Episode 3570 words1 views

তৃতীয় পর্ব: অনুভূতির কক্ষ ও প্রহরীর দর্শন

১টা ১৭ মিনিটে রহস্যময়ী রাত্রিযান প্ল্যাটফর্মে এল। এবার অয়ন যাত্রী। সে দৃঢ় পদক্ষেপে ট্রেনের দরজায় পৌঁছাল এবং ভেতরে প্রবেশ করল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরের ফুলডুবি স্টেশন এক লহমায় মুছে গেল, যেন প্ল্যাটফর্মের আলোটা কেউ নিভিয়ে দিল। ভেতরের জগৎটি শীতল এবং নিশ্চুপ। ট্রেনটি চলছে বটে, কিন্তু কোনো গতি অনুভব হচ্ছে না। বগির দেওয়ালগুলো ধূসর, পুরোনো মখমলের আসনগুলো ধুলোমাখা, যেন শতবর্ষের নীরবতা এখানে বাসা বেঁধেছে। অয়ন দেখল, ট্রেনের বগিগুলো সাধারণ নয়। এই বগিগুলো যেন মানুষের অনুভূতির রং ধারণ করেছে। প্রথম বগি (নীলচে আভা - বিফল প্রেম/আবেগ): এখানে ছায়ামূর্তিগুলো স্থির, কিন্তু তাদের চোখগুলো যেন জলে ভেজা। এই বগির বাতাস আর্দ্র এবং ঠাণ্ডা। দ্বিতীয় বগি (গাঢ় হলুদ আলো - অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা/স্বপ্ন): এই বগির বাতাস তুলনামূলকভাবে উষ্ণ, এখানে বসে থাকা ছায়ামূর্তিগুলোর মধ্যে একটি অস্থিরতা আছে, যেন তারা বারবার নড়েচড়ে বসছে, কিছু একটা শুরু করতে চাইছে। এরাই সম্ভবত 'আকাঙ্ক্ষার' যাত্রীরা। তৃতীয় বগি (লালচে অন্ধকার - প্রতিশোধের কক্ষ): এই বগিটি সবচেয়ে ভয়ংকর। এখানে নীরবতা নেই, আছে চাপা ক্রোধ আর হতাশার ফিসফিসানি। যাত্রীদের মুখগুলো স্পষ্ট না হলেও, তাদের ভঙ্গিতে একটা তীব্র মানসিক যন্ত্রণা বোঝা যাচ্ছে। এরা সেই মানুষ, যারা জীবনে তাদের উপর হওয়া অন্যায়ের কোনো প্রতিশোধ নিতে পারেনি, বা প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ছায়াগুলো মাঝে মাঝে দেয়ালের দিকে হাত ছুড়ে মারছে। অয়ন দ্বিতীয় বগি পার হওয়ার সময় হঠাৎ তার সামনে পথ আটকে দাঁড়ালো সেই দীর্ঘকায়, ছায়াময় মূর্তি—প্রহরী। তার পরনে পুরোনো দিনের কন্ডাক্টরের পোশাক, কিন্তু তার মুখটি কালো ধোঁয়ায় ঢাকা, শুধু দুটো জ্বলন্ত চোখের মতো বিন্দু ঝকমক করছে। প্রহরী এক শীতল, গভীর কণ্ঠে কথা বলল, "নতুন যাত্রী? তুমি দ্বিতীয়বার এসেছো। তোমার টিকিট হলো দায়িত্বের টিকিট—যা কোনোদিনও ছিঁড়ে ফেলা যায় না। প্রসেনজিৎ-এর জন্য তোমার আত্মত্যাগ, সেটাই তোমার বাসনা-বন্ধন।" অয়ন তার হাতের হলদেটে টিকিটটি বের করে দিল। প্রহরী সেটি নিল না। তার হাত টিকিটের উপর দিয়ে ভেসে গেল। "আমার বন্ধু প্রসেনজিৎ কোথায়? তাকে মুক্তি দিন।" অয়ন দৃঢ়ভাবে বলল। প্রহরী হাসল। সে হাসিটা শব্দহীন, কিন্তু ট্রেনের ভেতর যেন গমগম করে উঠল। "মুক্তি? এখানে কেউ কাউকে মুক্তি দেয় না। মানুষ আসে মুক্তি পেতে। প্রসেনজিৎ আছে। শেষ বগিতে, তার সময়ের কয়েদখানায়। সে বারবার তার ভীরুতাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। তার মুক্তি হলো তোমার হাতে।" প্রহরী অয়নকে পথ ছেড়ে দিল, শুধু ফিসফিস করে বলল, "মুক্তির রাস্তা হলো গ্রহণ করা, মনে রেখো। আর এই ট্রেনের নাম হলো—অতীতের পুনরাবৃত্তি।" অয়ন শেষ বগিতে পৌঁছাল। সেখানে আলো নেই, শুধু নীলচে অন্ধকার। মাঝখানে একটি আসনে বসে ছিল প্রসেনজিৎ। কিন্তু এই প্রসেনজিৎ সেই প্রসেনজিৎ নয়। তার চোখ শূন্য, তার পোশাক পুরোনো, তার কাঁধের ব্যাগটি ধুলোয় ঢাকা। সে স্থির, অপলক চোখে সামনের দেওয়ালে তাকিয়ে আছে। অয়ন দেখল, প্রসেনজিৎ-এর চোখের সামনে বগির দেয়ালে একটা আবছা দৃশ্য ফুটে উঠেছে—তাদের কলেজের ফেয়ারওয়েলের রাত। প্রসেনজিৎ তার স্বপ্নের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবসার কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু ভয়ে বলতে পারেনি। এখন সেই দৃশ্যটি বারবার ফিরে আসছে। সে বারবার চেষ্টা করছে, বারবার হার মানছে। অয়ন প্রসেনজিৎ-এর পাশে বসল। সে দেখল, প্রসেনজিৎ-এর হাতে সেই হলদেটে টিকিটটা। অয়ন টিকিটটা ছুঁয়ে অনুভব করল, এটা শুধু কাগজের টুকরো নয়, এটা একটা বন্ধন। "প্রসেনজিৎ, তুই তোর ভুল স্বীকার করলি, এটা মুক্তি নয়। মুক্তি হলো তোর সেই ভুলকে ছেড়ে দেওয়া। তোর স্বপ্নটা আমি পূরণ করব। আমি তোর ব্যর্থতাকে মেনে নিলাম, তুই আমার যুক্তির অন্ধত্ব মেনে নে।" অয়ন সেই নোটটি প্রসেনজিৎ-এর ব্যাগের ভেতরে গুঁজে দিল এবং তার নিজের হাতে থাকা টিকিটটি ছিঁড়ে ফেলে দিল ট্রেনের মেঝেতে। মুহূর্তেই, একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হলো। ট্রেনটা হঠাৎ গতিশীল হয়ে উঠল। নীলচে আলোটা তীব্র হয়ে জ্বলে উঠল এবং প্রসেনজিৎ-এর ছায়া-দেহে এক ধরনের শান্তি নেমে এল—তার মুখে শূন্যতার বদলে একটা মৃদু হাসি ফুটল। অয়ন দেখল, বগির দেয়ালের দৃশ্যটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। অন্য যাত্রীদের ছায়াগুলো দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। অয়ন চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিল বাইরের অন্ধকারে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion