পরের দিন সকালে অরুণিমা এবং ইনস্পেক্টর বিক্রম সিং প্রথম ঘটনাস্থল, অর্থাৎ ‘ভূত ভ্যালি’র উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কুল্লু থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ, তারপর আরও এক ঘণ্টা দুর্গম পাহাড়ি পথে হেঁটে যেতে হবে। পথ যতই এগোচ্ছিল, জনবসতি ততই কমে আসছিল। চারপাশে ঘন পাইন আর দেবদারু গাছের জঙ্গল, সূর্যের আলোও ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না। হিমেল বাতাস আরও তীব্র হয়ে উঠছিল, যেন প্রকৃতির প্রতিটি কণায় এক চাপা রহস্য লুকিয়ে আছে।
“এই জায়গাটা দিনের বেলাতেও খুব একটা নিরাপদ নয়, ম্যাম,” বিক্রম সিং বললেন। “গ্রামের মানুষজন এখানে আসতে ভয় পায়। তাদের বিশ্বাস, এখানে মন্দ আত্মারা ঘুরে বেড়ায়।”
অরুণিমা তার চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সত্যিই, জায়গাটার একটা অদ্ভুত গাম্ভীর্য আছে। নীরবতা এতটাই গভীর যে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শোনা যায়। নবীন থাপার মৃতদেহ যে দেবদারু গাছের নিচে পাওয়া গিয়েছিল, সেই গাছটা ছিল বিশাল, তার ডালপালাগুলো যেন আকাশের দিকে অভিশাপের মতো ছড়িয়ে আছে।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে অরুণিমা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। মাটি তখনও ভেজা, যদিও বৃষ্টি হয়নি। গাছের নিচে কিছু শুকনো পাতা আর ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অরুণিমা হাঁটু গেড়ে বসে মাটির দিকে তাকাল। “ইনস্পেক্টর, এখানে কি কোনো পায়ের ছাপ ছিল?”
“হ্যাঁ, ম্যাম। কিছু অস্পষ্ট ছাপ ছিল, কিন্তু সেগুলো বন্যপ্রাণীর মনে হয়েছিল। আমরা নমুনা নিয়েছি, কিন্তু কিছুই মেলেনি।”
অরুণিমা তার গ্লাভস পরে মাটি থেকে কিছু শুকনো পাতা সরাল। সে লক্ষ্য করল, গাছের গোড়ায় কিছু অদ্ভুত চিহ্ন রয়েছে, যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না। এগুলো যেন কোনো প্রাচীন ভাষার প্রতীক। সে তার ফোন বের করে ছবি তুলল।
“এই চিহ্নগুলো কি এখানকার কোনো উপজাতির প্রতীক?” অরুণিমা বিক্রম সিংকে জিজ্ঞেস করল।
বিক্রম সিং মনোযোগ দিয়ে চিহ্নগুলো দেখলেন। “হ্যাঁ, ম্যাম। এগুলো পুরনো ‘গদ্দি’ উপজাতির কিছু প্রতীক। তারা এখন আর এই ধরনের চিহ্ন ব্যবহার করে না। তাদের কিছু পুরনো লোককথা আছে, যেখানে এই প্রতীকগুলো ব্যবহার করা হতো।”
“গদ্দি উপজাতি?” অরুণিমা কৌতূহলী হলো।
“হ্যাঁ। তারা মূলত ভেড়া চরায়। এই অঞ্চলের প্রাচীনতম উপজাতিদের মধ্যে অন্যতম। তাদের কিছু নিজস্ব বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠান আছে, যা বাইরের কেউ জানে না।”
অরুণিমা বুঝতে পারল, খুনি হয়তো এই প্রাচীন প্রথাগুলোকেই ব্যবহার করছে। কিন্তু কেন? শিকারিদের উপর তার এত আক্রোশ কেন?
তারা দ্বিতীয় ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দিল। রতন সিংয়ের মৃতদেহ যেখানে পাওয়া গিয়েছিল, সেই প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। জায়গাটা আরও দুর্গম। পথ এতটাই সরু যে একজন মানুষ কোনোমতে যেতে পারে। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষগুলো পাথরের স্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার গায়ে শ্যাওলা আর লতাগুল্মের আস্তরণ। একসময় হয়তো এখানে কোনো দেব-দেবী পূজিত হতেন, এখন শুধু নীরবতা আর ধ্বংসের চিহ্ন।
এখানেও অরুণিমা একইরকমের চিহ্ন খুঁজে পেল। পাথরের গায়ে খোদাই করা সেই একই গদ্দি উপজাতির প্রতীক। রতন সিংয়ের মৃতদেহ যেখানে পড়েছিল, তার চারপাশে কিছু অদ্ভুত ধরনের ফুল ছড়িয়ে ছিল, যা এই অঞ্চলে সাধারণত দেখা যায় না।
“এই ফুলগুলো কি ডক্টর প্রীতি দেখেছিলেন?” অরুণিমা প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ, ম্যাম। তিনি বলেছিলেন এগুলো বিষাক্ত হতে পারে। কিন্তু এর ব্যবহার সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেননি।”
অরুণিমা কিছু ফুল তুলে একটি জিপলক ব্যাগে রাখল। তার মনে হচ্ছিল, এই ফুলগুলোর পেছনেও কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। হয়তো খুনি কোনো বিশেষ বার্তা দিতে চাইছে।
তদন্তের এই পর্যায়ে অরুণিমা অনুভব করল, তাকে এখানকার স্থানীয়দের বিশ্বাস এবং লোককথা সম্পর্কে আরও জানতে হবে। বিক্রম সিংয়ের কাছ থেকে সে জানতে পারল, গ্রামের বাইরে একজন বৃদ্ধ শিকারি থাকেন, যার নাম ধর্মপাল। তিনি এই অঞ্চলের জঙ্গল, প্রাণী এবং প্রাচীন প্রথা সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। গ্রামের মানুষ তাকে ‘বাবা’ বলে ডাকে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion