শঙ্করের মৃত্যুর ফাইলগুলো খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে অরুণিমা এবং বিক্রম সিং কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেলেন। শঙ্করের মৃতদেহ যেখানে পাওয়া গিয়েছিল, সেই খাদটি ছিল অত্যন্ত দুর্গম। উদ্ধারকারী দল অনেক কষ্টে তার দেহ উদ্ধার করেছিল, কিন্তু দেহটি এতটাই বিকৃত ছিল যে তার মুখমণ্ডল চেনা যাচ্ছিল না। শুধুমাত্র তার পোশাক এবং একটি হাতে বাঁধা তাবিজ দেখে তার পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই তাবিজের উপরও একটি অদ্ভুত চিহ্ন ছিল, যা গদ্দি উপজাতির ‘মৃত্যুর পাঞ্জা’র মতো দেখতে।
“ইনস্পেক্টর, এই তাবিজটা কি ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছিল?” অরুণিমা প্রশ্ন করল।
বিক্রম সিং পুরনো রিপোর্টগুলো ঘেঁটে দেখলেন। “হ্যাঁ, ম্যাম। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। তাবিজটা সাধারণ ধাতু দিয়ে তৈরি ছিল।”
“কিন্তু এই চিহ্নটা? এটা কি শঙ্করের নিজের হাতে আঁকা ছিল?” অরুণিমা তার ল্যাপটপে শঙ্করের ডায়েরির শেষ পাতাটা খুলল, যেখানে সেই একই চিহ্ন আঁকা ছিল।
“হতে পারে। শঙ্কর এই ধরনের প্রতীক পছন্দ করত।” বিক্রম সিং বললেন।
অরুণিমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধছিল। যদি শঙ্কর মারা না গিয়ে থাকে, তাহলে তার জায়গায় কার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল? এবং কে এই তাবিজ রেখেছিল? এটা কি খুনি তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য করেছিল?
তারা শঙ্করের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। রঘুনাথের স্ত্রী, শঙ্করের মা, বহু বছর আগেই মারা গেছেন। তার কোনো ভাইবোন ছিল না। রঘুনাথও মারা গেছেন। শঙ্করের একমাত্র জীবিত আত্মীয় ছিলেন তার মামা, যিনি এখন সিমলায় থাকেন।
অরুণিমা এবং বিক্রম সিং সিমলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পথ ছিল আঁকাবাঁকা, পাহাড়ি রাস্তা ধরে তাদের জিপ এগিয়ে যাচ্ছিল। অরুণিমার মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক অদৃশ্য শত্রুর পিছু ধাওয়া করছে, যে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ আগে থেকেই জানে।
সিমলায় শঙ্করের মামা, বৃদ্ধ রঘুরামের সাথে দেখা করলেন তারা। রঘুরাম একজন শান্ত প্রকৃতির মানুষ। শঙ্করের কথা উঠতেই তার চোখ ছলছল করে উঠল।
“শঙ্কর খুব ভালো ছেলে ছিল, ইনস্পেক্টর। প্রকৃতির প্রতি তার খুব টান ছিল। তার বাবা যখন অতিরিক্ত শিকার করত, তখন শঙ্কর খুব কষ্ট পেত।” রঘুরাম বললেন।
“শঙ্করের মৃতদেহ যখন পাওয়া গিয়েছিল, তখন কি আপনি তাকে চিনতে পেরেছিলেন?” অরুণিমা প্রশ্ন করল।
রঘুরাম মাথা নাড়লেন। “না, ম্যাম। দেহটা এতটাই বিকৃত ছিল যে চেনা যাচ্ছিল না। শুধু তার পোশাক আর হাতের তাবিজ দেখে আমরা তাকে শঙ্কর বলে ধরে নিয়েছিলাম। সেই তাবিজটা আমিই তাকে দিয়েছিলাম, যখন সে ছোট ছিল।”
অরুণিমা তাবিজের ছবিটা রঘুরামকে দেখাল। “এই চিহ্নটা কি আপনি চিনতে পারছেন?”
রঘুরাম মনোযোগ দিয়ে চিহ্নটা দেখলেন। “হ্যাঁ। এটা আমাদের পারিবারিক প্রতীক। বহু বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই চিহ্ন ব্যবহার করত। এর অর্থ হলো, ‘প্রকৃতির রক্ষক’।”
অরুণিমা চমকে উঠল। ধর্মপাল এই চিহ্নকে ‘মৃত্যুর পাঞ্জা’ বলেছিলেন, কিন্তু রঘুরাম বলছেন ‘প্রকৃতির রক্ষক’। তাহলে কি এই প্রতীকের দুটি ভিন্ন অর্থ আছে, অথবা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এর অর্থ বিকৃত করেছে?
“শঙ্করের মৃত্যুর পর কি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল?” বিক্রম সিং প্রশ্ন করলেন।
রঘুরাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। “হ্যাঁ। শঙ্করের মৃত্যুর পর, তার বাবা রঘুনাথ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি প্রায়ই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতেন, যেন শঙ্কর তাকে প্রকৃতির প্রতিশোধের কথা বলছে। তারপর তিনি মারা যান।”
“আর কালীচরণ?” অরুণিমা প্রশ্ন করল। “শঙ্করের সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল?”
রঘুরাম বললেন, “কালীচরণ মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসত। সে শঙ্করের সাথে প্রকৃতির নিয়ম এবং প্রাচীন প্রথা নিয়ে কথা বলত। শঙ্কর কালীচরণকে খুব শ্রদ্ধা করত।”
অরুণিমা বুঝতে পারল, কালীচরণই শঙ্করের মনকে প্রভাবিত করেছিল। সে হয়তো শঙ্করকে প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিল। কিন্তু শঙ্কর যদি বেঁচে থাকে, তাহলে কালীচরণ কি তার সহযোগী?
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion