রুদ্রপুর ইকো-লজে ফিরে এসেও অনির্বাণের মন শান্ত হলো না। হরিচরণের কথাগুলো তার কানে বাজছে – “নিশীথের অভিশাপ”, “নিশীথ প্রহরী”। তার বাবার ডায়েরিটা আবার বের করলো। প্রতিটি পৃষ্ঠা খুঁটিয়ে দেখলো। পুরনো কিছু আঁকা ছবি, অস্পষ্ট নোট, কিছু গাছপালা আর প্রাণীর স্কেচ। একটি পৃষ্ঠায় তার নজর পড়লো একটি প্রাচীন ভাষার কিছু চিহ্নের ওপর। নিচে তার বাবার হাতে লেখা: “নিশীথের মন্ত্র – প্রকৃতি ও আত্মাকে জাগানোর গান।”
অনির্বাণ অর্ঘ্যকে ডাকলো। “অর্ঘ্য, আমার বাবার এই নোটগুলো দেখো। এখানে কিছু প্রতীক আছে, যা আমরা জঙ্গলে দেখেছি। আর এই মন্ত্রের কথা লেখা আছে।”
অর্ঘ্য ছবিগুলো দেখে মাথা নাড়লো। “এগুলো কি কোনো আদিবাসী ভাষার অংশ?”
“সম্ভবত। আমার বাবা এসব নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই মন্ত্রগুলোর মধ্যে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক গভীর যোগসূত্র লুকিয়ে আছে।” অনির্বাণ বললো। “কিন্তু এর মধ্যে ‘নিশীথের অভিশাপ’ বলে কিছু নেই। নিশীথ প্রহরী ছিল প্রকৃতির রক্ষক, ধ্বংসকারী নয়।”
“তাহলে খুনি কেন এই অভিশাপের কথা বলছে? সে কি এসবের ভুল ব্যাখ্যা করছে?” অর্ঘ্য প্রশ্ন করলো।
“অথবা সে এমন কিছু জানে, যা আমাদের অজানা। এই খুনগুলো হয়তো কোনো ব্যক্তিগত প্রতিশোধের অংশ, যা এই প্রাচীন বিশ্বাসগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।” অনির্বাণ বললো। “আমাদের সেই তিনজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে, যারা লজের ওই ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল।”
অর্ঘ্য পরদিন সকালেই রতন দাস, সুস্মিতা সেন এবং রিকি মুখার্জীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলো। রতন দাস, স্কুল শিক্ষক, থাকতেন কলকাতার কাছাকাছি এক মফস্সল শহরে। সুস্মিতা সেন, অবসরপ্রাপ্ত নার্স, থাকতেন সল্টলেকে। আর রিকি মুখার্জী, ফটোগ্রাফার, কলকাতার এক আর্ট গ্যালারিতে কাজ করতেন।
প্রথমেই তারা রতন দাসের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলো। তিনি ছিলেন বয়স্ক, তাই তার কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া সহজ হতে পারে।
পরদিন সকালে তারা রুদ্রপুর থেকে বেরিয়ে রতন দাসের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। দীর্ঘ পথ। অনির্বাণ জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবছিল। এই রহস্যের জাল ক্রমশ জটিল হচ্ছে। প্রতিটি সূত্র নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
রতন দাসের বাড়িতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। তিনি একজন সাদাসিধা মানুষ। অনির্বাণ আর অর্ঘ্যকে দেখে তিনি কিছুটা অবাক হলেন।
“স্যার, গত বছর রুদ্রপুর ইকো-লজে একটা আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল। আপনি কি সেই সময় লজে ছিলেন?” অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করলো।
রতন দাস মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ। আমি ছিলাম। রাতে হঠাৎ আগুন লেগেছিল। আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“আপনি কি বলতে পারেন, আগুনটা কীভাবে লেগেছিল? বা কোনো সন্দেহজনক কিছু আপনার চোখে পড়েছিল?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো।
রতন দাস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। “আসলে সেদিন রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ চিৎকার শুনে উঠেছিলাম। যখন বাইরে এসেছিলাম, তখন আগুন জ্বলছিল। পরে লজের কর্মচারীরা আগুন নিভিয়েছিল।”
“লজের অন্যান্য অতিথিরা কী করছিল?” অর্ঘ্য জানতে চাইলো।
“সবাই আতঙ্কিত ছিল। কিছু লোক আগুন নিভানোর চেষ্টা করছিল। কিছু লোক ভয় পেয়ে কটেজের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।” রতন দাস বললেন।
“আপনারা কি ওই রাতে কোনো অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিলেন?” অনির্বাণ শেষ চেষ্টা করলো।
রতন দাস তার চশমাটা ঠিক করে বললেন, “অস্বাভাবিক? হ্যাঁ… একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে আমি আমার কটেজের ব্যালকনিতে বসে বই পড়ছিলাম। তখন দেখলাম, লজের পেছনের দিক থেকে একজন লোক দ্রুত হেঁটে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। তার হাতে একটা থলে মতো কিছু ছিল। অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাইনি।”
অনির্বাণ আর অর্ঘ্য দুজনেই নড়েচড়ে বসলো। “আপনি কি নিশ্চিত? লোকটা কে ছিল?”
“না বাবা। চিনতে পারিনি। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তার হাঁটার ধরণটা যেন খুব চেনা লাগছিল, মনে করতে পারছি না কার মতো।” রতন দাস বললেন। “তবে তার পরনের পোশাকটা কেমন যেন ময়লা, বা নোংরা ছিল। ট্যুরিস্টদের মতো পোশাক ছিল না।”
“তার উচ্চতা বা শারীরিক গঠন সম্পর্কে কিছু মনে পড়ছে?” অর্ঘ্য জানতে চাইলো।
“খুব লম্বা ছিল না। মোটামুটি উচ্চতার। রোগা বা মোটা কোনোটাই মনে হয়নি।” রতন দাস বললেন।
অনির্বাণ রতন দাসের কথাগুলো টুকে নিলো। একজন রহস্যময় ব্যক্তি, যে আগুন লাগার ঠিক আগে ঘটনাস্থল থেকে সরে গিয়েছিল। এটাই তাদের প্রথম বড় সূত্র।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion