আরিস রোহানকে তার প্রাচীন পাথরের কাঠামোতে নিয়ে গেলেন, যা ছিল আসলে একটি গোপন জাদুর বিদ্যালয়। যদিও বিদ্যালয়টি এখন জীর্ণ ছিল, তার প্রতিটি পাথরে ছিল প্রাচীন জ্ঞানের ছাপ। আরিসের জাদুর স্পর্শে তা আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। দেয়ালগুলো আলোকিত হলো, আর বাতাসে এক অদ্ভুত জাদুর গন্ধ ভেসে এল, কিন্তু সেই গন্ধে একটা চাপা ভয়ও ছিল, যেন কোনো অশুভ শক্তি লুকিয়ে আছে, তাদের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে, তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস শুনছে। আরিস রোহানকে জাদুর প্রাথমিক শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। প্রথমদিকে রোহানের জন্য সবকিছুই ছিল কঠিন। সে কখনো জাদু দেখেনি, আর এখন তাকে নিজেই জাদু শিখতে হবে। তার হাত কাঁপত, তার মন ছিল বিভ্রান্ত। প্রতিটি ব্যর্থতায় তার মনে হতো সে হয়তো এই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়, তার আত্মবিশ্বাস কমে আসছিল। আরিস তাকে শুধু জাদু শেখালেন না, তাকে মানসিক চাপ সহ্য করতেও শেখালেন, কারণ ছায়া প্রভুর প্রভাব শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও ছিল, যা মানুষের মনকে দুর্বল করে দিত, তাদের সবচেয়ে খারাপ ভয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরত, তাদের উন্মাদ করে তুলত।
আরিস তাকে প্রথমে প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপন করতে শেখালেন। এলডোরিয়ার জাদু প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রোহানকে গাছের প্রাণশক্তি অনুভব করতে শেখানো হলো, বাতাসের গতিবিধি বুঝতে শেখানো হলো, আর জলের প্রবাহের সাথে মিশে যেতে শেখানো হলো। প্রথম কয়েকদিন সে কিছুই অনুভব করতে পারল না, তার মনে হতো সে কেবলই সময় নষ্ট করছে। তার মনে হতো যেন প্রকৃতি তার সাথে কথা বলতে চাইছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু আরিসের ধৈর্য আর অনুপ্রেরণা তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করল। আরিস তাকে ধ্যান করতে শেখালেন, তার মনকে শান্ত করতে শেখালেন, যাতে সে প্রকৃতির সূক্ষ্ম শক্তিগুলো অনুভব করতে পারে। মাঝে মাঝে সে দেখত, গাছের ছায়াগুলো যেন নড়ছে, আর তার মনে হতো যেন কেউ তাকে দেখছে, তার প্রতিটি নড়াচড়া অনুসরণ করছে, তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস শুনছে, তার ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে যেত।
ধীরে ধীরে রোহান প্রকৃতির সূক্ষ্ম শক্তিগুলো অনুভব করতে শুরু করল। সে অনুভব করল যেন তার শরীর প্রকৃতির সাথে এক হয়ে যাচ্ছে। সে দেখল, তার হাতের ইশারায় ছোট ছোট গাছ নড়ছে, তার মনের শক্তিতে বাতাস বইছে, আর তার ইচ্ছায় ছোট ছোট জলকণা বাতাসে ভাসছে। আরিস তাকে কিছু মৌলিক মন্ত্র শেখালেন, যা দিয়ে সে ছোট ছোট আলোর গোলক তৈরি করতে পারল, বা ছোট জিনিসকে ভাসিয়ে রাখতে পারল। রোহান অবাক হয়ে দেখল, তার ভেতরে সত্যিই এক অজানা শক্তি লুকিয়ে আছে, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। তার আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল, কিন্তু তার মনে একটা চাপা ভয়ও ছিল, যে এই শক্তি তাকে গ্রাস করতে পারে, তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারে, তাকে ছায়া প্রভুর মতো করে তুলতে পারে।
আরিস তাকে এলডোরিয়ার বিভিন্ন জাদুর প্রাণী সম্পর্কেও জ্ঞান দিলেন। তিনি তাকে শেখালেন কীভাবে এই প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়, এবং কীভাবে তাদের সাহায্য নিতে হয়। তিনি তাকে এলডোরিয়ার ইতিহাস, প্রাচীন জাদুকরদের কাহিনী, এবং ছায়া প্রভুর উত্থান সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন। ছায়া প্রভু একসময় একজন শক্তিশালী জাদুকর ছিলেন, এলডোরিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুকর। কিন্তু ক্ষমতার লোভে তিনি অন্ধকার জাদুর দিকে ঝুঁকে পড়েন, তার আত্মা অন্ধকারে ডুবে যায়, এবং এলডোরিয়াকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেন। তার জাদু ছিল ভয়ানক এবং ধ্বংসাত্মক। আরিস তাকে সতর্ক করে দিলেন যে ছায়া প্রভু শুধু এলডোরিয়াকে ধ্বংস করতে চায় না, সে চায় প্রতিটি প্রাণের আত্মাকে গ্রাস করতে, তাদের মনকে বিকৃত করতে, তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিতে, আর তাদের সবচেয়ে খারাপ ভয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরতে।
একদিন, আরিস রোহানকে একটি কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন। তাকে বনের গভীরে গিয়ে একটি বিশেষ ঔষধি গাছ খুঁজে আনতে হবে, যা শুধুমাত্র পূর্ণিমার রাতে ফোটে। আরিস তাকে সতর্ক করে দিলেন যে বনে কিছু বিপজ্জনক প্রাণী আছে, যারা ছায়া প্রভুর দ্বারা প্রভাবিত, এবং তাদের চোখগুলো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। "এই বন এখন আর নিরাপদ নয়, রোহান," আরিস বললেন। "ছায়া প্রভুর প্রভাব এখানেও পৌঁছেছে। তোমার মনকে শান্ত রাখবে, আর তোমার জাদু ব্যবহার করবে। মনে রেখো, ছায়া প্রভু তোমার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারে, তোমার সবচেয়ে খারাপ স্বপ্নগুলো তোমার সামনে তুলে ধরতে পারে, আর তোমাকে উন্মাদ করে তুলতে পারে।"
রোহান তার নতুন শেখা জাদু নিয়ে বনের দিকে রওনা দিল। রাত ছিল গভীর, আর দুটি চাঁদ আকাশে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছিল, তাদের আলোয় বনভূমি এক অদ্ভুত রূপ ধারণ করেছিল, যা একই সাথে সুন্দর এবং ভীতিকর ছিল। বনের ভেতরে প্রবেশ করতেই সে এক অদ্ভুত নীরবতা অনুভব করল, যা তার মনে ভয় জাগিয়ে তুলল। গাছগুলো যেন তাকে দেখছে, তাদের ডালপালাগুলো যেন তার দিকে ইশারা করছে, আর প্রতিটি শব্দই যেন বড় করে শোনা যাচ্ছে। সে অনুভব করল যেন কেউ তার শ্বাস-প্রশ্বাস শুনছে, তার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ্য করছে, তার ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে গেল, তার মনে একটা চাপা ভয় ঢুকে গিয়েছিল।
সে সাবধানে হাঁটছিল, তার চোখ চারপাশে সতর্ক ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর সে একটি অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল – যেন কোনো হিংস্র প্রাণী তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার পায়ের শব্দ মাটিকে কাঁপিয়ে তুলছিল, আর তার সাথে মিশে ছিল একটা চাপা গোঙানির শব্দ, যা তার মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছিল। রোহান তার জাদুর লাঠি (যা আরিস তাকে দিয়েছিলেন) শক্ত করে ধরল, তার হাত কাঁপছিল। সে দেখল, একটি বড় নেকড়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে, যার চোখগুলো ছিল লাল এবং জ্বলন্ত, আর তার লোম ছিল কালো এবং কর্কশ। নেকড়েটি ছিল ছায়া প্রভুর দ্বারা প্রভাবিত, এবং তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল রোহানকে আক্রমণ করা। তার মুখ থেকে লালা ঝরছিল, আর তার দাঁতগুলো ছিল ধারালো। নেকড়েটি তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে রোহানের মনে হলো যেন সে ছায়া প্রভুর হাসি শুনতে পেল, যা তার মনে এক তীব্র ভয় জাগিয়ে তুলল, তার আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছিল, তার কানে একটা চাপা ফিসফিস শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
রোহান ভয় পেল, তার শরীর হিম হয়ে গেল, তার হাত-পা কাঁপছিল, তার মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছে, কিন্তু এই দুঃস্বপ্ন ছিল বাস্তব। কিন্তু সে জানত তাকে লড়াই করতে হবে। সে আরিসের শেখানো একটি প্রতিরক্ষামূলক মন্ত্র উচ্চারণ করল। মন্ত্রের প্রভাবে তার চারপাশে একটি হালকা নীল রঙের ঢাল তৈরি হলো, যা তার শরীরকে রক্ষা করল, কিন্তু ঢালটি যেন ক্ষণে ক্ষণে দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল, তার শক্তি কমে আসছিল। নেকড়েটি ঢালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার নখগুলো ঢালের উপর আঁচড় কাটল, কিন্তু ঢাল তাকে রক্ষা করল। রোহান সুযোগ বুঝে একটি আলোর গোলক তৈরি করে নেকড়েটির দিকে ছুঁড়ে দিল। আলোর গোলকটি নেকড়েটির গায়ে লেগে তাকে দূরে সরিয়ে দিল। নেকড়েটি গর্জন করে পালিয়ে গেল, তার চোখে ছিল ভয়, কিন্তু তার শেষ দৃষ্টি ছিল রোহানের দিকে, যেন সে তাকে হুমকি দিচ্ছে, আর তার মনে হলো যেন সে ছায়া প্রভুর উপস্থিতি অনুভব করছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন কেউ টেনে নিচ্ছে, তার আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছে।
রohান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, তার শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল। সে বুঝতে পারল, জাদু শুধু শেখার বিষয় নয়, এটি ব্যবহার করার সাহসও প্রয়োজন। সে আবার ঔষধি গাছের খোঁজে এগিয়ে চলল। বহু খোঁজাখুঁজির পর সে একটি ছোট ঝর্ণার পাশে ঔষধি গাছটি খুঁজে পেল। গাছটি থেকে মৃদু আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যেন তা নিজেই একটি ছোট তারা, এবং তার ফুলগুলো ছিল উজ্জ্বল সোনালী রঙের, যা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছিল। রোহান সাবধানে গাছটি তুলল এবং আরিসের কাছে ফিরে এল।
আরিস রোহানের সাফল্য দেখে খুশি হলেন। "তুমি তোমার প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ, তরুণ," তিনি বললেন, তার চোখে ছিল গর্ব। "কিন্তু তোমার পথ আরও কঠিন হবে। ছায়া প্রভুর শক্তি বাড়ছে, আর তোমাকে আরও শক্তিশালী হতে হবে। এই ঔষধি গাছটি তোমার যাত্রায় অনেক সাহায্য করবে। মনে রেখো, ছায়া প্রভু এখন তোমার উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়েছে। সে তোমাকে অনুসরণ করবে, এবং তোমার দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে, তোমার মনকে গ্রাস করতে চাইবে, তোমাকে উন্মাদ করে তুলতে চাইবে।"
রোহান বুঝতে পারল, তার যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। তাকে আরও অনেক কিছু শিখতে হবে, আরও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল। এলডোরিয়াকে রক্ষা করার জন্য সে তার জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল, তার মনে ছিল এক নতুন দৃঢ়তা, কিন্তু তার সাথে মিশে ছিল এক চাপা উদ্বেগ, যা তাকে প্রতি মুহূর্তে তাড়া করছিল, তার মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো ফাঁদে আটকা পড়েছে, যেখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion