ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। কাঁদা মাটির গন্ধ, নোনা জলের ছোঁয়া। অনির্বাণের মনে পড়লো তার ছেলেবেলার স্মৃতি। এই জঙ্গল তার কাছে পরিচিত। সে ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এখানে আসতো। বাবা তাকে বিভিন্ন গাছের নাম বলতেন, জঙ্গলের রহস্যময় গল্প শোনাতেন।
“অনির্বাণ, তুমি কিছু খুঁজে পাচ্ছ?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো।
অনির্বাণ পোড়া জায়গাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কিছু শুকনো পাতা, কিছু পোড়া কাঠ। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল একটা জায়গায়। মাটির ওপর একটা অদ্ভুত চিহ্ন। একটা বৃত্তের মধ্যে কিছু অস্পষ্ট রেখা।
“এটা কী?” অর্ঘ্য চিহ্নটা দেখে বললো।
“এটা কোনো সাধারণ চিহ্ন নয়। এটা কোনো প্রাচীন প্রতীক হতে পারে। আমার বাবার ডায়েরিতে এই ধরনের কিছু প্রতীকের উল্লেখ ছিল।” অনির্বাণ চিহ্নটার দিকে ঝুঁকে বসলো।
তার মনে পড়লো, তার বাবা “নিশীথ প্রহরী” গোষ্ঠীর কিছু প্রাচীন আচারের কথা বলতেন। সেই আচারগুলোতে এই ধরনের প্রতীক ব্যবহার করা হতো। এই প্রতীকগুলো বিশেষ কোনো অর্থ বহন করতো।
“তুমি কি মনে করছ, এই আগুনটা কোনো আচারের অংশ ছিল?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো।
“সম্ভবত। অথবা এই আগুন লাগার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল। হয়তো কিছু লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।” অনির্বাণ বললো।
তারা আরও কিছুক্ষণ জঙ্গলে ঘুরলো। কিন্তু আর কোনো বিশেষ সূত্র পেলো না। অনির্বাণ সিদ্ধান্ত নিলো, তাদের এবার গ্রামের দিকে যেতে হবে। গ্রামের পুরনো মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। হয়তো তারা এই আগুন বা এই প্রতীক সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে।
রুদ্রপুর গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই অনির্বাণের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। গ্রামটা অনেকটা আগের মতোই আছে। সেই পুরনো পুকুর, সেই পুরনো বটগাছ। তার মনে পড়লো, এই বটগাছের নিচেই সে ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলতো।
তারা গ্রামের মোড়ে একটি চায়ের দোকানে বসলো। গ্রামের কিছু বৃদ্ধ মানুষ সেখানে বসে গল্প করছিল। অর্ঘ্য তাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলো।
“দাদু, আপনারা কি গত বছর লজের পাশে আগুন লাগার ঘটনাটা মনে করতে পারছেন?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো।
একজন বৃদ্ধ, যার নাম হরিচরণ, মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ বাবা। মনে আছে। রাতবিরেতে আগুন লেগেছিল। আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম।”
“আপনারা কি জানেন, আগুনটা কীভাবে লেগেছিল?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো।
হরিচরণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আমরা তো জানি না বাবা। তবে গ্রামের কিছু লোক বলছিল, ওটা নাকি নিশীথের অভিশাপ।”
“নিশীথের অভিশাপ?” অর্ঘ্য বিস্মিত হলো।
“হ্যাঁ বাবা। আমাদের গ্রামে একটা পুরনো বিশ্বাস আছে। নিশীথ হলো এক অদৃশ্য শক্তি। যখন কেউ প্রকৃতিকে অসম্মান করে, তখন নিশীথ তার উপর অভিশাপ দেয়।” হরিচরণ বললেন।
অনির্বাণ হরিচরণের দিকে তাকালো। “আপনারা কি ‘নিশীথ প্রহরী’ বলে কোনো গোষ্ঠীর কথা শুনেছেন?”
হরিচরণ চমকে উঠলেন। তার চোখে এক অদ্ভুত ভয় ফুটে উঠলো। “তুমি এই নামটা কোথায় শুনলে বাবা?”
“আমার বাবা একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ ছিলেন। তিনি এই অঞ্চলে কাজ করতেন। তিনি এই গোষ্ঠীর কথা বলতেন।” অনির্বাণ বললো।
হরিচরণ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “নিশীথ প্রহরী… তারা এখন আর নেই বাবা। অনেক বছর আগে তারা সব অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারা প্রকৃতির রক্ষক ছিল। কিন্তু কিছু মানুষ তাদের বিশ্বাসকে অসম্মান করেছিল। তারপর থেকে তারা আর নেই।”
“তারা কি এই আগুন লাগার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো।
হরিচরণ মাথা নাড়লেন। “জানি না বাবা। তবে নিশীথ প্রহরী থাকলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটতো না।”
অনির্বাণ বুঝতে পারছিল, এই “নিশীথ প্রহরী” গোষ্ঠী এবং “নিশীথের অভিশাপ” এই রহস্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার বাবার ডায়েরিতেও এই বিষয়গুলো উল্লেখ ছিল।
তারা আরও কিছু গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বললো। কিন্তু কেউ সরাসরি কিছু বলতে চাইছিল না। তাদের চোখে এক অদ্ভুত ভয়। অনির্বাণ বুঝতে পারছিল, এই গ্রামে এমন কিছু চাপা পড়ে আছে, যা কেউ প্রকাশ করতে চাইছে না।
সন্ধ্যা নেমে এলো। সুন্দরবনের আকাশে এক অদ্ভুত লাল আভা। অনির্বাণ আর অর্ঘ্য আবার লজে ফিরে এলো।
“অনির্বাণ, তুমি কি মনে করছ, এই নিশীথের অভিশাপের সঙ্গে খুনের কোনো সম্পর্ক আছে?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো।
“আমি জানি না, অর্ঘ্য। তবে এই খুনগুলো সাধারণ নয়। এর পেছনে একটা গভীর বিশ্বাস, একটা পুরনো প্রথা কাজ করছে। আর এই আগুন লাগার ঘটনাটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।” অনির্বাণ বললো।
অনির্বাণ তার ল্যাপটপ খুললো। তার বাবার ডায়েরি থেকে সেই পুরনো ধাঁধাটা আবার দেখলো:
“নিশীথের ছায়া যখন গ্রাসে,
পুরনো পাপের হিসেব কষে।
জলের গভীরে লুকানো বীজ,
ফিরে আসে সে, ভাঙতে সব বাঁধ।
আঁধারের মন্ত্রে, রক্তের রেখা,
মুক্তির পথে, এক নতুন লেখা।
একবার যে পথ হারায়,
ফিরে সে পায় তার অন্তরায়।”
অনির্বাণ বুঝতে পারছিল, এই ধাঁধাগুলো কেবল কিছু শব্দ নয়। এগুলো এক গভীর সত্যের ইঙ্গিত। “জলের গভীরে লুকানো বীজ” – এই লাইনটা তাকে ভাবিয়ে তুলছিল। এটা কি কোনো ঘটনার ইঙ্গিত?
অনির্বাণ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, সে এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করবে। তার বাবার ফেলে আসা কাজ, এই গ্রামের চাপা পড়া ইতিহাস, আর এই খুনের রহস্য – সবকিছুর জট তাকে খুলতে হবে। নিশীথের ছায়া তাকে তাড়া করে ফিরছে, কিন্তু অনির্বাণ এবার প্রস্তুত, এই ছায়ার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion