Episode 4368 words1 views

চতুর্থ পর্ব: রেলের প্রহরীর শর্ত

অয়ন যখন জ্ঞান ফিরে পেল, তখন সূর্য সবেমাত্র ফুলডুবির উপর আলো ছড়িয়েছে। সে জীবিত, কিন্তু তার শান্তি স্থায়ী হলো না। ঠিক তিন দিন পর, অয়ন অনুভব করল তার যুক্তিবাদী মনে ভাঙন ধরেছে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে এমন সব তুচ্ছ ঘটনা, যা নিয়ে তার কোনো অনুশোচনা ছিল না। এই ছোট ছোট 'অনুতাপ'গুলো তার মনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এক রাতে, ঘুমন্ত অবস্থায় সে স্বপ্নে দেখল সেই প্রহরীকে। কন্ডাক্টরের পোশাকে ঢাকা সেই ছায়ামূর্তি তার পাশে এসে দাঁড়াল। "ফিরে এসেছো, অয়ন। কিন্তু তুমি তোমার বন্ধুকে মুক্তি দিয়েছ, নিজের বাসনা-বন্ধন ছিন্ন করোনি। তুমি নিজের টিকিট ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছ। কিন্তু ট্রেনের একটা নিয়ম আছে: একজনের বিনিময়ে আরেকজন। তুমি প্রসেনজিৎ-এর জায়গা নিয়েছো।" অয়ন দেখল, তার হাতের তালুতে সেই হলদেটে কালির ছাপ, যেন টিকিটটা তার শরীরের ভেতর থেকে উঠে এসেছে। এটি হলো ঋণের টিকিট। এখন অয়নের কাজ হলো তার জীবন থেকে এমন একটি অনুতাপ খুঁজে বের করা, যা সে ট্রেনের কাছে সমর্পণ করতে পারে। পরের রাতে অয়ন আবার ট্রেনে উঠল। এবার প্রহরী তাকে লাইব্রেরি বগিতে নিয়ে গেল। এই বগিটি লাইব্রেরির মতো সাজানো। সারি সারি পুরোনো বই, হলুদ মলাটের, যার নামগুলোও বাংলা নয়, যেন অন্য কোনো প্রাচীন ভাষা। এই বগিটি ছিল ট্রেনের বিচারালয়। প্রহরী সেখানে একটি বই তুলে নিল। সেটি ছিল প্রসেনজিৎ-এর ডায়েরির অলৌকিক প্রতিরূপ। "এইটা হলো 'ইতিহাসের কয়েদখানা'। এই ট্রেনের সমস্ত যাত্রীর জীবনের ভুল, আকাঙ্ক্ষা এবং অনুতাপের হিসেব এখানে লেখা আছে। তোমার বন্ধুর অনুতাপ, প্রসেনজিৎ-এর ডায়েরি, সেটাও এখানে আছে। এই ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা আছে, প্রসেনজিৎ তার ভয়ের মূল কারণটা খুঁজে পেয়েছিল।" প্রহরী বইটির একটি পাতা দেখাল। অয়ন দেখল, প্রসেনজিৎ-এর সেই ব্যবসার প্ল্যানের দৃশ্য, যার নিচে প্রসেনজিৎ-এর হাতের লেখায় লেখা: "সুরেশ মুখার্জি আমাকে ভয় দেখাত। আমার বাবার অতীতের কথা ফাঁস করে দেবে বলে। ভয়টাই আসল ব্যবসা, বাকি সব লোকসান।" প্রহরী বলল, "ফুলডুবির অভিশাপের মূল লুকিয়ে আছে এক নীরব প্রতারণায়। ট্রেন সেটা জানে। তোমার মুক্তি পেতে হলে, তোমাকে শুধু তোমার অনুতাপ দিতে হবে না, অভিশাপের মূল সত্যও জানতে হবে। তোমার যুক্তি তোমাকে মানুষ হতে দেয়নি, অয়ন। তোমার যুক্তি তোমাকে ভালোবাসতে, ভুল করতে এবং জীবনের ঝুঁকি নিতে শেখায়নি। এটাই তোমার অপূর্ণতা।" "আমি কী করিনি?" প্রহরী গম্ভীর হয়ে গেল। সে জানালার দিকে ইশারা করল। "তুমি করোনি—বিদ্রোহ। তুমি জানো তোমার বন্ধুর ভয়ের কারণ কে। তোমার বাবাও জানে। কিন্তু কেউ সাহস দেখায়নি। তোমার জীবনে একটা বড় মিথ্যা আছে, অয়ন। সেটাই তোমার টিকিট। সেই মিথ্যা হলো ফুলডুবির অভিশাপের এক শতাব্দী প্রাচীন নীরবতা।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion