কালীচরণকে খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। বিক্রম সিংয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে না। কখনও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে, কখনও গভীর জঙ্গলের কোনো নির্জন গুহায়, আবার কখনও স্থানীয় গ্রামের প্রান্তে দেখা যায়। তার সম্পর্কে নানা লোককথা প্রচলিত ছিল – কেউ বলত সে নাকি প্রকৃতির আত্মাদের সাথে কথা বলতে পারে, কেউ বলত সে কালো জাদু করে, আবার কেউ তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে উড়িয়ে দিত।
অরুণিমা এবং বিক্রম সিং সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা কালীচরণের সম্ভাব্য আস্তানাগুলোতে তল্লাশি চালাবেন। প্রথমত, তারা সেই প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কাছে গেলেন, যেখানে রতন সিংয়ের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। জায়গাটা দিনের বেলাতেও গা ছমছমে। মন্দিরের ভাঙা দেওয়ালগুলো যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অসংখ্য গোপন কথা বুকে চেপে রেখেছে। অরুণিমা প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ফাটল খুঁটিয়ে দেখল। পাথরের গায়ে কিছু অস্পষ্ট আঁকা ছবি, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোনো প্রাচীন দেব-দেবীর অবয়ব।
হঠাৎই অরুণিমা একটি ছোট পাথরের নিচে কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেল। একটি ছোট মাটির পাত্র, তার ভেতরে কিছু শুকনো ভেষজ, পাখির পালক এবং কয়েকটি ছোট হাড়। তার পাশেই একটি ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, তাতে রক্তের শুকনো দাগ।
“এটা কী?” বিক্রম সিং প্রশ্ন করলেন।
“মনে হচ্ছে, কোনো তন্ত্রমন্ত্রের জিনিস।” অরুণিমা সতর্কভাবে জিনিসগুলো পরীক্ষা করল। “খুনি হয়তো এখানে কোনো আচার পালন করেছিল।”
কাপড়ের টুকরোটা অরুণিমা তুলে নিল। তাতে একটি অদ্ভুত গন্ধ ছিল, যা পরিচিত মনে হলেও ঠিক ধরতে পারছিল না। প্রীতি শর্মাকে দেখাতে হবে।
তারা আরও গভীরে জঙ্গলের দিকে এগোলেন। ধর্মপালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কালীচরণ নাকি মাঝে মাঝে ‘শিকারি গুহা’ নামে পরিচিত একটি জায়গায় যেত। এই গুহাটি এতটাই দুর্গম যে স্থানীয় শিকারিরাও সেখানে খুব কম যায়। পথ ছিল পিচ্ছিল এবং পাথুরে, ঘন ঝোপঝাড় আর লতাগুল্মে ঢাকা। সূর্যের আলো একেবারেই প্রবেশ করছিল না, ফলে দিনের বেলাতেও জায়গাটা অন্ধকারাচ্ছন্ন।
গুহার মুখে পৌঁছে অরুণিমা দেখল, সেখানে কিছু নতুন পায়ের ছাপ। সেগুলো মানুষের পায়ের ছাপ, কিন্তু আকারে বেশ বড়। অরুণিমা তার মাপকাঠি দিয়ে মাপল। “ইনস্পেক্টর, এই পায়ের ছাপগুলো বেশ বড়। কোনো সাধারণ মানুষের নয়।”
বিক্রম সিং মাথা নাড়লেন। “কালীচরণ নাকি বিশালদেহী একজন মানুষ।”
গুহার ভেতরে প্রবেশ করতেই এক হিমশীতল বাতাস তাদের স্বাগত জানাল। গুহাটি সংকীর্ণ এবং স্যাঁতসেঁতে। ভেতরের দেওয়ালে কিছু আঁকা ছবি, যা দেখে মনে হচ্ছিল প্রাচীনকালের কোনো শিকারের দৃশ্য। কিন্তু তার মাঝে কিছু অদ্ভুত প্রতীকও ছিল, যা ধর্মপালের দেখানো গদ্দি উপজাতির প্রতীকের সাথে মিলে যায়।
অরুণিমা তার টর্চ জ্বেলে গুহার গভীরে প্রবেশ করল। ভেতরের দিকে একটি ছোট জায়গা ছিল, যেখানে কিছু পুরনো কম্বল, কিছু শুকনো কাঠ এবং একটি ছোট পাথরের বেদি। বেদির উপর কিছু শুকনো ফুল, ধূপের ছাই এবং একটি ছোট ত্রিশূল রাখা ছিল। অরুণিমা ত্রিশূলটি হাতে নিল। এটি লোহার তৈরি, কিন্তু তার গায়ে কিছু খোদাই করা চিহ্ন ছিল, যা ‘মৃত্যুর পাঞ্জা’র মতো দেখতে।
“এটা কি সেই অস্ত্র হতে পারে, যা দিয়ে খুন করা হয়েছে?” বিক্রম সিং প্রশ্ন করলেন।
“হতে পারে।” অরুণিমা ত্রিশূলটি একটি জিপলক ব্যাগে রাখল। “প্রীতিকে এটা পরীক্ষা করতে হবে।”
গুহার ভেতরে আরও কিছু জিনিস পাওয়া গেল – কয়েকটি পুরনো বই, যার পাতাগুলো ছিঁড়ে গেছে, এবং কিছু হাতে লেখা কাগজ। কাগজগুলোতে অদ্ভুত ভাষায় কিছু লেখা ছিল, যা অরুণিমা বুঝতে পারল না। কিন্তু তাতে কিছু চিত্র আঁকা ছিল, যা গদ্দি উপজাতির প্রতীকগুলোর সাথে মিলে যায়।
অরুণিমা কাগজগুলো হাতে নিয়ে দেখল, তাতে শিকারিদের নাম লেখা আছে, যারা খুন হয়েছে। নবীন থাপা, রতন সিং, সুশীল থাপা। তাদের নামের পাশে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন দেওয়া ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল তাদের ভাগ্য আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল।
“মনে হচ্ছে, খুনি এই গুহাতেই তার পরিকল্পনা করত,” অরুণিমা বলল। “সে এই প্রাচীন প্রথাগুলোকে ব্যবহার করে শিকারিদের খুন করছে।”
কিন্তু কালীচরণকে তারা খুঁজে পেল না। গুহাটি খালি ছিল। অরুণিমা বুঝতে পারল, কালীচরণ হয়তো তাদের আসার খবর পেয়েছিল, অথবা সে এতটাই চতুর যে তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion