সিমলা থেকে কুল্লুতে ফেরার পথে অরুণিমা অনুভব করল, তার ব্যক্তিগত জীবনেও যেন এই রহস্যের ছায়া পড়ছে। তার ফোন বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে একটি নিচু, চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, যা শুনে তার গা শিউরে উঠল।
“তুমি খুব গভীরে প্রবেশ করছো, গোয়েন্দা। এই খেলা তোমার জন্য নয়। ফিরে যাও।”
কণ্ঠস্বরটি ছিল বিকৃত, যেন কেউ তার গলা চেপে ধরে কথা বলছে। অরুণিমা কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল।
অরুণিমা বিক্রম সিংকে ঘটনাটা জানাল। বিক্রম সিং চিন্তিত হলেন। “ম্যাম, খুনি আপনার উপর নজর রাখছে। আপনাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে।”
অরুণিমা জানত, এই হুমকি তাকে থামিয়ে দিতে পারবে না। বরং তার জেদ আরও বাড়িয়ে দিল। খুনি যত ভয় দেখাবে, সে তত গভীরে প্রবেশ করবে।
রাতে হোটেলের ঘরে ফিরে অরুণিমা তার ল্যাপটপে শঙ্করের ডায়েরিটা আবার দেখছিল। শেষ পাতায় আঁকা সেই প্রতীক, ‘প্রকৃতির রক্ষক’। আর তার নিচে লেখা, “প্রকৃতি একদিন প্রতিশোধ নেবে।”
অরুণিমার মনে হলো, শঙ্কর হয়তো মারা যায়নি, কিন্তু সে হয়তো নিজেকে প্রকৃতির প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করেছে। তার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি হয়তো কোনো গভীর পরিকল্পনার অংশ।
হঠাৎই তার দরজায় টোকা পড়ল। অরুণিমা চমকে উঠল। এত রাতে কে হতে পারে? সে সতর্কভাবে দরজার কাছে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিল। কেউ নেই। কিন্তু দরজার নিচে একটি ছোট কাগজের টুকরো পড়ে আছে। অরুণিমা কাগজটা তুলে নিল। তাতে হাতে লেখা ছিল, “তোমার অতীত তোমাকে তাড়া করবে।”
অরুণিমার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল। তার অতীত। কলকাতার সেই কেসটা। যেখানে সে একজন সিরিয়াল কিলারকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল, যার ফলে তার এক সহকর্মী মারা গিয়েছিল। সেই ঘটনা অরুণিমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। খুনি কি তার এই দুর্বলতা সম্পর্কে জানে?
অরুণিমা বুঝতে পারল, এই খুনি শুধু শিকারিদের খুন করছে না, সে অরুণিমাকে মানসিকভাবে আঘাত করার চেষ্টা করছে। সে তার দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করেছে। এই কেসটা এখন তার ব্যক্তিগত প্রতিশোধের মতো হয়ে উঠেছে।
পরের দিন সকালে প্রীতি শর্মার ফোন এল। তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা।
“ম্যাম, আমি ত্রিশূলটা পরীক্ষা করেছি। তাতে যে চিহ্নগুলো খোদাই করা আছে, সেগুলো শুধু প্রতীক নয়, ওগুলো আসলে প্রাচীন গদ্দি ভাষার কিছু অক্ষর। আমি একজন স্থানীয় ভাষাবিদকে দিয়ে এর অর্থ উদ্ধার করেছি।”
“কী অর্থ?” অরুণিমা অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল।
“এর অর্থ হলো, ‘পবিত্র গুহার রক্ষক’। আর কাপড়ের টুকরো থেকে যে ভেষজের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল, সেটা ‘মৃত্যু ভেষজ’ নামে পরিচিত। এটা স্নায়ুতন্ত্রকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত শ্বাসরোধ করে মৃত্যু ঘটায়। খুনি এই ভেষজ ব্যবহার করে শিকারিদের দুর্বল করত, তারপর তাদের খুন করত।”
অরুণিমা স্তম্ভিত হয়ে গেল। ‘পবিত্র গুহার রক্ষক’। তাহলে কি শঙ্কর সেই পবিত্র গুহার রক্ষক? আর এই ভেষজ… খুনি কতটা ঠান্ডা মাথায় কাজ করছে!
“আর সুশীল থাপার মৃতদেহের পাশে যে কাঠের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, তার ভেতরে যে ধাতব টুকরো ছিল, তাতেও একই ধরনের লেখা আছে।” প্রীতি শর্মা যোগ করলেন। “তার অর্থ হলো, ‘শিকারির পাপের শাস্তি’।”
অরুণিমা বুঝতে পারল, খুনি প্রতিটি খুনের সাথে একটি বার্তা দিচ্ছে। সে নিজেকে প্রকৃতির রক্ষক মনে করছে, এবং শিকারিদের তাদের পাপের জন্য শাস্তি দিচ্ছে।
অরুণিমা এবং বিক্রম সিং এবার সেই পবিত্র গুহার সন্ধানে বের হলেন, যেখানে ধর্মপাল বলেছিলেন, বহু বছর আগে শিকারিরা প্রবেশ করেছিল এবং দেবীর অভিশাপ কুড়িয়েছিল। ধর্মপাল গুহাটির সঠিক অবস্থান বলতে পারেননি, কারণ সেটি খুব গোপন ছিল। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, গুহাটি একটি প্রাচীন ঝর্ণার কাছে অবস্থিত, যেখানে একটি বিশেষ ধরনের ফুল ফোটে। সেই ফুলগুলোই রতন সিংয়ের মৃতদেহের পাশে পাওয়া গিয়েছিল।
তারা প্রীতি শর্মার দেওয়া ফুলের নমুনা নিয়ে সেই ঝর্ণার সন্ধানে বের হলেন। পথ ছিল আরও দুর্গম, ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছিল। অরুণিমার মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক প্রাচীন রহস্যের গভীরে প্রবেশ করছে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই বিপজ্জনক।
হঠাৎই বিক্রম সিংয়ের ফোন বেজে উঠল। একজন স্থানীয় গ্রামবাসী ফোন করে জানাল, তাদের গ্রামের একজন শিকারি নিখোঁজ হয়েছে। পঞ্চম খুন। খুনি যেন তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে, এবং তাদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে।
অরুণিমার মনে এক নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। খুনি তাদের কাছাকাছিই আছে। সে তাদের দুর্বলতা জানে, এবং সে তাদের চ্যালেঞ্জ করছে। হিমাচলের হিমশীতল অভিশাপের রহস্য এখন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অরুণিমা জানত, এই কেসটা তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হতে চলেছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion