Episode 12637 words0 views

দ্বাদশ পর্ব : পবিত্র গুহার গভীরে

পঞ্চম শিকারির নিখোঁজ হওয়ার খবর অরুণিমা এবং বিক্রম সিংকে আরও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করল। তারা জানত, খুনি তাদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে। ঝর্ণার দিকে তাদের যাত্রা আরও ত্বরান্বিত হলো। ঘন জঙ্গল, পাথুরে পথ, আর হিমেল বাতাস তাদের পথচলাকে আরও কঠিন করে তুলছিল। অরুণিমার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি গাছের আড়ালে যেন খুনি লুকিয়ে আছে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে। অবশেষে তারা সেই ঝর্ণার কাছে পৌঁছালেন। ঝর্ণার জল পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল, তার শব্দ যেন এক রহস্যময় সুর তৈরি করছিল। ঝর্ণার চারপাশে সেই অদ্ভুত ফুলগুলো ফুটে ছিল, যা প্রীতি শর্মা বিষাক্ত বলে চিহ্নিত করেছিলেন। অরুণিমা ফুলের গন্ধ শুঁকে দেখল, তাতে এক ধরনের মিষ্টি কিন্তু তীব্র মাদকতা ছিল। ঝর্ণার পাশেই, একটি বড় পাথরের আড়ালে, পঞ্চম শিকারি, রাম সিংয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেল। রাম সিং একজন তরুণ শিকারি ছিল, যে সম্প্রতি তার বাবার সাথে শিকার শুরু করেছিল। তার দেহও আগের শিকারিদের মতোই ক্ষতবিক্ষত ছিল, গলায় সেই ‘মৃত্যুর পাঞ্জা’র চিহ্ন, আর বুকের উপর সেই কালো ‘আত্মার পাথর’। কিন্তু এবার আরও একটি নতুন প্রতীক ছিল। রাম সিংয়ের বুকে একটি ছোট, সাদা কাপড়ের টুকরো পিন দিয়ে আটকানো ছিল, তাতে একটি গাছের ছবি আঁকা ছিল, যার ডালপালাগুলো ভাঙা। অরুণিমা এই প্রতীকটা দেখে চমকে উঠল। ধর্মপালের বইয়ে এই প্রতীকটা ছিল না। এটা কি খুনি নিজেই তৈরি করেছে, নাকি এর পেছনে আরও কোনো গভীর অর্থ আছে? প্রীতি শর্মা ঘটনাস্থলে এসে মৃতদেহ পরীক্ষা করলেন। “আঘাতগুলো আগের মতোই সুনির্দিষ্ট। আর এই কাপড়ের টুকরো… এটা নতুন। ভাঙা গাছের ডালপালা… এটা কি প্রকৃতির ধ্বংসের প্রতীক?” অরুণিমা মাথা নাড়ল। “হতে পারে। কিন্তু কেন এই প্রতীক? আর রাম সিং কেন?” বিক্রম সিং বললেন, “রাম সিংয়ের বাবাও রঘুনাথের দলের একজন শিকারি ছিলেন। তিনি বহু বছর ধরে অবৈধ শিকার করছেন।” অরুণিমা বুঝতে পারল, খুনি শুধু রঘুনাথের দলের সদস্যদেরই নয়, তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও টার্গেট করছে। খুনি যেন প্রকৃতির প্রতিশোধের ধারাকে অব্যাহত রাখতে চাইছে। ঝর্ণার পাশেই একটি ছোট গুহার মুখ দেখা যাচ্ছিল। গুহার মুখে কিছু প্রাচীন পাথর স্তূপ করে রাখা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল এটি একটি গোপন প্রবেশপথ। অরুণিমা বুঝতে পারল, এটাই সেই পবিত্র গুহা, যার কথা ধর্মপাল বলেছিলেন। তারা সতর্কভাবে গুহার ভেতরে প্রবেশ করল। গুহাটি ছিল অন্ধকার এবং স্যাঁতসেঁতে। ভেতরে প্রবেশ করতেই এক অদ্ভুত ঠান্ডা বাতাস তাদের স্বাগত জানাল। গুহার ভেতরের দেওয়ালে প্রাচীন চিত্রকর্ম দেখা যাচ্ছিল, যা গদ্দি উপজাতির জীবনযাত্রা এবং তাদের শিকারের দৃশ্য তুলে ধরছিল। কিন্তু তার মাঝে কিছু অদ্ভুত প্রতীকও ছিল, যা ‘প্রকৃতির রক্ষক’ এবং ‘মৃত্যুর পাঞ্জা’র মতো দেখতে। গুহার গভীরে প্রবেশ করতেই তারা একটি বড় কক্ষের সামনে পৌঁছালেন। কক্ষটি ছিল বিশাল, তার মাঝখানে একটি পাথরের বেদি। বেদির উপর একটি প্রাচীন দেবীর মূর্তি রাখা ছিল। মূর্তিটি ছিল পাথরের তৈরি, তার মুখমণ্ডল ছিল শান্ত কিন্তু চোখে এক ধরনের দৃঢ়তা। দেবীর হাতে একটি ত্রিশূল ছিল, যা কালীচরণের গুহায় পাওয়া ত্রিশূলের মতোই দেখতে। “এই দেবীই কি সেই দেবী, যার অভিশাপের কথা ধর্মপাল বলেছিলেন?” বিক্রম সিং প্রশ্ন করলেন। অরুণিমা মাথা নাড়ল। “হতে পারে। এই গুহাটিই সেই পবিত্র গুহা, যেখানে শিকারিরা প্রবেশ করেছিল।” বেদির চারপাশে কিছু শুকনো ফুল, ধূপের ছাই এবং কিছু ছোট হাড় ছড়িয়ে ছিল। অরুণিমা দেখল, বেদির একপাশে একটি ছোট কাঠের সিন্দুক রাখা আছে। সিন্দুকটি পুরনো, তার গায়ে ধুলোর আস্তরণ। অরুণিমা সতর্কভাবে সিন্দুকটি খুলল। ভেতরে কিছু পুরনো পোশাক, কিছু শুকনো ভেষজ এবং একটি ছোট চামড়ার ব্যাগ। চামড়ার ব্যাগের ভেতরে কিছু পুরনো মুদ্রা এবং একটি ছোট ডায়েরি। ডায়েরিটি ছিল শঙ্করের। তার হাতে লেখা। অরুণিমা ডায়েরিটি হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করল। ডায়েরির পাতাগুলো হলদে হয়ে গেছে, তার ভেতরে লেখা ছিল শঙ্করের জীবনের শেষ দিনগুলোর কথা। শঙ্কর লিখেছিল, কীভাবে তার বাবা রঘুনাথ এবং তার দলের শিকারিরা প্রকৃতির ক্ষতি করছিল। সে লিখেছিল, কীভাবে সে প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসার জন্য কষ্ট পেত। ডায়েরির একটি পাতায় শঙ্কর লিখেছিল, “আমি প্রকৃতির প্রতিশোধ নেব। যারা তার ক্ষতি করেছে, তাদের শাস্তি পেতে হবে। আমি নিজেকে এই পবিত্র গুহার রক্ষক হিসেবে উৎসর্গ করব।” অরুণিমা চমকে উঠল। তাহলে শঙ্করই ‘পবিত্র গুহার রক্ষক’। সে মারা যায়নি। সে নিজেকে প্রকৃতির প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করেছে। ডায়েরির শেষ পাতায় শঙ্কর লিখেছিল, “কালীচরণ আমাকে পথ দেখিয়েছে। সে আমাকে প্রকৃতির নিয়ম শিখিয়েছে। আমি তার নির্দেশ মেনে চলব।” অরুণিমা বুঝতে পারল, কালীচরণই শঙ্করের গুরু। সে শঙ্করকে এই প্রতিশোধের পথে চালিত করেছে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion