনার সঙ্গে তার বাবার হঠাৎ অসুস্থতার কোনো যোগসূত্র ছিল?
তার মনে পড়লো, দুর্ঘটনার পর পরই তার বাবা খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। কিছু বলতেন না। শুধু রাতের বেলায় স্বপ্ন দেখতেন আর চিৎকার করতেন। অনির্বাণ তখন খুব ছোট, তাই সে সব কিছু বুঝতে পারেনি। এখন এই খুনগুলো তাকে সেই সব অস্পষ্ট স্মৃতিগুলো আবার জাগিয়ে তুলছে।
হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। অর্ঘ্য।
“অনির্বাণ, আমরা একটা নতুন সূত্র পেয়েছি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র কমন ফ্যাক্টর হলো, তারা সবাই গত বছর সুন্দরবনের একটি ট্যুরিস্ট লজে ছিল।” অর্ঘ্য উত্তেজিত কণ্ঠে বললো।
অনির্বাণ চমকে উঠলো। “সুন্দরবন? কোন লজ?”
“রুদ্রপুর ইকো-লজ। আমরা তাদের গেস্ট লিস্ট পেয়েছি। আশ্চর্যজনকভাবে, গত বছর ওই লজে আরও তিনজন ব্যক্তি ছিলেন, যারা এখনও জীবিত।” অর্ঘ্য বললো।
অনির্বাণ দ্রুত একটি কাগজ কলম নিলো। “তাদের নাম কী? আর সেই লজটা রুদ্রপুর গ্রামের কাছাকাছি কি?”
“হ্যাঁ। রুদ্রপুর গ্রামের কাছেই। নামগুলো হলো: রতন দাস, একজন স্কুল শিক্ষক; সুস্মিতা সেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত নার্স; এবং রিকি মুখার্জী, একজন উঠতি ফটোগ্রাফার।” অর্ঘ্য জানালো।
“তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করো, অর্ঘ্য। দ্রুত! আমার মনে হচ্ছে, এই খুনগুলোর সঙ্গে সেই লজের কোনো সম্পর্ক আছে।” অনির্বাণ বললো।
“তুমি কি মনে করছ, খুনি তাদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো।
“সম্ভবত। কিন্তু কেন? তারা কি এমন কিছু করেছিল, যা খুনিকে ক্ষুব্ধ করেছে?” অনির্বাণ প্রশ্ন করলো।
অনির্বাণ ফোনটা রাখলো। তার মনে এক নতুন আশার আলো জ্বললো। রুদ্রপুর! এই গ্রামটির নাম সে শুনেছে। তার বাবার ডায়েরিতেও এই গ্রামের নাম আছে।
অনির্বাণ বুঝতে পারছিল, এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে হলে তাকে সুন্দরবনের রুদ্রপুর গ্রামে ফিরে যেতে হবে। তার নিজের অতীতের মুখোমুখি হতে হবে। সেই সব ছায়ার সঙ্গে লড়তে হবে, যা তাকে এতদিন তাড়া করে বেড়িয়েছে। এই খুনগুলো কেবল কিছু নির্দোষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে না, তারা অনির্বাণের অতীতকেও গ্রাস করতে চাইছে।
অনির্বাণ তার ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো। তাকে রুদ্রপুর যেতে হবে। তার বাবার ডায়েরি, পুরনো খবরের কাগজের কাটিং, আর নিজের স্মৃতি – এই সবকিছু নিয়ে সে এক নতুন অন্ধকারে পা বাড়াবে। নিশীথের ছায়া তার পিছু ধাওয়া করছে। কিন্তু অনির্বাণ এবার প্রস্তুত, এই ছায়ার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion