উন্মাদনার পথে পলায়ন
আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকার সাহস ছিল না অর্কের, তার শরীরের প্রতিটি কোষ চিৎকার করছিল পালানোর জন্য, তার প্রতিটি স্নায়ু যেন বিদ্যুতের শক খাচ্ছিল। তার শরীর অসাড় হয়ে আসছিল ভয়ে, প্রতিটি পেশী যেন কঠিন পাথরের মতো জমে গিয়েছিল, তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন আর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সে দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ল, পিছন ফিরে তাকানোর সাহসও পেল না, যেন এক মুহূর্তের জন্য পিছু ফিরে তাকালে সে চিরতরে আটকা পড়ে যাবে সেই নরকে, আর কখনোই আলোর মুখ দেখতে পাবে না, তার আত্মা সেখানেই বন্দি হয়ে যাবে, এক অনন্তকালের জন্য, এক অবিরত যন্ত্রণায়, এক চিরন্তন বন্দিত্বে, যেখানে মুক্তি নেই, কেবল মৃত্যুর নীরবতা, এক পচনশীল অন্ধকার, এক অসীম গহ্বর, যা তাকে গ্রাস করতে প্রস্তুত ছিল, তার আত্মাকে শুষে নিতে প্রস্তুত ছিল, তাকে চিরতরে বিলীন করে দিতে প্রস্তুত ছিল। তার পা যেন নিজের ইচ্ছায় দৌড়াচ্ছিল, এক অজানা শক্তি তাকে ঠেলে দিচ্ছিল সামনের দিকে, যেন তার নিজের শরীরের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সে এক অদৃশ্য শক্তির হাতের পুতুল, এক অসহায় শিকার, যার কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই, কেবল পালানোর এক অদম্য ইচ্ছা, জীবনের জন্য পালানো, অস্তিত্বের জন্য পালানো, sanity’র জন্য পালানো, তার মানসিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য, তার শেষ নিঃশ্বাসের জন্য।
ভিলার গেটম্যান সুকলাল তখনো তার ছোট ঘরে গভীর ঘুমে নাক ডাকছিল, তার দরজার ঠিক বাইরে যে ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে তা সে জানে না, সদ্য প্রকাশিত আতঙ্কের কথা সে জানে না, তার শান্তিপূর্ণ ঘুম আর্কোর দুঃস্বপ্নের সম্পূর্ণ বিপরীত, এমন একটি দুঃস্বপ্ন যা তার বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল, এমন একটি বাস্তবতা যা যেকোনো স্বপ্নের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর, এমন একটি জীবন্ত নরক যেখান থেকে কোন মুক্তি নেই, কোন পরিত্রাণ নেই, কোন পরিত্রাণ নেই, কোন আশা নেই, কেবল অন্তহীন হতাশা।. অর্ক তাকে না ডেকেই, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে তাড়া করছে, ভিলা ছেড়ে দ্রুত হেঁটে চলল শহরের দিকে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন জীবন-মৃত্যুর মধ্যবর্তী রেখার উপর পড়ছিল, প্রতিটি সেকেন্ড যেন তার জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল। রাত ছিল গভীর, আর কালিম্পং-এর কুয়াশা এতই ঘন যে সামনের দশ হাতও দেখা যাচ্ছে না, যেন চারদিক একটি সাদা, পুরু চাদরে ঢেকে আছে, যা দৃষ্টিকে সম্পূর্ণভাবে বাধা দিচ্ছিল, তার চারপাশের সবকিছুকে অদৃশ্য করে দিচ্ছিল। পাইন গাছের সারি যেন প্রেতাত্মার মতো নীরব দাঁড়িয়ে আছে, তাদের দীর্ঘ, সূক্ষ্ম, কালো ছায়া রাস্তার ওপর পড়ে এক ভয়ংকর চিত্র তৈরি করেছে, যেন মৃত আত্মারা তাকে অনুসরণ করছে, তাদের শীর্ণ, কঙ্কালসার ডালপালাগুলো তাকে ধরার জন্য প্রসারিত, তাকে আবার তাদের কাছে টেনে নিতে চাইছে, তাকে চিরতরে আটকে রাখতে চাইছে, তাদের অনন্ত যন্ত্রণার সঙ্গী করতে চাইছে, তাদের দলে টানতে চাইছে, তাকেও তাদের মতো অভিশপ্ত করতে চাইছে, তাকেও নরকে নিয়ে যেতে চাইছে, যেখানে কেবল অন্ধকার আর মৃতদের চিৎকার, এক অশরীরী সিম্ফনি, এক বীভৎস chorus, এক নীরব আমন্ত্রণ, যা তার আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছিল, তাকে চিরতরে বন্দি করতে চাইছিল।
প্রতিটি শুকনো পাতার মর্মর শব্দে তার মনে হচ্ছে কেউ যেন তার পিছু নিচ্ছে, তার নিঃশ্বাসের শব্দও তার কানে বজ্রপাতের মতো বাজছে, তার কানের পাশ দিয়ে শীতল বাতাস হু-হু করে বয়ে যাচ্ছিল, যেন অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া, তার ঘাড়ের পেছনে ঠান্ডা নিশ্বাস ফেলছে, যেন মৃত্যুর হিমশীতল ছোঁয়া তাকে তাড়া করছে, প্রতিটি মুহূর্তে তার মৃত্যু নিশ্চিত, প্রতিটি সেকেন্ড যেন তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে, তাকে গ্রাস করতে চাইছে, তার আত্মাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে, তাকে বিলীন করে দিতে চাইছে, তাকে অস্তিত্বহীন করে দিতে চাইছে, তাকে তার নিজের পরিচয় থেকে মুছে দিতে চাইছে। তার মোবাইল ফোনে কোনো নেটওয়ার্ক নেই, যেন দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সে, একাকী এই ভয়াল রাতে, যেখানে বাইরের পৃথিবীর কোনো অস্তিত্ব নেই, কেবল তার নিজের ভয় আর সেই অশুভ শক্তি, যা তাকে গ্রাস করতে চাইছে, তার আত্মাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে, তাকে বিলীন করে দিতে চাইছে, তাকে তার নিজের অস্তিত্ব থেকে মুছে দিতে চাইছে, তাকে এক শূন্যতায় ঠেলে দিচ্ছিল, এক অন্তহীন গহ্বরে, যেখানে কেবল পচনশীল অন্ধকার আর শকুনের ছায়া, আর মৃতদের নীরব বিলাপ, এক অসীম নীরবতা। রাস্তার দু’পাশে গভীর খাদ, যা অন্ধকারে এক অতল গহ্বরের মতো দেখাচ্ছিল, যেন তার ভেতরে হাজারো মৃতদেহ লুকিয়ে আছে, তাদের অতৃপ্ত আত্মারা তার জন্য অপেক্ষা করছে, তাকেও তাদের দলে টানতে চাইছে, তাদের চিরন্তন যন্ত্রণার সঙ্গী করতে চাইছে, এক নিরন্তর নরকে, যেখানে কোনো আলো প্রবেশ করে না, কেবল অন্ধকার আর পচা গন্ধ, আর মৃত্যুর নীরবতা, এক পৈশাচিক উপস্থিতি, যা তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছিল না, তার ফুসফুসকে জমাট করে দিচ্ছিল, তার শরীরকে পঙ্গু করে দিচ্ছিল, তাকে এক জীবন্ত ফ্রিজে পরিণত করছিল।
সামান্য ভুল হলেই নিশ্চিত মৃত্যু, কিন্তু মৃত্যুভয়ও যেন সেই অজানা, অশরীরী শক্তির ভয়ে ঢাকা পড়ে গেছে, তার কাছে শারীরিক যন্ত্রণা অর্থহীন মনে হচ্ছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল পালানো, তার জীবনের জন্য পালানো, এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি, তার আত্মার মুক্তি, তার জীবনের মুক্তি। সে শুধু দৌড়াচ্ছিল, দৌড়াচ্ছিল আর মনে মনে প্রার্থনা করছিল যেন সকাল হয়, যেন এই দুঃস্বপ্ন শেষ হয়, যেন এই রাত আর দীর্ঘায়িত না হয়, যেন সে আর এক মুহূর্তও সেই ভয়ের শিকার না হয়, যেন সে মুক্ত হতে পারে, তার আত্মার মুক্তি, তার জীবনের মুক্তি, তার অস্তিত্বের মুক্তি, তার sanity’র মুক্তি, তার মানসিক শান্তির মুক্তি, তার চিরন্তন শান্তির মুক্তি। তার মনে হচ্ছিল এলিজাবেথের করুণ পিয়ানো সুর যেন এখনো তার পেছনে বাজছে, যেন সেই সুর তাকে উইন্ডসর হাউসের অভিশপ্ত জালে আবার টেনে নিয়ে যেতে চাইছে, এক অদৃশ্য টান তাকে ফিরতি পথে টানছে, তার ইচ্ছেকে অগ্রাহ্য করে, তার উপর এক অদম্য প্রভাব ফেলছে, তাকে তার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছিল, তাকে এক পুতুলের মতো ব্যবহার করছিল, তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছিল, তাকে এক অসহনীয় যন্ত্রণায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল, তাকে এক জীবন্ত নরকে রেখে দিচ্ছিল। একবার তার মনে হলো, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একদল অস্পষ্ট ছায়া তাকে অনুসরণ করছে, তাদের দীর্ঘ হাতগুলো যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে, তাদের চোখ থেকে এক তীব্র ঘৃণা ঝরে পড়ছে, যেন তারা তার রক্ত পান করতে চাইছে, তার আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছে, তাকে চিরতরে বিলীন করে দিতে চাইছে, তাকে অস্তিত্বহীন করে দিতে চাইছে, তাকে তার নিজের পরিচয় থেকে মুছে দিতে চাইছে, তাকে এক শূন্যতায় ডুবিয়ে দিতে চাইছে, তাকে পাগল করে দিতে চাইছে। সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না, শুধু এক তীব্র আর্তনাদ তার ভেতরেই আটকে রইল, তার কণ্ঠস্বর যেন ভয়ে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে যেন কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল, তার জিহ্বা যেন জমে গিয়েছিল, তার ফুসফুস যেন ফেটে যাচ্ছিল, তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন অকার্যকর হয়ে পড়ছিল, সে যেন এক মৃতদেহের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, এক জীবন্ত লাশ, যা কেবল শেষ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায়, শেষ বিচারের অপেক্ষায়। তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিল, শরীর ঘামে ভিজে গেছে, প্রতিটি শিরায় শিরায় যেন বরফ জমাট বেঁধেছে, তার শরীরের সব শক্তি যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে, সে যেন এক মৃতদেহ, যার জীবনশক্তি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে হোঁচট খেল, পড়ে গেল, তার হাত-পা ছড়ে গেল, কিন্তু ব্যথার অনুভূতি তার ভয়ে চাপা পড়ে গেল, শারীরিক যন্ত্রণা তার কাছে তুচ্ছ মনে হলো, সে যেন সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিল, তার শরীর যেন তার নিজের নয়, এক অনুভূতিহীন মাংসপিণ্ড, যা কেবল পালানোর জন্য সচল। সে কোনোমতে উঠে আবার দৌড়াতে শুরু করল, তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সেই ভিলা থেকে দূরে, যত দূরে সম্ভব, পালিয়ে যাওয়া, এই নরক থেকে নিজেকে মুক্ত করা, তার নিজের জীবন বাঁচানো, তার আত্মাকে বাঁচানো, তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত, তার শেষ শক্তি দিয়ে, তার জীবনের শেষ আশা দিয়ে, এক নতুন জীবনের আশায়, এক নতুন ভোরের আশায়, এক নতুন সূচনার আশায়, এক নতুন ভবিষ্যতের আশায়, এক নতুন দিনের আশায়।
প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটার পর ভোরের আবছা আলো ফুটতে শুরু করল। কুয়াশা পাতলা হতে শুরু করেছে, যেন রাত্রির ভয়াবহতার পর্দা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, আর তার চারপাশের পৃথিবী আবার দৃশ্যমান হচ্ছিল। দূরের পাহাড়ের চূড়াগুলো আবছা দেখা যাচ্ছে, তাদের নীলচে আভা যেন এক নতুন পৃথিবীর জন্ম হচ্ছে, এক নতুন সকালের ইঙ্গিত, যা তার জীবনে আবার আলো ফিরিয়ে আনছে, তাকে নতুন জীবনের আশা দেখাচ্ছে, তাকে নতুন করে বাঁচার সুযোগ দিচ্ছে, যেন সে এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে, একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে। অর্ক তখনো কাঁপছে। ঠান্ডায় নয়, ভয়ে, এক অস্তিত্বহীন আতঙ্কে যা তার প্রতিটি কোষকে গ্রাস করে ফেলেছে, তার মনের গভীরে বাসা বেঁধেছে, তাকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে, তার ভেতরের মানুষটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, তার আত্মার উপর এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে, যা হয়তো কোনোদিনও সারবে না, যা তার জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে, তাকে প্রতি মুহূর্তে সেই বিভীষিকার কথা মনে করিয়ে দেবে, তাকে এক জীবন্ত দুঃস্বপ্নে আটকে রাখবে। সে নিজেকে একরকম টেনে হিঁচড়ে কালিম্পং বাস স্টপে পৌঁছল, তার শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার শেষ শক্তি কেড়ে নিচ্ছিল। একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসল, গরম চায়ের কাপটি ধরে তার হাত কাঁপছিল। গরম চা হাতে নিয়ে তার শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক হলো, কিন্তু মনের মধ্যে যে ভয় বাসা বেঁধেছে, তা সহজে দূর হওয়ার নয়, তা তার সত্তার গভীরে গেঁথে গিয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত নিল, কালিম্পং-এ আর এক মুহূর্তও নয়। প্রথম যে বাস পাবে, তাতেই সে শিলিগুড়ি ফিরবে, আর কখনোই এই অভিশপ্ত স্থানে ফিরে আসবে না, তার জীবনে আর কখনো এই জায়গার নাম উচ্চারণ করবে না, যেন এই স্থানটির কোনো অস্তিত্বই নেই, এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন মাত্র, যা সে তার স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চায়, চিরতরে, তার জীবনের শেষ পর্যন্ত, তার অস্তিত্বের শেষ পর্যন্ত।
চলবে….
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion