পরের দিন সকাল। কলকাতা থেকে সুন্দরবনের রুদ্রপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। অনির্বাণ আর অর্ঘ্য একটি ভাড়া করা গাড়িতে চলেছে। শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে পেছনে ফেলে তারা ঢুকছে সবুজের রাজ্যে। দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত, ছোট ছোট গ্রাম, আর মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে মাছের ভেড়ি। কিন্তু অনির্বাণের মন পড়ে আছে সেই পুরনো স্মৃতি আর নতুন রহস্যের জট খুলতে।
“তুমি কি নিশ্চিত যে এই রুদ্রপুর ইকো-লজই আমাদের একমাত্র সূত্র?” অর্ঘ্য স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো।
“আপাতত এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী সূত্র, অর্ঘ্য। নিহত তিনজনেরই ওই লজে থাকার রেকর্ড আছে। আর যে তিনজন বেঁচে আছে, তাদেরও ওই লজেই থাকার কথা।” অনির্বাণ জানালার বাইরে তাকিয়ে বললো। “আমার মনে হচ্ছে, গত বছর ওই লজে এমন কিছু ঘটেছিল, যা এই খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।”
অর্ঘ্য মাথা নাড়লো। “আমরা লজের মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। সে জানিয়েছে, গত বছর তাদের লজে কোনো বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সব স্বাভাবিক ছিল।”
“সাধারণত খুনিরা তাদের শিকারের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক রাখে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে, তাদের সবার একই জায়গায় থাকার ঘটনাটা কাকতালীয় হতে পারে না।” অনির্বাণ বললো। “খুনি হয়তো এমন কিছু জানে, যা অন্যদের অজানা। অথবা সে নিজেই সেই ঘটনার শিকার।”
গাড়িটা এগিয়ে চলেছে। রাস্তার দু’পাশে গাছপালা ক্রমশ ঘন হচ্ছে। বাতাসে একটা আর্দ্রতার গন্ধ। অনির্বাণের মনে পড়লো তার ছেলেবেলার কথা। সুন্দরবনের এই বাতাস, এই গন্ধ – সবই তার খুব পরিচিত। কিন্তু এই পরিচিত পরিবেশেই লুকিয়ে আছে এক অজানা ভয়।
“তুমি কি তোমার গ্রামটা চিনতে পারবে?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো।
অনির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “জানি না। অনেক বছর হয়ে গেছে। গ্রামটা হয়তো আর আগের মতো নেই। তবে রুদ্রপুর আমার গ্রামের খুব কাছেই ছিল।”
তারা দুপুর নাগাদ রুদ্রপুর পৌঁছালো। রুদ্রপুর একটি ছোট গ্রাম। এখানে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও, গ্রামের মূল জীবনযাত্রা এখনও সহজ-সরল। মাটির বাড়ি, ছোট ছোট দোকান, আর দু’পাশে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। গাড়ি থেকে নামতেই অনির্বাণ একটা অন্যরকম শান্তি অনুভব করলো। কিন্তু তার মনের ভেতরের অস্থিরতা কাটলো না।
“আগে লজে যাই, নাকি গ্রামের দিকে যাবো?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো।
“আগে লজে যাই। সেখানকার পরিবেশটা বোঝা দরকার। তারপর গ্রামের দিকে যাবো।” অনির্বাণ বললো।
রুদ্রপুর ইকো-লজ গ্রামের শেষ প্রান্তে, নদীর ধারে অবস্থিত। লজটি দেখতে বেশ সুন্দর। কাঠের তৈরি কটেজ, চারপাশে বাগান। ভেতরে ঢুকতেই একজন রিসেপশনিস্ট তাদের অভ্যর্থনা জানালো।
“আমি ইন্সপেক্টর অর্ঘ্য মিত্র। আর ইনি ডঃ অনির্বাণ দেবরায়। আমরা কলকাতা পুলিশ থেকে এসেছি। আপনাদের লজের গত বছরের কিছু তথ্য দরকার।” অর্ঘ্য তার পরিচয়পত্র দেখালো।
রিসেপশনিস্ট কিছুটা চিন্তিত হলো। “কী ধরনের তথ্য, স্যার?”
“গত বছর এই সময়ে যারা আপনাদের লজে ছিলেন, তাদের গেস্ট লিস্ট আমরা পেয়েছি। আমরা জানতে চাই, তাদের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল কিনা। অথবা কোনো বিশেষ ঘটনা, যা হয়তো আপনাদের নজরে আসেনি।” অনির্বাণ বললো।
রিসেপশনিস্ট লজের মালিককে ডাকলো। মালিক একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক, নাম সুজিত বাবু। তিনি বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিলেন।
“পুলিশ? কী হয়েছে স্যার?” সুজিত বাবু জিজ্ঞেস করলেন।
অর্ঘ্য সংক্ষেপে খুনের ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করলো। সুজিত বাবু শুনেই চমকে উঠলেন।
“বিশ্বাস করুন স্যার, আমাদের লজে গত বছর এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সব গেস্টই খুব ভালো ছিলেন। কোনো ঝামেলা হয়নি।” সুজিত বাবু বললেন।
“আপনারা কি নিশ্চিত? কোনো ছোটখাটো ঝগড়া, বা কোনো অতিথির অস্বাভাবিক আচরণ?” অনির্বাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
সুজিত বাবু অনেকক্ষণ ভাবলেন। “না স্যার। তেমন কিছু মনে পড়ছে না। তবে… একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।”
অনির্বাণ আর অর্ঘ্য দুজনেই নড়েচড়ে বসলো। “কী ঘটনা?”
“গত বছর এই সময়ে, লজের পাশে যে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল আছে, সেখানে একদিন রাতে একটা আগুন লেগেছিল। ছোট আগুন। আমরা দ্রুত নিভিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু আগুনটা কীভাবে লেগেছিল, তা আমরা বুঝতে পারিনি।” সুজিত বাবু বললেন।
অনির্বাণ চমকে উঠলো। আগুন! তার বাবার ডায়েরিতেও আগুনের ঘটনার উল্লেখ ছিল। আর সেই পুরনো খবরের কাগজের কাটিং।
“আগুনটা কখন লেগেছিল? আর সেই সময় লজে কারা কারা ছিলেন?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো।
“আগুনটা লেগেছিল রাত প্রায় বারোটা নাগাদ। আর সেই সময় লজে প্রায় দশ-বারোজন গেস্ট ছিলেন। আপনারা যে নামগুলো বলছেন, তারা সবাই ছিলেন।” সুজিত বাবু বললেন।
অনির্বাণ অর্ঘ্যর দিকে তাকালো। “অর্ঘ্য, এই আগুনটা গুরুত্বপূর্ণ।”
অর্ঘ্য সুজিত বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে লজের গেস্ট লিস্টের একটি কপি নিলো।
“আমরা লজের আশপাশটা একটু দেখতে চাই।” অনির্বাণ বললো।
সুজিত বাবু তাদের পথ দেখালেন। লজের পেছনেই ম্যানগ্রোভের জঙ্গল শুরু হয়েছে। সেই জায়গাটা এখনও কিছুটা পোড়া দেখাচ্ছে। অনির্বাণ সেই পোড়া জায়গায় হাঁটতে শুরু করলো। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো পুরনো রহস্যের গভীরে প্রবেশ করছে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion