পরের দিন সকালে অরুণিমা এবং বিক্রম সিং ধর্মপালের সাথে দেখা করতে গেলেন। ধর্মপাল একজন প্রায় সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ, তার মুখ জুড়ে গভীর বলিরেখা, কিন্তু চোখ দুটো তীক্ষ্ণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত। তিনি একটি ছোট কুঁড়েঘরে একাই থাকেন, চারপাশে কিছু পোষা ভেড়া আর ছাগল।
অরুণিমাকে দেখে ধর্মপাল প্রথমে কিছুটা সন্দিহান হলেন। “শহর থেকে এসেছেন? এই পাহাড়ে কী খুঁজছেন?” তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের রুক্ষতা ছিল।
বিক্রম সিং তাকে কেসটা সম্পর্কে বোঝালেন। ধর্মপাল মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“আমি জানতাম এমন কিছু হবে,” ধর্মপাল বললেন। “ভূত ভ্যালির অভিশাপ ফিরে এসেছে। বহু বছর আগে আমার বাবাও এই অভিশাপের কথা বলতেন।”
অরুণিমা কৌতূহলী হলো। “অভিশাপ? কী ধরনের অভিশাপ, ধর্মপালজি?”
ধর্মপাল কুঁড়েঘরের ভেতরে একটি পুরনো কাঠের সিন্দুক থেকে একটি জীর্ণ বই বের করলেন। বইটির পাতাগুলো হলদে হয়ে গেছে, তার গায়ে প্রাচীন কিছু প্রতীক আঁকা।
“এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের বই। এতে ভূত ভ্যালির কথা লেখা আছে। বহু বছর আগে, আমাদের উপজাতির কিছু শিকারি একটি পবিত্র গুহায় প্রবেশ করেছিল, যেখানে একটি প্রাচীন দেবীর মূর্তি ছিল। তারা সেই দেবীর অভিশাপ কুড়িয়েছিল, কারণ তারা গুহার পবিত্রতা নষ্ট করেছিল। সেই থেকে, যারা অবৈধভাবে শিকার করে বা প্রকৃতির নিয়ম ভাঙে, তাদের উপর এই অভিশাপ নেমে আসে।”
অরুণিমা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। “নবীন থাপা আর রতন সিং কি অবৈধ শিকারি ছিলেন?”
ধর্মপাল মাথা নাড়লেন। “তারা দুজনেই খুব লোভী ছিল। তারা সরকারি নিয়ম ভেঙে অনেক বন্যপ্রাণী শিকার করত, এমনকি বিরল প্রজাতির প্রাণীও। গ্রামের মানুষজন তাদের পছন্দ করত না।”
অরুণিমা ধর্মপালের কাছ থেকে গদ্দি উপজাতির প্রতীকগুলো সম্পর্কে জানতে চাইল। ধর্মপাল বই থেকে কিছু প্রতীক দেখিয়ে বললেন, “এই যে এই প্রতীকটা, এটা ‘মৃত্যুর পাঞ্জা’ নামে পরিচিত। এর অর্থ হলো, যার উপর এই চিহ্ন পড়বে, তার মৃত্যু অনিবার্য। আর এই কালো পাথর, এটা ‘আত্মার পাথর’। এর অর্থ হলো, শিকারির আত্মা মুক্তি পাবে না, সে এই পাথরে বন্দি থাকবে।”
অরুণিমা এবং বিক্রম সিং একে অপরের দিকে তাকালেন। খুনির উদ্দেশ্য এবার স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সে শুধু খুন করছে না, সে একটি প্রাচীন প্রথাকে অনুসরণ করে শিকারিদের শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু কে এই খুনি? সে কি সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি, নাকি কোনো মানুষ এই প্রথাকে ব্যবহার করে প্রতিশোধ নিচ্ছে?
“ধর্মপালজি, এই প্রতীকগুলো আর কে জানে?” অরুণিমা প্রশ্ন করল।
ধর্মপাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। “খুব কম মানুষই জানে। আমাদের উপজাতির কিছু পুরনো মানুষ, যারা এখন আর নেই। আর একজন…” ধর্মপাল ইতস্তত করলেন।
“কে?” অরুণিমা জোর দিল।
“একজন তান্ত্রিক। তার নাম ‘কালীচরণ’। সে এই অঞ্চলের বাইরে থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে এখানে আসে। সে পুরনো প্রথা আর তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে গবেষণা করে। আমার মনে হয়, সে এই প্রতীকগুলো সম্পর্কে জানে।”
অরুণিমা নতুন একটি সূত্রের সন্ধান পেল। কালীচরণ। এই তান্ত্রিকই হতে পারে খুনের মূল হোতা, অথবা সে খুনিকে সাহায্য করছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion